“আয়েশা এবং একটি শরিয়া আইনের আত্মকথা”

নীল জোনাকি:

মাটির গর্তে বুক পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট পাপী মেয়েটি ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করে চলছিল, “আমি আর বলবো না… আমি আর বলবো না … আমাকে মাফ করে দাও … আমি আর বলবো না”।
সমাজকে নিষ্কলুষ আর পাপমুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর ধর্মপতিদের হাত থেকে তখন অবিরাম ছুটে আসছে পাথর, ছোট পাথর, বড় পাথর, গোল পাথর, এবড়ো-থেবড়ো পাথর, পাথরগুলো ছুটে যাচ্ছে মেয়েটার চোখ-মুখ-মাথা লক্ষ্য করে। একটা-দুটো বেয়াড়া পাথর অবশ্য টার্গেট মিস করছে, তাতে ছোট্ট পাপী মেয়েটির মরণক্ষণ সামান্য দীর্ঘায়িত হচ্ছে মাত্র।

কিন্তু কষ্ট হচ্ছে ধর্মরক্ষকদের। তাদেরকে আবার নিচু হয়ে নতুন পাথর তুলে মেয়েটার মুখ নিশানা করে সবেগে ছুঁড়ে মারতে হচ্ছে! কী যন্ত্রণা! মাত্র তের বছরের একটা মেয়ের মরতে এতো সময় লাগবে কেন?

আলজাজিরার খবর অনুযায়ী সোমালিয়াবাসি মেয়েটার নাম আয়েশা। পুরো নাম আয়েশা ইব্রাহীম দুহুলো। ধরেই নেয়া যায় মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া মেয়েটির নাম রাখা হয়েছিল আল্লার নবীর প্রিয়তম স্ত্রী আয়েশার নাম অনুসরণে। একদিন এই সোমালিয়াবাসী আয়েশা হেটে হেটে যাচ্ছিল মোগাদিসুর রাস্তা ধরে তার দাদী বা নানীর বাসায় । পথিমধ্যে তিনজন লোক তাকে জোরপূর্বক …

ওই ঘটনায় মেয়েটি সর্বস্ব হারিয়েছিল এটা বলা ভুল হবে। কারণ ওই ঘটনায় মেয়েটি জীবনটা তো আর হারায়নি। মেয়েটি আসলে সর্বস্ব হারিয়েছে তখনই, যখন সে এই ঘটনার নালিশ জানাতে গিয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে।
কর্তৃপক্ষেরই বা আর কী দোষ? তারা তো আইনের হাতে বন্দী।

মেয়েটা যেহেতু নিজেই স্বীকার করেছে, তার মানে এই অন্যায় কাজটা অবশ্যই ঘটেছে। এখন দায়ী ব্যক্তিকে বের করে শাস্তি দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু দায়ীটা কে? ঐ লোকগুলোই দায়ী, না-কী মেয়েটিই আসলে ঐ লোক তিনটাকে প্রলুব্ধ করেছিল?

শরিয়া আইনে এটা বের করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে, কাজেই এটা প্রমাণ করা কোনো সমস্যাই হলো না যে, মেয়েটিই আসলে দায়ী। তো কী আর করা? সমাজকে পাপমুক্ত রাখতে শেষ পযর্ন্ত কিসমায়ু শহরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসম্মুখে পাথর ছুঁড়ে মেরেই ফেলতে হলো মেয়েটিকে!

শরিয়া আইন:
মেয়েটা যেহেতু ইতোমধ্যেই মরে বেঁচে গিয়েছে, আসুন আমরা দ্রুত শুধু একবার জেনে নেই ঠিক কীভাবে তার দুশ্চরিত্র উদঘাটন করা হয়েছিল।
ইসলামে অবৈধ সম্পর্কের বিচার আর পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। কোরানের কোন আয়াতে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। মূলত: সহি বুখারী আর সহি মুসলিমের বেশ কিছু হাদিস থেকেই এই বিতর্কের উদ্ভব।

কিন্তু পাথর, রশি, বিদ্যুৎ না-কি ইঞ্জেকশন কোনটা কী কারণে মৃত্যুদণ্ডের জন্য ভালো, এই বিতর্ক এখানে জরুরি নয়।
আমাদের জানা প্রয়োজন, কিভাবে শরিয়া আইন আয়েশাকে দুশ্চরিত্রা প্রমাণ করলো।

শরিয়া আইনে অবৈধ শারীরক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগ প্রমাণের উপায় বলে দেয়া আছে। পাকিস্তানে ইসলামী আইন সমন্বিতকরণের জন্য ১৯৭৯ সনে যে অধ্যাদেশ জারী করা হয়েছিল তাতে শরিয়া আইনের এই ধারাটি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-
“Proof of zina liable to hadd shall be in one of the following forms, namely:-
(a) the accused makes before a Court of competent jurisdiction a confession of the commission of the offence; or
(b) at least four Muslim adult male witnesses… give evidence as eye-witnesses of the act of penetration necessary to the offence:
Provided that, if the accused is a non-Muslim, the eye-witnesses may be non-Muslims.”
(Article 8 of The Offence of Zina (Enforcement Of Hudood) Ordinance, 1979, Ordinance No. VII of 1979)

ধারা ৮(ক) অনুযায়ী আয়েশা স্বীকার করেছে যে, তার সাথে অন্য তিনজন ব্যক্তির অবৈধ এবং জোরপূর্বক সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু ধারা (খ) অনুযায়ী আয়েশা চারজন পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শী উপস্থিত করতে পারেনি, যারা প্রমাণ করবে যে এটা তার অমতে ঘটেছে এবং দায়ী আসলে ঐ তিন ধর্ষক। (চারজন সাক্ষী উপস্থিত রেখে তো কেউ ধর্ষণ করে না)।
তাহলে কী প্রমাণ হলো? আয়েশার অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে (স্বীকৃত), কিন্তু অন্য কেউ দায়ী নয় (যেহেতু অপ্রমাণিত)।
অতএব আয়েশা নিজেই দায়ী। জেনা-র শাস্তি পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড! আহ ধর্ম,বাহ ধর্ম!!

(আসুন সবাই শরিয়া আইনের পক্ষে আওয়াজ তুলি)

শেয়ার করুন: