রীতা রায় মিঠু:
পত্রিকায় পড়লাম “উপবৃত্তির তালিকা থেকে হিন্দু শিক্ষার্থীদের বাদ!” শিরোনামের নীচে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। সংবাদ শুরু হয়েছে এভাবে,
“বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির তালিকায় বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গৌরনদী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওই তালিকা থেকে অধিকাংশ হিন্দু শিক্ষার্থীর নাম বাদ দিয়েছেন।”
আগেও বলেছি, একটি দেশ, একটি সমাজের উন্নতি জনগণের কোয়ান্টিটির উপর নির্ভর করে না, দেশ ও সমাজের উন্নতি নির্ভর করে জনগণের কোয়ালিটির উপর। যে দেশের অধিকাংশ জনগণ মানসিকভাবে যতো আলোকিত, সে দেশ ততো উন্নত। কিছুই আসে যায় না সে দেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চার ভাগের এক ভাগ হলেও।
বাংলাদেশও উন্নত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যেতো যদি ‘৭৫ পরবর্তী সরকারগণ ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হতে না দিত, জনগণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পরিবর্তে ভোট টানার কৌশল হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের চিন্তা চেতনায় সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ না ঢুকিয়ে দিত, দরিদ্র জনগণের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে, ধর্মভীরুতার সুযোগ নিয়ে ফ্রি থাকা খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কারিগরি শিক্ষাদানের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ না করতো।
পরিতাপের বিষয়, ‘৭৫ পরবর্তী সকল সরকার দেশের উন্ননতির কথা বলেছেন, কিন্তু কখনও উন্নতি চান নি। উন্নতি চাইলে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রতি উৎসাহ না দেখিয়ে জনগণের আধুনিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা, ছেলে মেয়ে সমান সুযোগ পাওয়ার ব্যবস্থা, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে নারী-পুরুষ উভয়কে সচেতন করা, শুধু ঘরের কর্মেই নয়, নারীদের বাইরের কাজে উদ্বুদ্ধ করা, জনগণের পেশা, আয় উন্নতির পথ নির্ণয়ে আগ্রহী হতেন।
দেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তীব্র আকারে বেড়েছে, আগে যা ঘটেনি এখন তাই ঘটছে। এই দেশেরই জনগণ, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সংখ্যায় গুরু বলে সংখ্যায় লঘুকে উৎপীড়ন করা হচ্ছে, ‘৭৫ পরবর্তী সকল সরকারের আমলেই তা ঘটছে। বর্তমান সরকারকে সংখ্যালঘুর বান্ধব সরকার বলা হয়ে থাকে। সেই সংখ্যালঘু বান্ধব সরকারের আমলে সংখ্যালঘুর উপর উৎপীড়ন, নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
দেশে নাকি আইটি সেক্টর খুব উন্নতি করছে। হ্যাঁ, খুবই উন্নতি হচ্ছে আইটি সেক্টরে। ফেসবুকে সকলের একসেস আছে, কোয়ান্টিটি জনগণ আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ না পেলেও আইটি সেক্টর মাতিয়ে রেখেছে অনলাইনে পর্ন ওয়েব সাইট খুলে, ফেসবুকে পরকীয়া করে, ফেসবুকে ধর্মের জোশ প্রচার করে, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর উন্নতি যেটা হয়েছে, কোয়ান্টিটি জনগণ ‘ফটোশপ’ করতে শিখেছে, ধর্ম প্রচার করতে শিখেছে, প্রতিদিন প্রতিবেলায় শত শত হুজুরের হিন্দু বিদ্বেষী ওয়াজের ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করতে শিখেছে, এইসব পোস্ট গরম গরম শেয়ার করতে শিখেছে আর শিখেছে ‘ধর্ম অবমাননা’ হয়ে গেলো বলে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি ব্যবসা বাণিজ্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে আগুন আগুন খেলা! আইটি সেক্টরের উন্নতির ঝাল যাচ্ছে সংখ্যালঘুদের উপর দিয়ে।
এই ফেসবুক, ইন্টারনেটের আগুনে মারা গেলো কতগুলো মেধাবী ব্লগার। ব্লগ হচ্ছে বুদ্ধি বিকাশ, বিদ্যা চর্চার সার্বজনীন মাধ্যম। ব্লগে যারা লিখেন তারা দেশের কোয়ালিটি পিপল। ব্লগ লেখা যার তার কর্ম নয়। ব্লগে লিখতে মেধা লাগে।ব্লগে সকলেই ভাল লিখে তা নয়। অনেক খারাপ, আপত্তিকর লেখাও ব্লগে লেখা হয়। ব্লগাররাও মানুষ, শুদ্ধ ভুল তাদের হতেই পারে। ভুল বা আপত্তিকর লেখার বিপরীতে প্রতিবাদ করা যায় পালটা লেখা দিয়ে। তাই বলে প্রাণে মেরে ফেলতে হবে? প্রাণে মেরে ফেললে যে দেশের কোয়ালিটি পিপলের সংখ্যা কমে যায়, তা কি সুধীজনেরা বুঝেন না? উন্নত আইটি সেক্টরের কর্ণধারেরা ইন্টারনেটের যথেচ্ছাচার রোধে কার্যকর কোন পক্ষেপ নিচ্ছেন না।
ক্রমাগত অন্যায়, অপরাধ সংঘটিত হয়েই চলেছে, কোন প্রতিকার নেই, কোন প্রতিবাদ নেই। সরকার থেকেও নয়, সরকারে আবার আসবে বলে যারা দশ হাত লম্বা জিভ বের করে রেখেছে তাদের থেকেও নয়। আইটি বিভাগ একদিকে পিছিয়ে আছে। দেশের যে উন্নতির ছবক দিয়ে চলেছেন রাজনীতিবিদগণ, তাঁদের মাথায় একটি বার্তা প্রেরণে ব্যর্থ হচ্ছে আইটি সেক্টর। বার্তাটি হচ্ছে, যে আগুনে পুড়ছে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, সেই আগুনেই পুড়বে দেশের উন্নতি।
এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মনে হয় আর সম্ভব নয়। কারণ দেশ এখন চলছে জনগণের কোয়ান্টিটির উপর, এত বিশাল কোয়ান্টিটির জনগণ থেকে কোয়ালিটি জনগণকে আলাদা করা সম্ভব নয়। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যে অভিযোগে এত এত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর ব্যবসা বাণিজ্য পোড়ানোর কথা বাদই দিলাম, শুধুতো ধর্মীয় জিগির নয়, কোয়ান্টিটি পিপল তো কোয়ালিটি পিপলদের কোণঠাসা করে ফেলছে! পাঠ্যক্রম থেকে হিন্দু লেখকদের মন কাড়া লেখা বাতিল করে দিয়েছেন বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রনালয়। মাদ্রাসার সরকারী অনুদান বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ পাবলিক স্কুল কলেজে সরকারী অনুদান বাড়ছেনা, স্বাভাবিকভাবেই পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকার লড়াই করতে গিয়ে পাঠদানে মনোযোগী হতে পারছে না।
পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে প্রাইভেট স্কুল, যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই ব্যয়বহুল। সাধারণ পরিবারের পিতামাতার পক্ষে কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় ছেলেমেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগানো।
এতো সমস্যার পরেও ছেলেমেয়েরা পাবলিক স্কুলে যাচ্ছে, নিজ আগ্রহে লেখাপড়া করছে, মেধা বিকাশ পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে সরকারী বৃত্তি লাভ করছে। বৃত্তির অল্প টাকা পাওয়া নয়,’সরকারী বৃত্তি’ লাভের কৃতিত্ব যাদের, তাদের বাহবা দিয়ে মেধা বিকাশে আরও উৎসাহ দিলে তবেতো আরও বেশি বেশি মেধার জন্ম হবে! যত বেশি মেধার বিকাশ হবে, কোয়ালিটি পিপলের সংখ্যা তত বাড়বে। কোয়ালিটি পিপল মানে মেধাবী জনগণ। মেধাবী জনগণের হিন্দু মুসলমান উপজাতি বলে আলাদা সম্প্রদায় থাকেনা, তারা মেধাবী, এটাই তাদের সম্প্রদায়।
অথচ আজকাল ছোট বয়স থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচিতির ট্যাগ দিয়ে বিভাজন করে দেয়া হচ্ছে! তাই যদি না হতো, তাহলে কেমন করে বরিশালের এক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ( সরকারী কর্মচারী) উপবৃত্তি তালিকা থেকে বেছে বেছে মেধাবী হিন্দু ছাত্র ছাত্রীদের নাম বাদ দেয়ার মতো হীন কাজ করতে পারলো! সরকারী কর্মকর্তা এই দুঃসাহস দেখায় কি করে? এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে? হবে না। কেউ আন্দাজই করতে পারছে না কিভাবে শিশু বয়স থেকেই শিশুমনে সাম্প্রদায়িক বিষের বীজ রোপন করে দেয়া হচ্ছে, কিভাবে শিশু বয়সেই বন্ধুর প্রতি বন্ধুকে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে! কিভাবে মেধার বিকাশ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে! কিভাবে কোয়ালিটি পিপল তৈরিতে বাধা দেয়া হচ্ছে! শুধু কোয়ান্টিটির জোরে কোয়ালিটির বিকাশ অংকুরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে তাহলে কোয়ালিটি পিপলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে?
তাই সরকারগণ মুখে যতই দেশের উন্নতির কথা বলুন, কোয়ান্টিটি জনগণ দিয়ে মাটি কোপানো যাবে, আরবদেশে শ্রমিক হিসেবে পাঠানো যাবে, মহিলাদের আরবে শেখদের বাড়ির ঝি হিসেবে পাঠানো যাবে, কিন্তু সোনার বাংলাদেশটাকে আলোকিত করা যাবে না।
আলোকিত বাংলাদেশ, উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে কোয়ান্টিটি পিপলের ভিড়েও একগুচ্ছ কোয়ালিটি পিপল থাকা প্রয়োজন। হিন্দু মুসলমান বিভেদে মানুষের কোয়ালিটি বিলো স্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায়। বিলো স্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটি পিপল দিয়ে ভোটে জেতার কৌশল বাতলানো যায়, দেশের উন্নতি করা যায় না। তাই তো বাংলাদেশে আজ কোয়ান্টিটির চাপে ধুঁকছে কোয়ালিটি!