ঋতুরক্ত কী? কতোটা অপবিত্র ঋতুরক্ত? কেন?

শেখ তাসলিমা মুন:

ফেইসবুকে জারমেইন গ্রিয়ারের একটি কোটেশন লিখেছিলাম গতকাল,’যদি তুমি নিজেকে মুক্ত মনে করো, তবে তুমি তোমার ঋতুরক্ত একটু চেখে দেখার কথা ভেবে দেখতে পারো —যদি তোমার এতে ঘেন্না লাগে, তবে তোমার আরও অনেক পথ বাকি আছে, মেয়ে।’
কোটেশনে ছেলেরা নয়, মেয়েরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বেশি এবং গ্রিয়ার ঠিক এই জায়গাটাতেই নেইল বসিয়েছেন। ‘ঘেন্না’। কেউ এটাকে পায়খানা-প্রস্রাবের সাথে তুলনা করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে সামান্য লেখা দরকার সে কারণে।
নারীর ঋতু নিয়ে হাজার বছর ধরে আমাদের মানসিকতা। আদিম মানুষেরা কী বলেছে! ধর্ম কী বলেছে! ধর্মের আগের বিধানগুলো কী বলেছে! প্রথা কী বলেছে! আধুনিক দার্শনিকরা কী বলেছেন! নারীবাদী দার্শনিকেরা কী বলেছেন! এগুলো জানলে বিষয়টি নিয়ে আমাদের মনোভাব পরিষ্কার হয়ে আসবে।

নারীর ঋতুকালীন সময়ে ধানের গোলা ছোঁয়া নিষিদ্ধ ছিল কিছুদিন আগেও। এ সময়ে তার পাশে শোয়া নিষিদ্ধ; বিশেষ করে সকালে ফজরের নামাজ পড়তে হলে ঋতুবতীর পাশে কেউ শুতো না।। হিন্দু ঋতুমতি নারীকে শীতের দিনেও নীচে বস্তা বিছিয়ে শুতে দেওয়া হতো। লেপ দেওয়া হতো না, কারণ লেপ ধোয়া যায় না। অতি ভোরে সাতদিন স্নান করতে হয়েছে তাঁদের শীত-গ্রীষ্মে!

অনেক ক্ষেত্রে স্বামীর মুখ দেখা বারণ। এমনকি সিঁথিতে সিঁদুর পরা বারণ। পিরিয়ডকালীন অবস্থায় তাঁদের রান্নাঘরেও ঢোকা বারণ ছিল। পূজোর ঘরের বারান্দায় উঠা এখনও নিষেধ। দুর্গাপূজোর সময় উচ্চশিক্ষিত এক নারী বিসর্জনের দিনে পুজোয় গিয়ে অডিটরিয়ামে পেছনে বসে আছে। সামনে কেন যাচ্ছে না জিজ্ঞেস করতে বললো, আমি মাকে আজ দূর থেকে প্রণাম করবো, আমার আজ পিরিয়ড।
আমাদের বাড়িতে কোরআন শরিফ থাকতো একটি কাঠের আলমারির মাথায়। একটি পরিষ্কার ছোট্ট কাঁথায় মোড়া থাকতো। পিরিয়ড হলে সেখান দিয়ে হাঁটাও বারণ ছিল।
এগুলো খুব আধুনিক মনোভাব।

তবে আদিম পুরুষেরা ঋতুমতি নারীকে দেখেছে ঘৃণার থেকে ভয়ের চোখে বেশি। বলা হয়, তারা নারী যোনিকে সাপের গর্ত হিসেবেও দেখেছে। তারা ভয় পেয়েছে সেখান থেকে ক্ষরিত রক্ত দেখে। শয়তানের কারসাজিও মনে করেছে। এভাবে নারীর দেহকে শয়তানের কারখানা হিসেবেও তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।

অ্যাংলো সাক্সেনারা একে ‘অভিশাপ’ মনে করেছে। বাইবেলে নারীকে ১২ দিনের জন্য অশুচি হিসেবে গণ্য করতে বলা হয়েছে। ইহুদি ধর্মেও নারীর এ অবস্থাকে ‘নোংরা’ সময় বলে উল্লেখ করেছে।

পরবর্তীতে ইসলাম তার পূর্ববর্তী ধর্মগুলো থেকে কিছু আইডিয়া নিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তারাও ঋতুমতি নারী বিষয়ে নিষ্ঠুর বিধান আরোপ করেছে। প্রায় সব ধর্মেই নারীর ঋতুকালে বিধি আরোপ করা হয়েছে। তাঁদেরকে অভিশপ্ত, নোংরা হিসেবে অভিহিত করে এ সময় উদাহরণস্বরূপ সঙ্গম নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে আলাদা শোয়া, স্বামীকে স্পর্শ না করার বিধান করেছে। অথচ নারী এ সময়েই যৌন আগ্রহ বেশি অনুভব করে থাকে। এ সময় তারা সব থেকে পুলকিত হয়। কিন্তু প্রায় সব ধর্মেই নারীকে এ সময় অস্পর্শযোগ্য করে রেখেছে। পুরুষেরাও এ সময় নারীর প্রতি ঘৃণা বোধ করে। কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ ছাড়াই। অতি কামুক পুরুষও নারীকে এ সময় ছুঁতে চায় না। নারীরা নিজেরাও বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তারা অশুচি। অথচ এমন কোথাও কোন প্রমাণ নেই যে, নারীর ঋতুকালে সঙ্গম করা অপবিত্র বা ক্ষতিকর। বরং এ সময় নারী থাকে সবচাইতে নিরাপদ এবং মনোরম। সাবধানতার জন্য ডাক্তাররা ঋতুকালীন সময়ে সঙ্গমে কনডম ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন!

ঋতুক্ষরণের রক্ত দূষিত এমন কোনো প্রমাণ মেডিকেল সায়েন্সে নেই। ঘৃণার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। জারমেইন গ্রিয়ার হলো সেই চিন্তাবিদ, যিনি মেয়েদের কেবল অবগত করেননি এ বিষয়টি, তিনি ঋতুস্রাবকে উৎসব করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, এতে যে মেয়েরা প্রথম রক্ত দেখে আঁতকে উঠেছে, ভয় পেয়েছে, নিজেকে ঘৃণ্য এবং অপবিত্র ভাবতে শুরু করেছে, তারা জীবন শুরু করার কারণ পাবে। আনন্দ পাবে। তারা বুঝবে, তারা এখন জীবনে প্রবেশ করছে।
এই জারমেইন গ্রিয়ারই বলেছেন, ” যদি তুমি নিজেকে মুক্ত মনে করো, তবে তুমি তবে তুমি তোমার ঋতুরক্ত একটু চেখে দেখার কথা ভেবে দেখতে পারো”।

এখন দেখি ঋতুরক্ত কী? কতটা অপবিত্র রক্ত এটি?
সিমোন দ্য বোভোয়া রূপকের মাধ্যমে চমৎকার করে এটি বুঝিয়েছেন। বলেছেন, এটি একটি দোলনা। প্রতি মাসে একটু একটু করে নারী দেহে একটি দোলনা গড়ে ওঠে একটি শিশুর জন্য। শিশুটি যখন আসে না, তখন দোলনাটি ভেঙে পড়ে। এই দোলনা বিষণ্ণ রক্ত ঝরায়। এটি একটি দোলনা চিত্রকল্প। কিন্তু আসলে কী ঘটে তখন?

বয়ঃসন্ধিকালে একটি বালিকার ডিম্বাশয় পূর্ণ হয় লক্ষাধিক ডিম্বাণুতে। তার ভেতর তরল একটি পদার্থ থাকে। সেটি ফলিকল। উদ্দিপক হরমন ফলিকলকে উদ্দিপ্ত করে। আস্তে আস্তে ফলিকল বৃদ্ধি পায়। আর তখন উৎপন্ন হয় ইস্ট্রোজেন হরমোন। এই হরমোন অনেকগুলো সিগনিফিকেন্ট কাজ সম্পন্ন করে বালিকার দেহে। এই ইস্ট্রোজেনই তার স্তননালি ও স্তনবৃন্তের চারপাশ বড় করে। এটি যোনি ও জরায়ুকে বড় করে। অর্থাৎ বালিকাকে নারী হতে সাহায্য করে।

ইস্ট্রোজেন বেড়ে গিয়ে জরায়ুর দেওয়ালে আস্তরণ তৈরি করে। ওটাকে বলে এন্ডমেট্রিয়াম। জরায়ুর ভেতরের দেওয়ালের আস্তরণ গঠিত হয় কিছু রক্ত নালি সেগুলো যখন ভেঙে যায় জরায়ুতে রক্তক্ষরণ ঘটে। এন্ডমেট্রিয়াম ভেঙে যায়। রক্ত, কিছু তরল জাতীয় পদার্থ আর এন্ডমেট্রিয়ামের কোষ জরায়ু থেকে যোনি পথ দিয়ে বেরিয়ে আসে। এভাবে একটি বালিকার দেহে ঋতুর সূচনা হয়।
এটি দশ বছর বয়স থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত চলতে পারে।

আমি ডিম্বস্ফোটন নিয়ে আলাদা কিছু এ ছোট্ট নোটে লিখলাম না।
বেদনার বিষয়, এটাকে ঘিরেই এতো ঘৃণা। অশুচিতা। এতো নিন্দা। এতো মিথের অবতারণা। অথচ এটি নারীর এক ইউনিক ক্ষমতা। একটি অপূর্ব প্রক্রিয়া। এর জন্য স্তুতি নয়, নিন্দা এবং অশুচিতা দিয়ে নারীকেই আচ্ছন্ন করে রাখা হয় বেশি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.