ট্রাভেলিং টু …

কামরুন নাহার রুমা:

আমার ইস্কাটনের বাসায় আমার মা মাত্র দু’বার এসেছিলেন; দুবারই চিকিৎসার জন্য। আমি আমার মাকে সময় দিতে পারতামনা । আমি সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে, মা সারাদিন বাসায় একা । আমার মা সারাদিন বাসায় একা একা কী কঠিন সময় পার করতেন আমি জানতাম। কারণ আমিও যে একা থাকা মানুষই তখন! আমার তো তবুও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ‘আট সন্তানের জননী’ আমার মায়ের তো কখনও সেই প্রয়োজনই পড়েনি। পরিস্থিতিতে পড়ে আমার মাকে একলা থাকতে হয়েছিল চিকিৎসার কটা দিন। আর সেই জন্যই আমার মা ঢাকায় আসতে চাইতেন না। একা সময় কাটানো বড় কঠিন। এখানে আমার বাসায় এসে যেমন একলা হয়ে যেতেন, তেমনি অনেক মা আছেন যারা তাদের নিজের ভিটায়, নিজের ঘরে একদম একা, অনেক সন্তান থাকা সত্ত্বেও।

লেখাপড়া আর চাকরির জন্য নিজের জন্মস্থান ছেড়ে বড় শহরে পাড়ি জমানো অনেকেই আমরা একটা সময় ভুলে যাই গ্রামের বড়িতে মা আছেন, যিনি রোজ অপেক্ষায় থাকেন তার সন্তান নাতি নাতনীরা আসবে তাঁর কাছে, তাদের কাছে (মা-বাবা)। কিন্তু ব্যস্ততায় সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না অধিকাংশ সন্তানের। কিন্তু শুধুই কী ব্যস্ততা সদিচ্ছার অভাবও কী নেই আমাদের?

এখন ফেসবুকের বদৌলতে আমরা অন্যের অবস্থা এবং অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারি। তাই কে, কবে, কোথায় বেড়াতে যাচ্ছেন, সেটাও দেখতে পাই। কর্মব্যস্ত নাগরিকগণ একটু ছুটি পেলেই ছুটে যান মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত বা ভুটান; নিদেনপক্ষে সাজেক, বান্দরবন বা সিলেট। প্রতিদিনিই অল্পবিস্তর চেক ইন দেখা যায়; দেখা যায় ট্রাভেলিং টু অমুক বা তমুক। ভ্রমণ খুবই ভালো ব্যাপার; আমার কাছে তো ভ্রমণ নেশার মতো। কিন্তু সেই চেক ইনটা কতটুকু মায়ের কাছে বা নানু বাড়ি বা দাদু বাড়ি হয়?

বৃদ্ধা মা-বাবা, দাদু-নানু দিনের পর দিন পথ চেয়ে থাকেন তাঁদের সন্তানরা আসবে, নাতি-নাতনিরা আসবে। সেই আশায় থেকে থেকে তাদের খেজুরের গুঁড়ে পিপড়ে ধরে, চালের গুড়ায় ছাতা (ছত্রাক) পড়ে; পিঠা আর বানানো হয় না; আচারের বয়াম রোদে শুকাতে শুকাতে পাশের বাড়ির দুষ্টু ছেলেদের পেটে যায়; গাছের আম-কাঁঠাল পাখ পাখালি খায়। সন্তানরা আসবে, নাতি-নাতনিরা আসবে এই আশায় দাদুর হাতে লাগানো লাউ গাছের মাচাং লাউয়ের ভারে ভেঙ্গে পড়ে; বিন্নি ধানের খইয়ে পোকায় ধরে। কত শীত-হেমন্ত আসে যায়, বৈশাখ জ্যৈষ্ঠও ফুরায়, কিন্তু সন্তান-নাতি-নাতনিরা তো আসে না!

মায়ের বাতের ব্যথা বাড়ে, বাবার চোখে ছানি পড়ে, তবুও সন্তান যে আসে না! সন্তানরা আসে বড়জোর দুটি ঈদে বা পূজার ছুটিতে। এই কটা দিন মায়ের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি যায়, তাও মা খুশি হরেক রকম রান্না করে; বাবা খুশি সন্তানদের জন্য ডুলা (বাঁশের তৈরি পেটমোটা ঝুড়ি বিশেষ) ভরে বাজার করে। একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে কয়েকদিনের জন্য হলেও তাঁরা মুক্তি পান। অনেকে হয়তো ভাবছেন, কই নাতো! আমরা তো রেগুলার যাই মা-বাবাকে দেখতে! অনেকে ভাববেন, কই মা-বাবা তো আমাদের সাথেই আছেন!

হ্যাঁ অনেকেই তা করেন, অনেকের মা-বাবাই সাথে থাকেন। কিন্তু আবার অনেকেই তা করেন না; একটা বড় অংশই করেন না। যারা করেন না, তাদের সন্তানরা ইংলিশ ছবির গ্র্যান্ডমাকে যতো চেনে, তার নিজের দাদীমাকে বা ঠাম্মাকে ততো চেনে না। আর যাদের মা-বাবা সাথে থাকেন, তাঁরা মা-বাবাকে কতটুকু সময় দেন একটু ভেবে দেখবেন তো!

এই শীতে সিঙ্গাপুর না গিয়ে আপনার সন্তানকে নিয়ে গ্রামে মায়ের কাছে চলে যান না! আপনার সন্তান ভোরের শিশিরে ভেজা ক্ষেতের আলপথ ধরে হাঁটুক, ডুলা হাতে দাদার সাথে বাজারে গিয়ে ইচ্ছেমতো শীতের সবজি কিনুক এবং চিনুক; ঢেঁকিতে চালের গুড়া কীভাবে ভাঙ্গে, তা দেখুক, দাদীর সাথে চুলার ধারে বসে পিঠা বানাক; খেজুর গাছে বাঁধা মাটির কলসি থেকে চুরি করে খেজুরের রস খাক; মাঠ দাপিয়ে গোল্লাছুট আর দাঁড়িয়াবান্দা খেলুক; নদীতে সাঁতার কাটুক অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে; রাত জেগে খড়ের গাদায় আগুন জালিয়ে রূপকথা শুনুক দাদুর মুখে – আর তাদের এই সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে এক চিলতে হাসি ফুটুক দাদা-দাদীর মুখে; কেটে যাক একাকীত্বের যন্ত্রণা কিছুদিনের জন্য হলেও!! আমরা সবাই যাতে মনে রাখি শুধু টাকা পাঠিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ হয় না। টাকার চেয়েও মা-বাবার কাছে বেশি চাওয়ার হলো তাদের একটু সঙ্গ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.