ক’ লাখ শহীদ পরিবারের ইতিহাস আমরা জানি?

মোহছেনা ঝর্ণা:

হারুন আপা। হ্যাঁ, হারুন আপাই। উঁচু লম্বা, মিশমিশে কালো, পেটানো শরীরের হারুন আপা। ঠোঁটের উপর দিকে বড় একটা তিল। মাঝখানে সিঁথি করা তেল চিটচিটে চুল থাকতো টানটান খোঁপায় বাঁধা। নারীসুলভ লাজুকতা কখনো চোখে পড়েনি। বিয়ে করেননি, নাকি বিয়ে হয়নি, আমি ঠিক জানি না। এক সময় বেশ সাহসী ছিলেন। বীরদর্পে হাঁটতেন। অন্তত আমার তাই মনে হতো। গরু পালতেন, কৃষিকাজ করতেন। নিজের ক্ষেতের ধান নিজেই কাটতেন। নানা রকমের বিরূপ মন্তব্য শুনতেন, কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে টলতেন না।

বাড়িতে ছেলে কেউ নেই, কাজের মানুষ নেই, বাজার করার মানুষ নেই, তাই বলে তো ক্ষুধার্ত মুখগুলোর ক্ষুধা তো আর মুখ বুঁজে বসে নেই। আর তাই মেয়ে হয়েও পুরুষের মতোই ঘরের – বাইরের সব কাজ করতেন হারুন আপা।
হারুন আপারা ছয় বোন ছিলেন। আমাদের বাড়িতে ছিল তাদের অবাধ যাতায়াত। আমরাও যেতাম হারুন আপাদের বাড়ি। মনে আছে এক সন্ধ্যায় বীচি কলা, চালতা আর তেঁতুল ভর্তা করে খাইয়েছিল আমাদের। তখনো তাদের অবস্থা চলার মতো ছিল। কিংবা চালিয়ে নেবার মতো ছিল।

গত কয়েক বছর ধরে দেখছি হারুন আপার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। ওনার ছোট বোনটারও বিয়ে হয়নি। বড় বোন যাদের ঘর সংসার হয়েছে তারাও খুব একটা শান্তিতে নেই। অভাব, অনটন, হাহাকার লেগেই আছে। এতোই অভাব যে এখন অন্যের যাকাত ফিতরার টাকার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকতে হয়।

তাদের অভাবের দিন শুরু হয় ১৯৭১ থেকে। ৭১ এর উত্তাল একদিনে পাকবাহিনীরা আমাদের বাড়িসহ আশেপাশের সমস্ত বাড়িতে তাণ্ডব চালিয়েছিল। অনেককে ঘর থেকে ধরে নিয়ে গেছে। হারুন আপার বাবাকেও ধরে নিয়ে গেছে ঘর থেকে। সেই যে তাদের ধরে নিয়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি তারা। হারুন আপারা বাবার লাশটাও পায়নি।

হারুন আপারা কি শহীদ পরিবার নয়?

আমার একজন জ্যাঠাকেও একই দিনে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর লাশও পাওয়া যায়নি। তাঁর সন্তানরাও অমানবিক জীবন যাপন করে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
এই মানুষগুলো কিন্তু শহীদ পরিবার হিসেবে কোনো স্বীকৃতি পায়নি। তারা জানেও না, যে দেশে আজ তারা এতো মানবেতর জীবন যাপন করছে, সেই দেশটা তাদের বাবার রক্তে কেনা।

অভাব, অশিক্ষা, বঞ্চনা আর দু’ বেলা অন্নের চাহিদা মেটাতেই তারা হিমশিম খায়, সেখানে স্বীকৃতি তো অনেক অনেক অনেক দূর আকাশের তারা।
হারুন আপার বাবার কথা একবার জানতে চেয়েছিলাম তার ছোট বোনের কাছে। তিনি বললেন, “সংগ্রামের বছর আঁর বাপেরে হাঞ্জাবীরা (পাঞ্জাবীরা) মারি হালাইছে। আঁর বাবার কথা আঁর মনো নাই।”

কী বেদনা বিধুর কষ্ট! বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে!
হারুন আপার বাবা কিংবা আমার জ্যাঠা বেঁচে থাকলে যে তাদের সন্তানেরা অনেক বড় হয়ে যেতেন, অনেক স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতেন, সমস্যাহীন জীবন যাপন করতেন, আমি তা বলছি না। তবে এতোটা অসহায় তো নিশ্চয়ই হতেন না।

একাত্তরে এ রকম লক্ষ লক্ষ শহীদ পরিবারের জন্ম। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বাংলা। কিন্তু আসলে কত লক্ষ শহীদ পরিবারের ইতিহাস আমরা জানি? কত লক্ষ শহীদ পরিবারের সঠিক তথ্য সংগৃহীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে? এদেশের আনাচে কানাচে এই যে মুক্তিযোদ্ধারা, এই যে শহীদ পরিবারের স্বজনেরা মানবেতর জীবনযাপন করছে, তাদের জন্য কি কিছুই করার নেই?

প্রিয়জনদের রক্তে যেমন এদেশ কেনা হয়েছে, তেমনি স্বজনহারা মানুষদের অভিশাপে যেন এদেশের বাতাস বিষাক্ত হয়ে না উঠে, সেজন্য দেরিতে হলেও এই সব শহীদ পরিবারদের স্বীকৃতি এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের ফিরিয়ে দিয়ে কিছুটা হলেও ঋণ শোধ করার কোনো বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।

সরকার যে করছে না, তা কিন্তু নয়। সমস্যা হচ্ছে যারা সুবিধা পাচ্ছে, বারবার তারাই সুবিধা পাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলেমেয়ের পাশাপাশি, নাতি – নাতনীরাও এখন অনেক ধরনের সুযোগ – সুবিধা পাচ্ছে। তারা সুবিধা পাচ্ছে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যারা পাচ্ছে না, তাদের খোঁজ খবর কেউ নিচ্ছে না কেন?

অনেকে স্রোতে গা ভাসিয়ে সুবিধা পাবার যোগ্য না হয়েও সুবিধা নিচ্ছে। কিন্তু একটা বড় অংশই রয়ে গেছে অন্ধকারে। যাদের কথা কোথাও লিখা হয়নি। যারা অশিক্ষার কারণে নিজেদের অধিকারটুকু সম্পর্কে সেভাবে জানেও না। যেখানে নিজের অধিকার সম্পর্কে ধারণাই নেই, তাহলে অধিকারের দাবি করবে কীভাবে? কিন্তু তাই বলে আমরা নিরব থেকে তাদের অধিকার বঞ্চিত করলে সেই পাপ কিন্তু আমাদের পিছুও ছাড়বে না কখনো।

তাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা, তৃণমূল পর্যায়ে এ রকম মানবেতর জীবন যাপন করা লক্ষ লক্ষ শহীদ পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদের প্রাপ্য সম্মান, স্বীকৃতি, অধিকারটুকু তাদের বুঝিয়ে এদেশকে কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত করুন। তালিকা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই সত্যিকারের মানুষগুলোকেই খুঁজে বের করুন। শহীদ পরিবারগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে এখনো অনেক চাক্ষুষ সাক্ষী পাওয়া যাবে। এছাড়া এখনকার তরুণ প্রজন্ম এ কাজে খুব আন্তরিকভাবেই সহযোগিতা করবে বলে আমার বিশ্বাস।

একাত্তরের যাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদানে, আজ আমরা একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি, তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.