মেয়েদের জীবন, হাজারও খানাখন্দের জীবন

রুমানা বিনতে রেজা:

নিম্মি আপুর মৃত্যুর ঘটনা আসলে আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল, এর কিছুদিন আগে পলার মৃত্যু। বলতে দ্বিধা নেই, দুইটা মাতৃত্বজনিত ঘটনাই আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করেছে।
প্রেগন্যান্সিকে যতোই ফিজিওলজিক্যাল প্রসেস বলা হোক না, মা হবার জন্য এই যে নিজের জীবন প্রায় বাজি রাখা, পুরোটাই একটা অনিশ্চিত যাত্রা!

কারো কোনো জটিলতা হয় না, কারো শুরু থেকেই নানা জটিলতা, কারো বা হয় প্রসবকালীন সমস্যা।
ভাগ্য বলে কিছু ব্যাপার তো আছেই, কিন্তু যে জিনিসগুলো আমাদের হাতে, সেটার ব্যাপারে কেন সচেতন হওয়া নয়?
এই যে আমাদের রাস্তা! হাজার গর্ত আর খানা খন্দে ভরা।

কর্মজীবী সবার জন্যই এই রাস্তাগুলো আতংক, কিন্তু এই রাস্তাগুলো কতটা প্রাণনাশী, সে শুধু থ্রেটেন এবোরশনের হবু মায়েরাই জানেন।
অথচ একটা সভ্য দেশের রাজধানীর রাস্তা আরেকটু মানবিক হবে, খুব কি বেশি চাওয়া?
প্রতিটা কর্মস্থলে হবু মায়েদের জন্য আলাদা একটা ওয়ার্ক-স্পেস তৈরি করে দেয়া কি খুব কঠিন কিছু?
শুধু তার টেবিলের কোনাগুলো একটু মসৃণ করে তৈরি করে, পা তুলে রাখার জন্য টেবিলের নিচে একটা টুল দিয়ে দিলেই কী সুন্দর একটা ওয়ার্কিং স্টেশন হয়ে যায়।

যে দেশের অফিস-আদালতে কর্মজীবী মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুম পাওয়াই অনেকখানে অকল্পনীয়, সেখানে বাথরুমে একটা কমোড চাওয়া হাস্যকর শোনায় হয় তো।
কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের একটা দেশ হয়ে যাচ্ছি আমরা, কর্মজীবী হবু মা একটা কমোড পাবেন না তার কর্মস্থলে, এটাই বরং খুব হাস্যকর শোনানো উচিৎ!

বাসে মহিলা সিট আছে, প্রতিবন্ধী সিট আছে। এই সিটগুলো যাদের প্রাপ্য, তাদের প্রতি কতটুকু মানবিক অন্যরা? কতজন গর্ভবতী মহিলাকে দেখলে সিট ছেড়ে দেবার মতো মানসিকতা রাখেন?

কাল বিএসএমকনে আমার সাথে থাকা এক হবু-মা সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে লেকচার শুনছিল, এতোগুলো ডাক্তার একজন-ও তাকে সিট ছেড়ে দিল না।
শেষে আমি এক পরিচিত ভাইকে খুঁজে পেয়ে তাঁকে অনুরোধ করতে বাধ্য হলেম (ভাইয়া অবশ্য সাথে সাথেই সিট ছেড়ে দিলেন), কিন্তু অন্যরা?
একজন গর্ভবতী নারী সহকর্মীর প্রতি কিছুটা সহযোগিতা যদি পুরুষ সহকর্মীরাই না করেন, তাহলে আসলেই গর্ভকালীন অবস্থায় দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে যায়।

এইজন্য যদি একজন পুরুষ সহকর্মী কবে তার স্ত্রী গর্ভবতী হবেন তবে তিনি বুঝবেন, সেই এমপেথির জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাহলে তো মুশকিল!
কর্মস্থলে নারী সিনিয়রদের একটা কমন যুক্তি থাকে, আমরা এই এই করেছি গর্ভবস্থায়, তোমরা কেন পারবা না?
এটাও খুবই অদ্ভুত কথা।

আমাদের আগের প্রজন্ম যেভাবে গৃহ-ম্যানেজমেন্টে পরিচারিকা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতা পেয়েছেন, স্বভাবতই অনুপরিবার ও অন্যান্য কারণে আজকাল হবু-মায়েরা অনেকেই সেই সুযোগ পান না।
পুরুষ সিনিয়রা যতটা না ‘অভিভাবক’, তার থেকেও অনেক বেশি ‘স্যার’; এই পার্থক্যটা ঘোচাতে পারেন এমন সিনিয়রের সংখ্যা খুবই কম।

রাষ্ট্র ছয়মাসের মাতৃত্বজনিত ছুটির ব্যবস্থা করেছে, তবে এর সাথে পরিবার পরিকল্পনাতেও কিছুটা অংশ নিয়েছে। মায়েদের এই ছুটি দুই বারের বেশি প্রযোজ্য নয়, আবার রেসিডেন্সি কোর্সে এই ছুটি আপনি নিতে পারবেন সর্বোচ্চ একবার! অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই ২৬ সপ্তাহের এই ছুটির পরে বিনা বেতনে ছুটি, কর্মঘন্টা ও বেতন কমিয়ে বিভিন্ন ছুটি নেয়ার বিধান হয়েছে।

নারী পুরুষের সমতার কথা বলে সরকার,অথচ বাচ্চার দায়িত্ব শুধু মা-কে দেয়া, কারণ পিতৃত্বকালীন কোনো ছুটির ব্যবস্থা এখনো রাষ্ট্র দিতে নারাজ! মাত্র ১৫ দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটির কথা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন করেছিলেন শুনেছিলাম, কিন্তু সে আইন এখনো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পাশ করালো না!!
রাষ্ট্র, কর্মস্থল, পরিবার থেকেও সব থেকে সচেতনতা বেশি দরকার মনে হয় হবু মায়েদের নিজেদের।

নিজের ফুলে উঠা পেট নিয়ে লজ্জা/সংকোচের কিছু নেই। বড় ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখে চোরের মতো ঘোরাফেরার কিছু নেই।
There is a baby in your womb and let the world see your pride.
আগে ছুটি দরকার হলে সেটিই নিয়ে নিন,গর্ভপরবর্তী সময়ে ছুটি নিবেন তাই প্রেগন্যান্সিকে ভালনারেবল করে ছুটি জমিয়ে রাখার দরকার নেই।
নিজের গলার স্বর উঁচু করুন, নিজের প্রয়োজন বুঝুন।

কর্মজীবীদের মায়েদের নিরাপদ মাতৃত্ব চাই।
মানবিক রাষ্ট্র চাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.