ইশরাত জাহান স্টেলা:
খুব দূরের ফ্লাইট নয়, প্লেনটিও নয় এয়ারবাসের সুপার জাম্বো। ঝকঝকে আবহাওয়া, নেই কোনো সন্ত্রাসী হামলার হুমকি, তবু, সিনিয়র ক্রু পাইলটের নাম ঘোষণা করতেই আঁতকে উঠলেন কেউ কেউ। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতেই হচ্ছে যাদের সিংহভাগই সুসজ্জিত, ইংরেজীতে পটু অর্থাৎ সমাজের (তথাকথিত) ওপর তলারই বাসিন্দা। স্মুদ, যাকে বলে একদম স্বাভাবিক ল্যান্ডিং এর পর ওই সুসজ্জিত নারীকুলের ভাষ্য- মেয়ে পাইলটের হাতে এভাবে কী মনে করে প্লেনটা ছেড়ে দিলো বিমান কর্তৃপক্ষ?
পুরুষ বন্ধুদের সাথে বসে ধূমপানরত নারীদের অনেক সময়ই বলতে শোনা গেছে, মেয়েদের আসলে ঘরের ভেতরেই সিগারেট খাওয়া উচিত। কেন বাপু? তাহলে কি তাদের নিকোটিন থেকে প্রাপ্ত ক্ষতি একটু কম হবে? একই কথা এই ক্যারিয়ারিস্ট নারীকুল বলেছেন অচেনা নারীর মদ্যপান নিয়েও।
অধ্যাপিকার ব্লাউজের গলা বড়ো বা ছোট হওয়ার ওপর নাকি তার জনপ্রিয়তা নির্ভর করতো। ভাষ্য, সহপাঠীকে বিয়ে করা, উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্তা এক রমণীর। উল্লেখ্য, কেবল রমনের জন্যই এরা পৃথিবীতে এসেছেন বলে আমি নিশ্চিত! তাই রমণী বলেই ডাকলাম। নয়তো ওই প্রতিষ্ঠানের ওই শিক্ষিকার কাছ থেকে পাঠ নিয়ে তিনি স্বামীর চাইতে বেশি বেতনে কর্মরত হয়েও কেবল সুপ্ত পুরুষবাদী মানসিকতার জন্য এই মন্তব্য করলেন।
পুরুষবাদী থাকার ইচ্ছেটা নারীর একান্ত নিজস্ব বলেই মনে হয়। নইলে সারাদিন অফিসে বসে পুরুষ বসরা কেবল পুরুষ সহকর্মীদের মাথায় তুলে রাখেন- এহেন অভিযোগ করার পর, এ্যাসাইনমেন্ট থেকে ফিরে বলতে বসেন, জানোওও, আজ তমুক অফিসের অমুক আপুকে দেখলাম হাতাকাটা জামা পরে আসছেন। কী আজব বলো তো, ভাবা যায় এতোগুলো পুরুষের সামনে! আচ্ছা আপ্পি, আপনার বসরা ওই আপুর মতো স্মার্ট নারী সহকর্মীকে খুঁজছেন না তো? আপনার জবুথবু অবস্থা দেখে বিরক্ত নন তো! বা, আপনাকে অফিসের উপযুক্ত নারী প্রতিনিধি ভাবছেন না হয়তো।
কোটি কোটি সুপ্ত পুরুষবাদী নারী রয়েছেন আমাদের চারপাশে। সকাল থেকে কেউ অবিরাম চেঁচিয়ে যাচ্ছেন এই বলে যে, এ দেশের কোথাও কাজ করে শান্তি নেই। এখানে নাকি অপদার্থ পুরুষও যোগ্য নারীর থেকে এগিয়ে যান কেবল পুরুষ হয়ে জন্মানোর জন্য। আবার ইনিই বিকেলে মেয়ে কলিগকে বলছেন, তোমার হাসবেন্ড বলেই এটা এ্যালাউ করেছে, আমার বাবা, ভাই, স্বামী, কাকা, চাচা, মামা, খালু বা শ্বশুরকুলের ফুফা তাদের স্ত্রী এমন করলে ঘাড় ধরে বের করে দিতো। পুরুষকে তো আপনিই মনিব বানিয়ে ঘুরছেন জ্ঞান হবার পর থেকে, তবে কিসের অভিযোগ?
বাবা-মা লেখাপড়া শিখিয়েছেন, সেই জোরে চাকরি করছেন, বেলা শেষে পার্টিতে এসে জাহির করছেন, শিফনই পরতে চেয়েছিলাম কিন্তু “ও” দিলো না। ভীষণ পজেসিভ তো! শাড়িটা নাকি নিজে উপার্জিত অর্থেই কিনেছিলেন ভিনদেশ থেকে, সেটাও জানলাম।
তবে কি বাঙ্গালী নারীর কাছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা কর্মকর্তা কর্মচারির? স্ত্রীর যতো যোগ্যতাই থাকুক? আরে আমি তো বলিনি, আপনিই বললেন!
তবে, সুপ্ত পুরুষবাদী নারীদের মতো আমারও সুপ্ত আশা, একদিন পরিবর্তন আসবেই। ভুলে যাবেন না আপারা, এসব অভিযোগ করে স্ববিরোধী আচরণ আপনিই করছেন। পুরুষের জুতাই হোক আর কথা, যে কোনোটি দিয়ে দলিত মথিত হবার ইচ্ছে আপনার রয়েই গেছে। নিজেকে বদলান, তবেই বদলে যাবে অনেক কিছু।
ও হ্যাঁ, আর নারীবাদীরা যে সব জায়গায় নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে রেখেছেন, সেটা দেখেও কিছু শিখুন। মেয়ে হয়ে সমালোচনা যতই করুন না কেন, নিজের দুর্বলতার জন্য ওই জায়গাটা আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে নয় তো?
ঢাকা, ২০১৭