মেনোপজে নারীকে বুঝতে শিখুন

এলমুন নাহার পপি:

আপনার সঙ্গী, অথবা খুব কাছের কোনো নারী, যার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি বা সবে পেরুলো; তার মেজাজের তোড়ে বাসায় টেকা দায়! কারণে-অকারণে তার চেঁচামেঁচিতে বাসার সবাই অতিষ্ট! অপ্রয়োজনেও কথা বলে যাচ্ছেন…, রান্নাঘরে ঢুকছেন দর দর করে মাথার ঘাম, মুখের ঘাম মুছছেন, আর পাখার নিচে বসছেন!
গরম, ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারছেন না!
রাতে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না!
সন্দেহপ্রবণতায় ভুগছেন!
বেশি পরিশ্রমের কাজ করতে গেলে মেজাজ চড়ে যাচ্ছে।

তার সব কিছু ভুল হয়ে যাচ্ছে…কোথায় কী রাখছেন মনে থাকছে না… যদি কেউ বলতে গেলো, অমনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন… একটু রাগ হয়ে কিছু বললেন.., কেঁদে কেটে সারাদিন হয়তো আপনার সাথে কথাই বলবে না, খাবে না, নিজেকে কষ্ট দেবে! সমস্ত ব্যস্ততা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে!

অথচ তিনি আগে এমন ছিলেন না!
কী করলে স্বাভাবিক আচরণ পাবেন বুঝতে পারছেন না!

প্রত্যেকটা নারীর জীবনে তিনটি সন্ধিক্ষণ আসে।
কৈশোরকাল, মধ্যবয়স, আর বৃদ্ধ বয়স- যখন শরীর আর কাজের উপযোগী থাকে না!
এখন তিনি মধ্যবয়স অর্থাৎ দ্বিতীয় সন্ধিক্ষণ পার করছেন…হঠাৎ করেই ওনার কিছু শারীরিক মানসিক পরিবর্তন ঘটছে।

তাঁর মনে হচ্ছে- বুড়িয়ে গেলেন; এখন পৃথিবীর সব রূপ রস গন্ধ ঠাশ্ ঠাশ্ করে মুখের উপর তাদের দরোজা বন্ধ করে দেবে … আর কিছুই নেবার নাই বোধ হয়…জীবনের হাসি আনন্দের সমাপ্তি!
তিনি অস্তিত্ব সংকটে ভূগছেন… তিনি মনে করছেন-এই জগৎ সংসারে তাঁর আর গুরুত্ব নেই, ভালোবাসা নেই!
শরীরের ভাষাটাও ঠিক ধরতে পারছেন না…সেটাও কষ্ট দিচ্ছে, অথচ কেও তাঁকে বুঝতে পারছে না…শুধু তার দোষ ধরছে…; এই পৃথিবীতে তার প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়ে এলো, তাই তাকে কেউ যথাযথ সম্মান দিচ্ছে না, খেয়াল রাখছে না, ভালোবাসছে না।

যখনই একা থাকেন-অতীতের কথা খুব মনে পড়ে।
শিশু বেলা- বাবা মা ভাই বোনের সাথের দিনগুলি!
শৈশব, কৈশোর, বিবাহ পরবর্তী…, সন্তান যখন ছোট ছিল সেই সময়ের আনন্দ, ব্যস্ততা, অপরিহার্যতা… হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি তাঁকে খুব কষ্ট দিচ্ছে!

মেজাজ শরীর কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে নাই… যা করবেন বলে ভাবেন প্রকাশ পাচ্ছে তার উল্টোটা… এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভুলে যাওয়া… এজন্য ঘরে, কাজের জায়গায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাজেহাল হতে হচ্ছে বৈকি…এসব কারণে তিনি নিজেই নিজের উপর যথেষ্ট বিরক্ত… তার উপর কেউ কিছু বললে আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন!

সঙ্গীকে বলছি-
এই পৃথিবীতে আপনি এবং পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউ তাকে ভালো রাখতে পারবে না!
একটু ধৈর্য ধরুন…আপনার চেয়ে কে বেশি তাঁকে চেনে, তাই আপনার মনোযোগই তিনি বেশি চাইছেন!
ভেবে নিন তিনি কৈশোরকাল পার করছেন!
তাঁর পক্ষ নিন… অন্যদের বুঝিয়ে বলুন!
হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন…প্রকাশ করুন সেই প্রথম জীবনের দিনগুলোর মতো!
তাকে মানসিক সমর্থন দিন, ভাল আচরণ করুন, তার ভাল সময়ে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন!
প্রাত্যাহিক কাজে সহায়তা করুন!

তাকে ছাড়া এই গৃহ- সংসার অচল প্রকাশ করুন! প্রত্যেক বয়সের আলাদা সৌন্দর্য, আলাদা গুরুত্ব আছে আপনি যেভাবে তাঁকে দেখেন, বলুন! আপনার ভালোবাসাটা তাঁকে সহজে বুঝতে দিন!
দোষারোপ করা একেবারে বন্ধ করুন!
ঘুরতে যাওয়া, বিশেষ দিনগুলোতে চমকে দেওয়া (উপহার, আয়োজনে), তার পছন্দের কিছু করা, এগুলো তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করবে! দেখবেন তিনি সহমর্মী সহনশীল আচরণ করছেন, ঠিক যেমন চাইছিলেন!
হাতের বাইরে চলে গেলে কাউন্সেলর, চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে, তখন দেরি করবেন না!

সন্তানকে বলছি-
রাগের জবাব রাগ দিয়ে নয়, দোষারোপ করে নয়; হাসি দিয়ে, নরম সুরে ছেলেমানুষি করে বলো যা বলতে চাও…
বাবা অথবা পরিবারের অন্য কেউ মায়ের উপর বিরক্ত হলে মায়ের পক্ষ নিয়ে তাদের বুঝিয়ে বলো।
মাকে নিয়ে তার পছন্দের জায়গায় ঘুরে এসো, পছন্দের কাজটি করো! মাকে যখন তখন জড়িয়ে ধরো! তাঁর সাথে মজার বিষয়গুলো শেয়ার করো!

একবার চোখ বন্ধ করে ভাবো মা কোথাও নাই…, পেয়ে যাবে মায়ের সাথে কেমন আচরণ করবে!
মাত্র ছয় মাস কী এক বছর, তারপর তিনি আবার আগের মতো হয়ে যাবেন!

সবার জীবন আনন্দময় হোক!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.