শ্রাবণী এন্দ চৌধুরী:
আমার মা ছিলেন প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। মানসিক শক্তিও ছিলো প্রচুর। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা পটুয়াখালি ছিলাম। প্রায় নয় মাস সব সরকারি অফিসাররা নজরবন্দি ও গৃহবন্দি ছিলেন। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে বিরাট একটা মাঠ ছিলো। সেই মাঠের এক কোনায় সার্কিট হাউস ছিলো। সেখানে পাকিস্তানের আর্মিরা থাকতো। সারাক্ষণ ছাদে স্টেনগান তাক করে থাকতো, আর বায়নোকুলার দিয়ে আমাদের সবার বাড়ির উপর নজরদারি করতো।
নাদের শাহ বলে এক মেজর ছিলো ওখানে। খুব অত্যাচারি। প্রথম যখন এই পাকিস্তানি আর্মি এলো, তখন প্রচুর মানুষ মেরেছিলো। প্রতিদিন বিকেলে নিরীহ মানুষদের লাইন দিয়ে দাঁড় করে গুলি করে মারতো। পটুয়াখালিতে তিন-চার জন সরকারি অফিসার ছিলেন হিন্দু, তাদেরকে বলা হলো বাঁচতে হলে মুসলমান হতে হবে। নিজেরাই নাম ঠিক করে বললো এখন থেকে ওনাদের এই নামে ডাকতে হবে। সকাল হলেই মৌলভী পাঠাতো কোরান পড়াবার জন্য। প্রচণ্ড মানসিক অত্যাচার করেছে।
এর মধ্যেও আমার মা বলতেন বেঁচে থাকতে হবে, স্বাধীনতা দেখতে হবে। আমাকে সবসময় বলতেন, “আমাদের না মেরে তোর গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। আমরা না থাকলে তুই গায়ে আগুন লাগিয়ে দিস।” কেরোসিন আর দিয়াশলাই তো হাতের কাছেই রাখা ছিলো।
পটুয়াখালীতে মহিলা ভিক্ষুকরা ছিলেন মুক্তিযাদ্ধাদের ইনফর্মার। পাকিস্তানি আর্মির নাকের ডগা দিয়ে এঁরা বোরকা পরে আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমার মা সবসময় দুটো রুটি বেশি দিতেন, সব্জি দিতেন, চাল দিতেন। কখনো খুব বেশি দিতেন না। টুকটাক কথা হতো। মা কোনো খবর জানলে আস্তে করে বলে দিতেন। আমাদের পাশের ফ্লাটে যিনি থাকতেন, তিনি ছিলেন রাজাকার। আমরা জানতাম না। তিনি সব খবর দিতেন আর্মিকে। তিনি লিস্ট করেছিলেন সব কর্মকর্তাদের, যেন যাবার আগে আর্মিরা এঁদের মেরে যেতে পারে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলার কারণে পাকিস্তানি আর্মিদের আগেই পালাতে হয়। তাদের পুরো ব্যাটেলিয়নকে জাহাজসহ মাঝ নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। পাশের বাড়িতে থেকেও এই রাজাকার কর্মকর্তা বা তার পরিবার বুঝতে পারেনি এই মহিলা ভিক্ষুকদের ভূমিকা।
আমাদের বাড়ির উপরতলার ফ্ল্যাটে মেজর নাদের প্রতি রাতে মত্ত অবস্থায় আসতো। গাড়িটা রাখতো আমাদের বাড়ির পাশে। মাঝ রাতে যখন আসতো, আমি ঠক ঠক করে কাঁপতাম। ভাবতাম, এই বুঝি আমাদের দরজা ভেঙ্গে ঢুকলো! ওই ওপরতলার মহিলার বাবা, মা, ভাইবোন আটকে পড়েছিলেন বরিশালের বিখ্যাত আটঘর কুড়িয়ানা অঞ্চলে। আটঘর কুড়িয়ানাতে তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। খুব সম্ভব এই অঞ্চলটি হিন্দু প্রধান ছিলো। সেই মহিলা তখন ঠিক করলেন, মেজরকে দিয়ে তার বাবা-মাকে উদ্ধার করবেন। কবে আর্মি যাচ্ছে, সে কথাটি আমার মা জেনে ফেলেছিলেন এবং যথারীতি খবর পাচার করেছিলেন।
আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তৈরি ছিলেন, পাক আর্মিরা গ্রামের ধারে কাছে পৌঁছুতে পারেনি। খালি হাতে ফিরে আসে। কিছু মারাও যায়। তারপর ওনারা বলতে শুরু করলেন, আমরা নাকি ফোনে খবর দিয়েছি। আমাদের বাড়িতে তখন ফোন ছিলো। ২৫শে মার্চের পর বাবা লাইনটা ডিসকানেক্ট করিয়েছিলেন। মেজর আমার বাবাকে সার্কিট হাউস থেকে ডেকে পাঠায়। বাবা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন। কারণ যে সার্কিট হাউসে যায়, সে আর ফেরে না। আমার এখনও চোখের সামনে ভাসে, আমার বাবা হেঁটে যাচ্ছেন, আর আমি কাঁদতে কাঁদতে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে দেখছি বাবাকে। যতদূর দেখা যায়, আমি তাকিয়েছিলাম।
ভেবেছিলাম আর তো দেখবো না বাবাকে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, বাবা বেশ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন, সঙ্গে এক ক্যাপ্টেন। বাবাকে জেরা করে যখন কোনো খবর বের করতে পারেনি, তখন মেজর ওই ক্যাপ্টেনকে পাঠিয়েছে আমাদের বাড়িটা দেখবে, আর মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। মাকে ঘুরে-ফিরে এক প্রশ্ন, মা কার সাথে ফোনে কথা বলেন। মারও এক কথা, ফোন ডিসকানেক্টেড, কথা বলবো কার সাথে! এক পর্যায়ে মাকে বলছে, মেয়েকে ডাকুন। আমার বাবা, মা এবার ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, মেয়েকে কেন? ক্যাপ্টেন বলেছে, সে কথা বলতে চায়। আমার মা আমাকে একটা কোচকানো সুতির শাড়ী সাধারণভাবে পরিয়ে এনেছিলেন, আর বলেছিলেন, একদম জবুথবু হয়ে থাকতে।
আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, নাম কী? আমি বলেছিলাম, ‘শামিম’।
ইংরেজিতে কথা বলতে পারি কি না? আমি বলেছিলাম ‘না’।
জিজ্ঞেস করেছিলো, কী পড়ি? আমার উত্তর, পড়ি না।
পুরোটাই আমার বাবা বাংলায় বলে দিচ্ছিলেন আমাকে।
এরপর আর প্রশ্ন করেনি। আমি উঠে আসি।
তারপর আমাদের ফোনটা চেক করেছে সত্যিই ডিসকানেক্টেড কিনা!
এর কয়েক দিনের মধ্যে আবার গেছে আটঘর কুড়িয়ানায়। এবার আমার মা জানতে পারেননি। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। কেউ বাঁচেনি।
আজ আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেই মহিলাদের, যারা ভিক্ষা করার নামে খবর ও খাবার সংগ্রহ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি আমার মাসহ আরো অনেক মা’দের, যারা বিপদ মাথায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার পাঠিয়েছেন, খবর পাচার করেছেন। আমরা তোমাদের ভুলবো না।