‘রোকেয়া দিবস’: বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা

অনির্বাণ সরকার:

ছবিটি স্বামীসহ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের, জন্মের পর যার নাম ছিলো রোকেয়া খাতুন এবং পরবর্তীতে যিনি জনমানসে ‘বেগম রোকেয়া’ নামে বিখ্যাত হবেন।
৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়ার জন্মদিন, এটি তার প্রয়াণদিবসও। আমাদের দেশে এ দিনকে ‘রোকেয়া দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে, যে দিন নারীশিক্ষা এবং নারী অধিকার রক্ষায় অবদান রাখার জন্য ‘বেগম রোকেয়া পদক’ দেয়া হয়।

অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে জন্ম বেগম রোকেয়ার ১৮৮০ সালে। এ এমন এক সময়, যখন বাংলার মুসলিম সমাজ শিক্ষা ও ক্ষমতায় পিছিয়ে আছে হিন্দুসমাজের কাছ থেকে, কতকটা হিন্দু নেতা ও জমিদারদের প্রভাবে, কতকটা মুসলিম সমাজের নিজস্ব ঔদাসীন্যে। বেগম রোকেয়ার ক্ষয়িষ্ণু জমিদার পিতা শিশু রোকেয়া আর তার বোন করিমুন্নেসাকে আরবি ও উর্দু পড়াতে বাড়িতে শিক্ষক রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু নিষিদ্ধ ছিলো বাংলা আর ইংরেজি পড়া। এ এক অদ্ভুত ব্যবস্থা। মাতৃভাষা বাংলা, কিন্তু বাংলা শেখা যাবে না। তাতে চোট লাগবে আভিজাত্যে। বেগম রোকেয়ার বড় ভাই লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতেন বাংলা উপন্যাস, নাটকের বই, গোপনে পড়ে শোনাতেন বাংলা সাহিত্য আর রোকেয়াও বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে লুকিয়ে লুকিয়ে বাংলা বই পড়তেন।

১৮ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে রোকেয়ার বিয়ে হয়। এই ব্যক্তিটির কথা আলাদা ভাবে স্মরণযোগ্য এবং এঁর ছবি এ লেখায় দেয়ার কারণ একটিই- স্ত্রী রোকেয়াকে শিক্ষা ও লেখালেখিতে প্রেরণা দেবার প্রধান পুরুষ এই সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। স্বল্পায়ু এ ব্যক্তিটি সারাজীবন স্ত্রীর পাশে থেকেছেন, স্কুল বানানোর জন্য অর্থ দিয়েছেন, স্ত্রীর লেখালেখির সূচনায় উৎসাহ দিয়েছেন এবং নিজে ছিলেন প্রচারের আড়ালে।
১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল, যেটি ১৯৩০ সালে হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয়।

বেগম রোকেয়ার নামে বাংলাদেশে রংপুর বিভাগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। ৯ ডিসেম্বর জাতীয় পর্যায়ে রোকেয়া দিবসও পালিত হয়। সবই সত্যি, কিন্তু ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ এই মহিলাটির জীবন ও রচনার খণ্ডাংশ জেনেই তাকে মহীয়সী করে তোলার প্রবণতা অনেকের। বেগম রোকেয়ার সামগ্রিক জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানা ও জানানোই কাম্য।
বহু ‘নারীবাদী’ লেখার ছড়াছড়ি চারপাশে। এমন লেখা চিরকালই স্বাগত। কিন্তু বেগম রোকেয়া কতটা প্রাসঙ্গিক হতে পারেন এ সময়ে, তিনি যে চিন্তা ও চেতনায় কারও চেয়ে কম ছিলেন না, বরং ছিলেন এখনকার অনেক নারীবাদীদের চেয়ে বহুলাংশে বেশি আধুনিক- এই তথ্যগুলো প্রায়শই গোপন করে যাওয়া হয়। গোপন করে যাওয়া হয় তার রচনাগুলির প্রচার।

এর কারণ আছে। দিনে দিনে লেবাসে আধুনিক ও মননে ধর্মতান্ত্রিক হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মানুষ যদি মনোযোগ দিয়ে রোকেয়ার লেখাগুলি পড়েন, তবে চমক লাগবে।
ধর্ম, যেটি নারীর পায়ে শেকল পরানোর প্রধানতম হাতিয়ার,পুরুষতন্ত্র যে হাতিয়ারকে নারীর বিরুদ্ধে সচেতনভাবে ব্যবহার করে, সেটি নিয়ে বেগম রোকেয়ার লেখার মধ্যে কোনো রাখঢাক নেই।

‘আমাদের অবনতি’ নামের প্রবন্ধে তাঁর লেখা-
“যখনি কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছে, তখনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। … আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই তাঁহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।…আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশ জনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন , তিনি আপনাকে দেবতা কিংবা ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ।। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে সেরূপ পয়গম্বর দিগকে(অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেরিত মহোদয়া দিগকে) এবং দেবতা দিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায় !!
তবেই দেখিতেছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলো পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।
কেহ বলিতে পারেন তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন? তদুত্তরে বলিতে হইবে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম”।
ধর্মান্ধরা বেগম রোকেয়ার লেখার বিরুদ্ধে নানা সময়ে ষড়যন্ত্র করেছে, যেটি, রোকেয়াকে দমাতে পারেনি। রোকেয়া লিখছেন-
“আমি কারাসিয়াং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি,উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি।”

‘অবরোধবাসিনী’তে বেগম রোকেয়া স্মৃতিচারণ করছেন-
“অপরের কথা দূরে থাকুক। এখন নিজের কথা কিছু বলি। সবে মাত্র পাঁচ বৎসর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইত। ছাই, কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারও সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দা করিতে হইত।”
এই অবরোধ নিয়েই ‘পদ্মরাগ’-এ তাঁর নির্ভীক উচ্চারণ-
“আমি আজীবন… নারীজাতির কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ-প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব।”

এবং এই কথাগুলিও গুরুত্বপূর্ণ-
““পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্টেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জজ—সবই হইব। পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী ভাইসরয় হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে রানী করিয়া ফেলিব!! উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকর্মে ব্যায় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন?”

বেগম রোকেয়ার খণ্ডিত পরিচয় নিয়েই উচ্ছ্বাস বেশি, তাঁকে কেবল ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ বলেই চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু অবরোধপ্রথা ভেঙে ‘পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার তাঁর যে আহ্বান, সেটির কথা বলা হয় না। এই গোপনতার পেছনে দায়ী পুরুষতন্ত্র এবং অবশ্যই ধর্মতন্ত্র।
.
বেগম রোকেয়ার তিরোধানের প্রায় সাতাশি বছর পর এ অঞ্চলে নারীজাগরণের চিত্রটি কেমন? রাষ্ট্র, সমাজ, আইন কি নারীবান্ধব? যদি তাই হয়, হেফাজতের তেঁতুল হুজুর শফি কী করে মেয়েদের ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ানোর ফতোয়া দেয়? কী করে সে প্রকাশ্যে নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে? কেন দেশে ধর্ষণ বাড়ছে? কন্যাশিশুর ওপর যৌননিগ্রহ বাড়ছে? বিজ্ঞাপন ও সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কেন নারীশরীরের প্রদর্শনী? এই কি নারী জাগরণ? ধর্মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে বসে কোন্ সাহসে নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করে? কেন একজন তসলিমা নাসরিনকে যুগের পর যুগ নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করা হয়? এখানে কি নারী জাগরণের বিভ্রমে ডুবে আছি আমরা না উল্টোদিকে হাঁটছি?
আসলে নারীর নিজেরই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পুরুষকে সে সহায়ক শক্তি হিসেবে পাশে পেতে পারে, পুরুষতন্ত্র ও ধর্মতন্ত্রকে কখনোই নয়।

‘পদ্মরাগ’-এ বেগম রোকেয়া নারীকে তাই বলছেন-
“তুই জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হ! মুষ্ঠিমেয় অন্নের জন্য যাহাতে তোকে কোন দুরাচার পুরুষের গলগ্রহ না হইতে হয় আমি তোকে সেইরূপ শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া প্রস্তুত করিব। তোকে বাল-বিধবা কিংবা চিরকুমারীর ন্যায় জীবন-যাপন করিতে হইবে; তুই সেজন্য আপন পায়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়া।”

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.