মুসকান ইউহানা:
সাল ২০০৯। কানাডা ফিরছি। বিশেষ কারণে ঐ রুটের এক বিমানবন্দরে আমাদের বিমান যাত্রাবিরতি নিয়েছে।
ভাবলাম একটু হেঁটে নিই।
আমার চোখ আটকে গেলো এক পুরুষের মুখে। সেই চেনা মুখ, কদর্য মুখ, জঘন্য মুখ। মেজর ইশতিয়াক।
একটা যুদ্ধ আমাকে কিছু পশুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। অথবা পশুদের সংস্পর্শে আমারও পশু নাম হয়েছিল। আমি, আমরা ছিলাম শিকার। ওই বুনোদের শিকার।
মেজর ইশতিয়াককে চিনতে আমার ভুল হয়নি। সেই আগের মতো ছোট ছোট চাপ দাড়ি, যা ১৯৭১ এ কালো ছিল এখন ২০০৯ এ ধবধবে সাদা।
আমি দৌড়ে গিয়ে এক সুঠাম দেহী পাকিস্তানী ভদ্র মহিলার পাশ থেকে মেজরকে ছিনিয়ে নিলাম।
চিৎকার করে বলতে থাকলাম
তুই ইশতিয়াক?
তুই মেজর ইশতিয়াক?
আমার বাচ্চা কই?
তোর জন্মের আমার ঐ বাচ্চা কই?
তুই আমাকে খুবলে খেয়েছিস, আমার বাচ্চা কই?
জানোয়ার আমাকে চিনে গেছে। হতভম্ব হয়ে আমার হাত থেকে জামার কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।
পাশের ভদ্রমহিলা এতোক্ষণে আমার দিকে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিচ্ছে —-
উনি আমার স্বামী, আপনার কী হয়েছে?
আপনার সাথে কী হয়েছে?
আপনি উনার সাথে এমন করছেন কেন?
আপনার বাচ্চা কে?
কোথায় আপনার বাচ্চা?
আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম,
আমার অতীত, আমার একাত্তর, আমার মা হওয়া, আমার হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কথা। এতোক্ষণে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। যা বলছি, কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
ইমিগ্রেশন পুলিশ চলে এসছে। আমি অনবরত কাঁদছি। আমি পুলিশকে শুধু বলতে পারলাম, আমার বাচ্চা হারিয়ে গেছে।
পুলিশ জানতে চাইলো কখন, কোথায়?
বললাম ১৯৭১ এ, বাংলাদেশে।
পুলিশ বললো, “মীমাংসিত বিষয়”। বলে তারা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।
ঐ পাকিস্তানী ভদ্রমহিলা আমাকে ছেড়ে দিলেন না।
বিমানবন্দরে আমাকে তার পাশের সিটে বসালেন। পানি খাওয়ালেন। ইংরেজিতে জানতে চাইলেন, আমার আসলে কী হয়েছে।
পানি খেয়ে আমি একটু স্থির বোধ করছিলাম।
খুব সংক্ষেপে বললাম, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
মেজর ইশতিয়াকের আমাকে পছন্দ হয়ে যায়। আমাকে আর হাত বদল হতে হয়নি। প্রায় সাত মাস আমি ইশতিয়াকের কব্জায় ছিলাম।
সে আমাকে প্রতিদিন কয়েকবার করে নিঃশেষিত করতো।
ঐ সাত মাস আমি একটা ঘরে তালাবদ্ধ ছিলাম। জানোয়ারটা সময় হলে হাত পেছন দিকে বেঁধে আমাকে নিয়ে যেত। পৈশাচিকতা শেষ হলে আবার সেই তালাবদ্ধ ঘরে এনে ফেলতো।
তখন আমি গর্ভবতী হয়ে যাই। তারপর থেকে প্রতিবাদ করতাম না। জবরদস্তিতে যদি আমার বাচ্চাটা মরে যায় সে ভয়ে।
দেশ স্বাধীন হয়েছে।
জানোয়াররা পালিয়ে গেছে। বদ্ধ ঘর থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয়েছে। একটা বাচ্চা জন্ম হয়েছে। জানা নেই আজ সে কোথায় আছে!
এর মধ্যেই জানলাম এই ভদ্রমহিলা মেজর ইশতিয়াকের স্ত্রী। লজ্জায় মুখ কালো হয়ে গেছে ঐ ভদ্রমহিলার। ঘৃণা নিয়ে জানালেন, সামনে দাঁড়ানো ইশতিয়াক পিচাশটা তার স্বামী।
মাইকে আমার নাম ঘোষণা করতে শুনে আমি বিমানের সিটে এসে বসলাম।
আমি হারিয়ে গেলাম আমার অতীতে। সেই একাত্তরে।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সব স্কুল কলেজ বন্ধ। আমার কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে এলাম। মে মাসের শেষের দিকে আমাদের গ্রামের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ঘাঁটি বসালো। এখান দিয়ে ভারতে যাতায়াত সহজ। মুক্তিরাও এই সহজ পথ বেছে নিয়েছে। তাই এ অঞ্চলের মুক্তি বাহিনীকে কাবু করতে আমাদের গ্রামটিকে পাকবাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলো।
পুরো গ্রাম কয়েকঘন্টার মধ্যে লোকশূন্য হয়ে গেল।
আমাকে আমার দাদির কাপড় পরিয়ে দেয়া হলো। মুখে চুলার ছাই মেখে দেয়া হলো। হাতে দাদির লাঠি ধরিয়ে দেয়া হলো।
এমন করে আমরা গ্রামের মসজিদের পাশে কোনরকমে সেই রাতটা পার করলাম। ঠিক হলো পরদিন আমরা আমাদের নানার গ্রামে চলে যাবো।
কখনো লাউয়ের মাচার নিচ দিয়ে কুঁজো হয়ে, কখনো হামাগুড়ি দিয়ে আমরা রাস্তা পার হচ্ছিলাম।
গ্রামের প্রবেশ এবং বেরুনোর পথে দেশী রাজাকার বাহিনী ও পাক বাহিনীর টহল ছিল। ওরা আমাদের আটকে দিল।
প্রত্যেকের ঘোমটা তুলে মুখ চেক করছিল।
আমার দেহের আভা কিছুতেই দাদির সাদা থানে এবং ছাইয়ে চাপা পড়ছিল না।
আমাদের চেয়ারম্যান চাচা যিনি, আমার বান্ধবীর বাবা, তিনি ঘোমটা খুলে আমাকে দেখে চমকে উঠলেন।
আমতা আমতা করে বললেন, বুড়ি মা!
ছাইড়া দেন!
পাকসেনারা বিশ্বাস করলো না। নিজে এসে আমার ঘোমটা এক ঝটকায় খুলে দিল। আমার চুলের মুঠি ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে থাকা কুঁজো আমাকে টেনে সোজা করলো। পিঠে বন্দুকের নাল দিয়ে আঘাত করতে শুরু করলো।
রাস্তার মধ্যে আমার পুরো থান টেনে খুলে ফেললো।
আমি লজ্জায় অপমানে ভয়ে হাত জড়ো করে কাঁপতে লাগলাম।
থানটা আমার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হলো। কোনো রকমে জড়িয়ে নিলাম।
একটা গাড়িতে আমাকে তোলা হলো।
সেখানেই আমার সাথে আমার পরিবারের যোগাযোগ শেষ হয়ে গেল।
একদল পাকিস্তানী গাড়িতেই আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খেল।
আমার ঠাঁই হলো আমারই প্রিয়প্রাঙ্গন আমার কলেজে। বন্দিনী হয়ে। যেখানে এসে রোজ স্বপ্ন দেখতাম অনেক বড় হবো, সেখানে কলংকিত ভবিষ্যতের অপেক্ষা করছি। একটা কক্ষে এনে রাখলো আমাকে। অনেকগুলো মেয়ে। প্রায় বাইশ তেইশজন। এর মধ্যে দুজন আমার ক্লাসমেট।
কাঁদার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু আতঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করছি এরপর কী হবে, তা জানতে।
রাত ঘনিয়ে এলো। দরজায় তালা খোলার শব্দ।
সারাদিনের না খাওয়া আমরা ভয়ে আরও গুটিয়ে গেলাম। আমাদের সবাই কে আজ এখানে আনা হয়েছে। এখানে আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে বুঝলাম।
দুজন পাক সেনা ঘরে ঢুকলো। অর্ডার করলো মেয়েদের গায়ের সব বস্ত্র খুলে ফেলতে। কেউ খুলতে চাইছে না। টেনে হিঁচড়ে সব কাপড় খুলে ফেলা হলো। লাইন করে ঘরের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো। সব মেয়েরা বিবস্ত্র। পেছনে হাত বাঁধা। আমিও উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের চোখ বাঁধেনি ওরা। লজ্জায় ভয়ে ঘৃণায় আমরা মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি।
এরপর আবার বুটের শব্দ। চমকে সবাই তাকালাম দরজার দিকে।
দেখলাম তিনজন পাক আর্মি আমাদের ঘরে এলো।
ওরা প্রত্যেকটা উলঙ্গ মেয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাত দিয়ে, চোখ দিয়ে, বন্দুকের নল দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মেয়েদের যৌবন পরীক্ষা করতে লাগল।অফিসাররা বেছে বেছে নিজেদের পছন্দের বন্দিনীদের নিয়ে নিল। বাকিরা খুব সম্ভবত সাধারণ সৈনিকদের ভাগে থাকতো।
গণধর্ষণ করে করে অর্ধমৃত হয়ে গেলে দু পা দুদিকে টেনে ধর্ষিতাকে শেষে মেরে ফেলতো। যোনিতে গুলি করেও মেরে ফেলতো।
এগুলো পরে জেনেছি।
আমাকে মেজর ইশতিয়াকের পছন্দ হয়েছিল। আমার দু বুক লাইনে দাঁড়ানো বিবস্ত্র অবস্থায় দুহাতে নেড়ে পরীক্ষা করে ঐ জানোয়ার বেছে নিয়েছিল।
সে সময় লজ্জায়, ঘৃৃণায় আমি কোথায় ছিলাম জানি না।
আমার ঠাঁই হলো আরেকটা ঘরে।
আমার বুকেও স্বামী স্বপ্ন ছিল। বিবস্ত্র অবস্থায়ই সে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা শেষ হলো ঐ ঘরে। ঐ দুজন সৈন্য এসে আমার চার হাত-পা টানা দিয়ে বেঁধে রেখে গেল তাদের অফিসারের ধর্ষণের সুবিধার্থে। একজন বুকে হাত বুলিয়ে আমার যৌনাঙ্গে হাত ছুঁইয়ে দরজা লাগিয়ে চলে গেল।
এরপর হয়ে গেলাম মেজর ইশতিয়াকের খোরাক। আমাকে নির্বাচনের সময়ই জেনেছিলাম ঐ পশুর নাম মেজর ইশতিয়াক।
সব শেষ হলো। তবু আমি বেঁচে রইলাম। মরার কোনো উপকরণ সেখানে থাকতো না। মাথার চুল ছেঁটে দেয়া হতো, বিবস্ত্র করে রাখা হতো যেন কাপড় দিয়ে কেউ ফাঁসি দিতে না পারে।
আমাকে ইংরেজিতে, উর্দুতে, আধো বাংলায় ক্যাম্পের মেয়েদের পরিণতির কথা মেজর শোনাতো। বলতো নির্জীব হয়ে গেলে সাধারণ সৈন্যদের গণধর্ষণ করতে দেয়া হয়, তারপর যোনিতে গুলি করে বা দু পা টেনে ধর্ষিতাকে ছিঁড়ে ফেলা হয়।
আমি যেন খাবার খাই। আমার যেন এ পরিণতি না হয়, আমাকে ঐ পিশাচের মনে ধরেছে।
আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম। গণধর্ষণের কথা মনে হলে আরও কুঁচকে যেতাম। খেয়ে নির্জীব হওয়া থেকে বাঁচতে হবে এটি মেনে নিলাম।
সে মাসেই অনুভব করলাম আমি অন্ত:সত্ত্বা।
ঘৃণায় কুঁকড়ে গেলাম। আমার মাঝে একটা পাপ বেড়ে উঠছে। সমস্ত ঘৃণা জমা করে এই পাপের অস্তিত্ব মুছে দিতে চাইতাম। থুতু দিতাম নিজের পেটে ওর অস্তিত্বে।
যখনই মনে হতো আমার মাঝে কোনো নরপিশাচের স্পর্শ বেড়ে উঠছে, তখনই নিজেকে শেষ করে দিতে চাইতাম। দিন যেতে লাগলো।
আমার ভিতরে বেড়ে ওঠা মানুষটা নিজের অস্তিত্ব আরও সুগভীর করে আমাকে জানাতে লাগলো।
প্রতিটা নড়াচড়ায় সে জানাতে লাগলো, মা আমি আছি। প্রবল ঘৃণার মাঝেও আমি একটা ভালবাসার আবহ পেয়ে গেলাম। শারীরিক জোরও ছিল না, জবরদস্তি ছেড়ে দিলাম। আমার মাঝে কেউ বেড়ে উঠছে এই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইলাম।
আমাকে মেজর দয়া করেছিল। আমার বাচ্চা সমেত পথে ফেলে দেয়নি। সেই ঘরটাতেই আমার আশ্রয় হয়েছিল ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত। পাশের ঘর থেকে রোজই শুনতাম নতুন নতুন বন্দিনীদের বিলাপ।
পুরনোদের হয়তো বিলাপ করার শক্তিই লোপ পেয়েছিল।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল। মেজর ইশতিয়াকরা পালিয়ে গেল। আমাদের মুক্তবাহিনী মুক্ত করে নিয়ে এলো।
মুক্তিবাহিনী মেয়েদের নিজ নিজ গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে এলো।
আমি বুঝলাম, জ্যান্ত আমি ফিরে আসার চেয়ে আমার লাশ ফিরে এলেই সবাই বেশী খুশি হতেন। পরিবারের অনেকেই পাকিস্তানীদের হাতে শহীদ হয়েছেন। প্রতিবেশীদের ঘরগুলোও অনেক ফাঁকা। অনেকেই শহীদ হয়েছেন।
কিছুই নেই, লাউ মাচা, কুমড়ো ক্ষেত, গরু ছাগল, হাঁস মুরগি কিচ্ছু নেই। আছে শুধু হাহাকার।
নতুন জীবনে এসে পড়লাম, চেনা জায়গা, অচেনা পরিবেশ। আতঙ্কিত প্রিয়জন, বিবর্ণ জীবন।
আমার পেটের সন্তানটা এখন কলঙ্কিত অধ্যায়ের প্রমাণ।
কেউ সহ্য করতে পারছে না পাকিস্তানী বীজকে। একে হত্যা করতে পারলেই যেন আমি এই সমাজের করুণা পাওয়ার যোগ্য হবো।
যুদ্ধ শেষে যখন বাড়ি ফিরি, তখন আমি প্রায় সাত মাসের অন্ত:সত্ত্বা। তবু বাবা ডাক্তারের কাছে জোর করে নিয়ে গেলেন যদি কোনভাবে বাচ্চাটাকে শেষ করা যায়! তখন এসব বাচ্চা হত্যা করতে বিদেশি ডাক্তারের দল এসেছিল। কেন যেন মনে হতে লাগলো, আমি স্বাধীন দেশের সমাজের চেয়ে ঐ পাকি ক্যাম্পে বাচ্চাটাকে বেশি নিরাপদে বড় করতে পেরেছিলাম।
ডাক্তার দেখে বললেন, বাচ্চার বয়স বেশি হয়ে গেছে এখন আর হত্যা করা সম্ভব না।
আমার বাবা আমার সন্তানকে হত্যা করতে না পারার কষ্ট নিয়ে ফিরে এলেন।
বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল এদেশে যুদ্ধ শিশু দত্তক নিতে এসেছে। এখবর আমার গ্রামে আমার বাবার কানেও পৌছে গেছে।
ক্যাম্পের চেয়েও উদ্বিগ্ন জীবন নিজের ঘরে কাটাতে লাগলাম ।
পেটে হাত দিয়ে সর্বক্ষণ আমার সন্তানের অস্তিত্ব অনুভব করতে চাইতাম। ভাবতাম সারাজীবন যদি এমন করে পেটেই সুরক্ষিত রাখতে পারতাম! স্বাধীন দেশের মাটিতে জন্ম হলেও আমার সন্তানের চারপাশে হায়েনার দল।
সে কিছুতেই তার মায়ের কোলে মায়ের সাথে জুড়ে থাকতে পারবে না। যেহেতু তার জন্মে কলঙ্ক তাই তার মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার নেই।
আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। কান্না শুনলাম। তারপর মুহূর্তে কান্না নেই হয়ে গেল। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। দরজার গিয়ে দেখলাম বাড়ির নিচ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটাতে একটা হারিকেন, একটা শিশুর কান্না আর একটা মানব রুপী দানবের মূর্তি বহুদুরে হারিয়ে যাচ্ছে।
ঐ যেন হারিকেনের আলো নয়, বর্বরতার স্তুপে জন্ম নেয়া মানবতার চিতার আগুন।
সে আগুন, সে আলো ভস্ম করলো আমার স্বপ্নকে, আমার অস্তিত্বকে, ন মাস ধরে আমার ভিতরে লালন করা পৈশাচিকতার ছোঁয়ায় গড়ে উঠা আমার ভালোবাসার ধনকে।
আমি জ্ঞান হারালাম।
সকালে বাবাকে প্রশ্ন করলাম, কোথায় আমার সন্তান?
বাবা নিরুত্তর।
আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামের এই সব যুদ্ধ শিশুদের মুক্তিযোদ্ধারা জেলা শহরে পৌঁছে দিত। সেখান থেকে বিভিন্ন ধাপে ওদের দাতাদেশগুলো দত্তক নিয়ে গেছে।
আমি আমার শিশুর কোনো খবর আর পাইনি। বেঁচে আছে না মরে গেছে!
সেদিনই বাড়ি ছেড়েছিলাম।
যেখানে আমার শিশুর থাকার অধিকার নেই, সেই সমাজে আমার থাকা চলে না। অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি আমার শিশুর কী পরিণতি হয়েছিল!
শুনেছিলাম আমার শিশুকে নাকি কানাডায় দত্তক দেয়া হয়েছে।
বিদেশি প্রতিনিধিদের অনেক অনুরোধ করে কানাডার একটা চাইল্ড হোমে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়েছিলাম যুদ্ধের পরপর সন্তান হারিয়েই।
যে সন্তানের মুখ দেখিনি, কোন সূত্র নেই নাড়ি কাটা এমন এক ধনকে আমি গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছি পৃথিবীর এ কোণ থেকে সে কোণে। পেটে থাকা ঐ ন মাসে আমি ওর গন্ধটা চিনে গেছি। পৃথিবীর বাতাসে আমি আজও আমার শিশুর গন্ধ খুঁজে বেড়াই।
পৈশাচিকতার ছোঁয়ায় জন্ম নেয়া আমার সন্তান আবার পৈশাচিকতার বলি হয়ে হারিয়ে গেল।
(লেখকের দাদীর মুখে শোনা এই গল্প। সত্য ঘটনা এটি। পরে কেউ আর সেই মায়ের খোঁজ পায়নি, সন্তানের খোঁজে হারিয়ে গিয়েছিল সে। এখানে কানাডা চলে যাওয়ার প্রসঙ্গটি নিতান্তই বানানো।)