নারীবাদে কি বিশেষ শ্রেণির নারীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব আছে?

সালমা লুনা:

গৃহিনী আর কর্মজীবী নারীর কি আলাদা উঠোন? গৃহিনী মাত্রই পরাধীন সেবাদাসী যৌনদাসী? আর কর্মজীবী মানেই স্বাধীন নারী, যে কারো দাস নয়?

ঘর আর কর্মস্থল নারীর কর্মের ক্ষেত্র তো দুটোই। তবে বাইরের কাজ করে রোজগার করা নারী আলাদা কেন? কর্মক্ষেত্র বা উপার্জনের যে ক্ষেত্র, সেটি কি এই সমাজের বাইরে? সেখানেই কি সে স্বাধীন? মুক্ত?
দু’জায়গাতেই তো নারীকে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হয় পদে পদে। প্রতিনিয়ত চাকরি টিকিয়ে রাখতে, সংসার টিকিয়ে রাখতে, নিজের সম্মান বাঁচিয়ে অস্তিত্বকে জাগিয়ে এঁকেবেঁকে খানাখন্দে ভরা জীবনের পথ পেরিয়ে যেতে হয় নারীকে।
একথা তো আরেকজন নারীর বোঝার কথা, পুরুষরা না বুঝলেও।

একদিন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে গিয়ে বসে আছি ওয়েটিং রুমে। কাজের ছুটা বুয়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বললাম, উনাদের তো এখন রমরমা। প্রতি কাজ এক হাজার টাকা।
একজন শুনে আঁতকে উঠলেন। “বলেন কী! আমাদের এদিকে তো অনেক কম! কোন এলাকা?”

এলাকার নাম শুনে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন, নিজের লোকাল ভাষায় যা বললেন, তার সারমর্ম হলো ধানমন্ডি, গুলশান এলাকার নারীরা বড়লোকের বউ, আরামপ্রিয়। তারা কোনো কাজ করে না। বিছানায় বসে খায়, ওখানেই মলমূত্র ত্যাগ করে, আবার ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। ওইসব ‘ _ ‘ দের জন্য বুয়ারা ইচ্ছেমতো মজুরী হাঁকায়, আর এই উচ্চমূল্য দিতে গিয়ে তারা নাস্তানাবুদ হচ্ছেন।

আশা করি বলে দিতে হবে না ওই ড্যাশটিতে একটা অশ্রাব্য শব্দ ছিলো।
এবং উপস্থিত সকলেই হেসে দিয়েছিলো।
আমি যেহেতু ধানমন্ডিতেই থাকি এবং অতি অবশ্যই বিছানায় বসে খেয়ে ওখানেই ইয়েটিয়ে করে ঘুমিয়ে পড়া নারীদের একজন- তাই মুখখানা তোম্বা করে বসেছিলাম। এবং কন্যাকে নেবার অছিলায় দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিলাম।

কিন্তু স্থান ত্যাগ করলেই কি আর রক্ষে হয়?
হয় না।
ফেসবুকে ঢুকলেই ইদানিং ঘটনাটি প্রায়ই মনে পড়ে। মনে পড়িয়ে দেয় বর্তমানের চলমান নারীবাদ বিতর্ক।

বাংলাদেশে, বলতে গেলে ফেসবুকে নারীবাদ নিয়ে বেশ শোরগোল উঠে হঠাত হঠাত। সত্যি বলতে ফেসবুক ছাড়া এই হৈচৈ ফেলে দেয়া নারীবাদের অস্তিত্ব অন্য কোথাও খুব একটা চোখে পড়ে না।

ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন, ধর্ষণের আশংকাজনক বৃদ্ধির হার, নারী ও শিশু ধর্ষণ, সরকার কর্তৃক ধর্ষণের শিকার নারীর সাথে ধর্ষকের বিয়ের আইন, ধর্ষণের দ্রুত বিচারে চাপ প্রয়োগ, নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাংলাদেশের নারীবাদ একটু বেশীই উদাসীন ও নমনীয়।
এজন্যে এই নারীবাদ ব্যাপারটাই গোলমেলে আমার কাছে।

একেবারে ছোটবেলায়, যখন মিডিয়ার এমন রমরমা দিন ছিলো না, আমরা একটা-দুটো পত্রিকা, একটা দুটো সাপ্তাহিকেই সারা পৃথিবীর খবর নিতাম, পেতাম। তখন প্রথম নারীবাদকে দেখেছিলাম- কাপড় ছাড়া- নগ্ন। ফ্রান্স কিংবা ওই ইউরোপিয়ান কোনো দেশের রাস্তায় সাদা ধবধবে নারীরা একটা প্রতিবাদে নেমেছেন নারীর বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে। এবং তাদের শরীরে একটি সুতোও নেই। আমার তখন খুব বেশীদিন হয়নি- বইপুস্তকে পড়ে জ্ঞান অর্জন হয়েছে আদিম মানুষ আগুন জ্বালিয়ে এবং গাছের বাকলে লজ্জাস্থান ঢেকে প্রথম সভ্যতার দ্বারে পা দেয়। এরপর থেকেই চলছে সভ্যতার অগ্রযাত্রা। তাই ওই প্রতিবাদ দেখে আমি পেলাম ভয়। সেই থেকে নারীবাদ বিষয়টি একটু ভীতিকর হয়েই মর্মে গেঁথে রইলো।

আমার মনে নারীবাদ নিয়ে ভীতি বা জটিলতা থাকলেও নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নানা অন্যায় অবিচার বৈষম্যগুলো এমনিতেই চোখে পড়তে শুরু করলো কৈশোর থেকেই। ঠিক তখনই এর সাথে যুক্ত হলেন আমাদের তসলিমা নাসরিন।

আমাদের জেনারেশনকে অতি অবশ্যই এক্ষেত্রে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতেই হবে যে, তিনিই আমাদের প্রথম দীর্ঘদিনের জমে থাকা ঘন অন্ধকারের পরতে পরতে আলো ফেলে দেখিয়েছেন আমাদের জঞ্জালগুলো, উল্টো হয়ে ঝুলতে থাকা বাদুরের মতো ভীতিকর কুসংস্কারগুলোর মুখোমুখি করেছেন নির্দয়ভাবে। আমরা অনেককিছুই সেই আলোয় দেখে দেখেই বড় হলাম।
আমি একে নারীবাদ বলতে চাই না।
বলতে চাই সচেতনতা। নারীর নিজের প্রতি, অন্য নারীর প্রতি নিরন্তর ঘটতে থাকা সকল অন্যায় ও বৈষম্যের প্রতি সচেতন সহমর্মী সমব্যথী হওয়া। আর একটু হলেও প্রতিবাদ করতে শেখা।

একে কেউ নারীবাদ বলতে চাইলে বলতেই পারেন, সেটি তাদের বিবেচনা।

এই যে ফেসবুকে শোরগোল উঠে নারীবাদীদের নিয়ে, এর একটা অংশে যেমন আছেন কিছু স্বঘোষিত, ফতোয়াবাজ নারীবাদী, যারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাছলা মাছায়েল দিয়ে হৈচৈ ফেলে দেন। তেমনি আরেকটা অংশে আছেন, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের আদ্যপান্ত মেনে চলা আরেক দল নারীপুরুষ। এরা সমস্বরে কলরব করতে করতে নানাবিধ গালি সহযোগে নারীবাদীদের ধুয়ে কচলে আছড়ে অশ্লীলতার চূড়ান্ত করে সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে লেজেগোবরে করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না।

নারীবাদ আমার কাছে আগেও গোলমেলে ছিলো, এখনো গোলমেলেই। সম্ভবত নারীবাদকে গালাগাল করা ওই অংশটিও বিভ্রান্ত। তাই এতো গালাগাল।

নারীবাদ তবে কোন নারীদের কথা বলে?

নারীবাদে তো সকল নারীর কথাই বলার কথা। প্রান্তিক যে নারী ক্ষেত-খামারে, কলকারখানায়, মাঠে-ঘাটে, চা বাগানে, এমনকি পতিতালয়েও কাজ করে তার সমস্যা যেমন তার বাস্তবতায় কলরব করে। তেমনি মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত নারীর সমস্যা, তার নিপীড়ণের কথাও তো নারীবাদে শোরগোল তোলার কথা।

স্কুলের সেই ভদ্রমহিলার মতো ক্রুদ্ধ হয়ে আজকাল বেশকিছু নারীবাদী লেখকরা লিখছেন বড়লোকের বউদের কটাক্ষ করে। একটি পোর্টাল নাকি বড়লোকের বউদের কথা বলে, লেখা ছাপায়, তাদের পছন্দের লেখাই ছাপে, এসব অভিযোগও দেখেছি। একবার এক নারীবাদী পুরুষের লেখায় দেখলাম, তিনি বড়লোকের বউদের সম্বোধন করেছেন ‘যৌনদাসী’ এবং ‘সেবাদাসী’ বলে। কেননা তার বক্তব্যমতে সেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে না জানা নারীরা নাকি শুধুমাত্র তুচ্ছ ভরণপোষণের জন্য স্বেচ্ছায় ওই জীবন বেছে নিয়েছে।

এখন ফতোয়াবাজ সেইসব নারীবাদী লেখকদের কি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই প্রশ্নটি করাই যায়, যে শিক্ষিত কর্মজীবী নারীটি নিজের চাকরি টিকিয়ে রাখতে কিংবা নেহাতই শখ মেটাতে বা পরকীয়ার আনন্দ নিতে অফিসের বড়কর্তা, বন্ধু বা যেকারো সাথে নিয়মিত যৌন সঙ্গ করে, তাকে কী বলা হবে?
খেলোয়াড়?
নাকি এটি স্বাধীন সক্ষম কর্মজীবী সেই নারীর অধিকার, যিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন তো বটেই, কিন্তু আগাপাশতলা একটি প্রতারক কিংবা আপনাদেরই ভাষায় ‘যৌনদাসী’।

অন্যের জুতোয় পা না গলিয়ে কী করে বুঝবেন তার সমস্যা!

বড়লোক বা গরীব মজদুরের বউ যে নারী, খেটে খাওয়া কর্পোরেট থেকে গার্মেন্টস মজুর যে নারী, সেই নারীদেরকেই- তাদের অধিকার সম্পর্কে জাগিয়ে তোলার কাজটি যদি নারীবাদ হয়, তবে কেন এই আক্রোশ শুধুমাত্র বড়লোকের বউদের প্রতি!

নারীবাদ সোচ্চার হোক নারী নির্যাতন ও নির্যাতকের বিরুদ্ধে, সমাজে নারীর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নারীর কর্মক্ষেত্রে সমঅধিকার আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার পক্ষে, নারীর মেহনতের স্বীকৃতি আর মজুরীর ন্যায্যতার পক্ষে। হোক তার শরীর আর মনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে।

সেটি হোক কর্মজীবী কিংবা গৃহিনীর জন্য। সে হোক ছোটলোক বা বড়লোকের বউ। কেউ যেন নিপীড়িত না হয়। একটি নারীও যেন অবহেলিত না হয়। নারীবাদ হোক যেকোনো নির্যাতিত অবহেলিত নারীর পক্ষে। দাঁড়াক অত্যাচারীর বিপক্ষে, এমনকি অত্যাচারী মানুষটি নারী হলেও তাকে রুখে দিতে হবে।

নারীবাদ শব্দটি হাস্যকর একটি গালিতে পরিণত হবার আগেই নারীবাদীদের সচেতন হওয়া দরকার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.