জিনাত হাসিবা স্বর্ণা:
“আপনি নগরপ্রধান নন, এবং অবশ্যই আপনি নগরপিতা। এই মহানগরের অধিবাসী নগরপিতা হিসেবেই আপনাকে ভোট দিয়েছে। যে দায়িত্ববোধ নিয়ে একজন পিতা সন্তানের প্রত্যাশা পূরণ করে, সেই বোধ নিয়েই এই পদে আপনার কাজ করতে হবে। নিজেকে ‘নগরপ্রধান’ দাবি করে এই দায়বদ্ধতা থেকে পালিয়ে না বেঁচে ‘নগরপিতা’ হিসেবেই নিজের জায়গাটা করে নিন।”
– এই কথাগুলো মেয়রের প্রতি যিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, তাঁর ব্যাখ্যা, বাচনভঙ্গি এবং স্পষ্ট ভাষণে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। তিনি রুবানা হক, পরে জেনেছি তিনি আনিসুল হক এর সঙ্গীও বটে।
আনিসুল হক তখন সবে মেয়র পদে দায়িত্ব নিয়েছেন। ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয় নারী’ প্রচারণার এক অনুষ্ঠানে তাঁকে নগরপিতা হিসেবে সম্বোধন করে মঞ্চে ডাকায় তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তিনি ‘নগরপিতা’ শব্দের চেয়ে ‘নগরপ্রধান’ শব্দটিকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছেন। তাঁর বক্তব্যের শেষে দর্শক সারি থেকে প্রশ্ন বা মতামত আহ্বান করলে মেয়রকে ‘নগরপ্রধান’ বলে সম্বোধন করার অনুরোধের বিপরীতে রুবানা হক এই ভাষ্য তুলে ধরেন সেদিন।
পিতা শব্দটা নিয়ে তর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রুবানা হক এর কথায় একমত না হয়ে পারিনি, কারণ ‘প্রধান’ শব্দটা দায়িত্বকে ততোটা ঈঙ্গিত করে না, যতোটা করে ক্ষমতাকে। অন্যদিকে পিতা শব্দটিতে মায়া এবং দায়িত্ববোধ একই সাথে গাঁথা, ক্ষমতার দাপট ততটা নয়।
উপস্থাপক আনিসুল হককে ভীষণ পছন্দ হলেও, ব্যবসায়ী আনিসুল হকের রাজনৈতিক অবস্থান ‘সবুজ ঢাকা’র পক্ষে সৎ হবে, এমন আস্থা ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষমতার চর্চার যে ধরন, তার সাপেক্ষে কাজ তুলতে মেয়র হিসেবে তিনি দক্ষ হবেন, তাও মানতাম। এই যখন আমার অবস্থান, তখন রুবানা হক এর এই ভাষণ অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, নিজস্ব মতামত এবং অবস্থানে স্পষ্ট থাকা একজন নারীর সঙ্গ তাঁর জীবনে থাকাও নগরবাসীর জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হয়ে থাকলো।
আনিসুল হক এর মৃত্যুর পর একের পর এক নিউজ আসছে। সাতরাস্তা আবারও ট্রাকস্ট্যান্ড হয়ে ওঠার খবর দেখলাম। (আহা ক্ষমতা! এদেশের মানুষের ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ প্রিয়তা।) মেয়র নির্বাচনে সম্ভাব্যতার খবর দেখলাম। আনিসুল হক এর পরিবারকে মেয়র নির্বাচনের সম্ভাব্যতার আলোচনায় না টানার অনুরোধ দেখলাম রুবানা হকের পক্ষ থেকে। এই নিয়ে তর্ক বিতর্ক দেখলাম। তর্ক পরিবারতন্ত্র বিষয়ক।
রুবানা হক কী চায় না চায় তা বিবেচনা না করেই আমরা তর্কে মেতেছি মেয়র পদে তার যোগ্যতা নিয়ে। বেশ, জনগণ এবং মিডিয়া যা ভাবে, তা প্রাসঙ্গিক হয়েই ওঠে ক্রমে। এই লেখায় প্রসঙ্গের অবতারণা রুবানা হক এবং আনিসুল হক হলেও, প্রসঙ্গ তাঁরা নন। তাঁদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা প্রসঙ্গেও যাচ্ছি না, এসব তথ্য গুগলেই খুঁজে পাবেন কেউ আগ্রহী হলে। আমার প্রসঙ্গ নারী নেতৃত্বের একটা দিক, যেটা এর সাথে সংশ্লিষ্ট।
নেতৃত্বে নারীদের আসার বিষয়টা সরলরৈখিক নয়। নারীদের যেভাবে পায়ে পায়ে আটকানো হয় পরিবারে ও সমাজে, অন্যান্য ক্ষমতায়ন সম্ভব হলেও, নেতৃত্বে আসা তাদের পক্ষে বহুগুণ কঠিন। কারণ নেতৃত্ব রাত-দিন ২৪ ঘন্টা ঘরে-বাইরে সমানে দৌড়ানো কাজ। এটা করতে হলে হয় পরিবারকে ছাড়তে হবে, অথবা এই সমাজের চিত্রের বাইরের কোনো পরিবার পেতে হবে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদগুলোতে নারীর জন্য সংরক্ষিত পদ এর ব্যবস্থা তাই একদিক থেকে ভাবলে যেমন অপমানজনক, আবার ঢোক গিলে এগিয়ে যাওয়ারও।
আমার একটা ভীষণ অপ্রিয় প্রবাদ আছে- “প্রত্যেক সফল পুরুষের নেপথ্যে একজন নারীর অবদান আছে”। এটা অপ্রিয় হবার মূল কারণ হলো, এতে প্রথমতঃ নারীদের আড়ালে থাকতে উৎসাহিত করা হয়, দ্বিতীয়তঃ নিজের অবস্থান তৈরির বদলে স্বামী/বন্ধু/ভাই/বাবাদের অবস্থান পোক্ত করতে নারীকে উৎসাহিত করা হয়। ফলাফল দাঁড়ায়, যতো প্রতিভার অধিকারীই তিনি হো্ন না কেন, যতো পরিশ্রমই করুন না কেন- দিনশেষে পৃথিবী মনে রাখে সেই পুরুষদেরই।
সহায়ক পরিবেশ পেয়ে পেয়ে পুরুষরা নিজেদের জায়গাগুলি করে নেন ঠিকই, ভুলে যান এই সহায়ক পরিবেশটুকু তাঁরই পরিবারের নারীর ও প্রাপ্য ছিলো, প্রতিভা অনুসারে দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ পেলে এই নারীও তাঁর জায়গা তৈরি করে নিতে পারেন নিজেকে প্রমাণ করেই।
আবার আরেকটা দিকও আছে এই ব্যাপারটার। আমরা এই তথাকথিত চিত্রে এতোই অভ্যস্ত যে, নারী যতোই তাঁর যোগ্যতা বলে সবল অবস্থানে পৌঁছাক না কেন, তাঁকে আমরা দেখতে পাই না। আমরা তাঁকে কোনো পুরুষের পরিচয়েই দেখতে চাই, তাঁর যোগ্যতাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাই। এই চিত্রের বাইরেও যে কেউ থাকতে পারেন, তা আমরা মানতে চাই না।
প্রত্যেক মানুষেরই সহায়ক পরিবেশ দরকার হয় এগিয়ে যাওয়ার জন্য, যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তার আশপাশের মানুষ। আমাদের দেশের এখনও পর্যন্ত যা হালহকিকত, তাতে সাধারণত পুরুষেরা এই সঙ্গী পেয়েই এগিয়ে যান, আর নারীরা সঙ্গীর বৈরী অস্তিত্বের বিপরীতে যুদ্ধ করে কিংবা তাদের অনুপস্থিতিতে এগিয়ে যান। নারীর এই এগিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বের দাবি রাখে, সেটা পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে হোক, কিংবা শুধুমাত্র ‘পেছনে টেনে রাখা পুরুষের অনুপস্থিতির কারণে’ হোক।
রাজনীতি, নেতৃত্ব এবং নির্বাচন যতোটা না প্রতিভা আর দক্ষতা, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা আর ক্ষমতার চর্চা দাবি করে এসেছে। নারীর নীরবে কাজ করে যাওয়ার প্রবণতা, এবং নারীকে তার নিজের পরিচয়ে না দেখে পুরুষের পরিচয়ের ছায়ায় দেখার প্রবণতা, এবং জনপ্রিয়তা পেলেই নারীর ‘চরিত্রে’ কটাক্ষের চর্চা নারীকে বাঁধে এইসব অবস্থানে যেতে। এতো রকমের বাঁধা পেরিয়ে নেতৃত্বে আসা নারীর পক্ষে সার্বিকভাবে দ্রুত সম্ভব নয়।
যে যার অবস্থান থেকে এগিয়েই অন্যদের এগিয়ে যেতে উৎসাহ যোগাবে। কেউ অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থান থেকে এগোবে, কেউ অনেক বাঁধা পেরিয়ে উঠে আসবে স্বমহিমায়। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী নারী হওয়াটা সার্বিকভাবে নারী ক্ষমতায়নের উদাহরণ নয়, কেননা পরিবারে কোনো পুরুষের অস্তিত্ব থাকলে তাঁকে জনগণ এ পদে বিবেচনা করতো কিনা বলা মুশকিল, কিন্তু তিনি এই পদে এসে তাঁর যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নারীর পক্ষে দেশ পরিচালনার মতো কাজ মোটেও অসম্ভব নয়, এবং তা দক্ষতার সাথেই সম্ভব, এই উদাহরণ সৃষ্টি করে তিনি প্রেরণা হয়েছেন বহু প্রান্তিক কন্যাশিশুরও, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
আদর্শ রাষ্ট্রে নারী নেতৃত্বে যাবে যে কোনো অবস্থান থেকে উঠে এসে, কিন্তু সে পর্যন্ত ক্ষেত্রবিশেষে নারীর আত্মাভিমানকে এক পাশে সরিয়ে রাখতে হবে। কেউ উদাহরণ তৈরি করবে শুধু নারীর পক্ষে, হোক সে সুবিধাভোগী শ্রেণী থেকে আসা; কেউ উদাহরণ তৈরি করবে প্রান্তিক নারীর পক্ষে। কারণ এই দুই পক্ষ একজন আরেকজনকে শক্তি যোগাবে, একসাথে সার্বিকভাবে এগিয়ে নিবে নারী নেতৃত্বকে। নইলে সমতার অবস্থানের প্রতীক্ষা দীর্ঘায়িত হবে মাত্র।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বহুদিনের চর্চা। এটা ভাঙা জরুরি, তবু আমি ‘পুরুষের ভরসায় থাকেন না এমন নারীদের ক্ষেত্রে’ পরিবারতন্ত্রের সুযোগটাও হাতছাড়া করার পক্ষপাতি নই নারীর ক্ষ্মতায়নের প্রয়োজনে। এ সমাজ নারীকে ক্ষমতায় আর নেতৃত্বে দেখতে অভ্যস্ত নয়, অন্তত চোখে সওয়ানোর জন্যেও এটা জরুরি।
শুধু জাতীয় নয়, স্থানীয় সরকার পর্যায়েও কিন্তু পরিবারতন্ত্রের চর্চা আছে এবং এর অবসান কাম্য, তবে নারী প্রার্থীদের বেলায় আমাদেরে সতর্ক হওয়া উচিত যোগ্যতার খোঁজ রাখায়। পুরুষের টোকেন স্বরূপ নারী সে যেখান থেকেই আসুক বা যে পর্যায়েই কাজ করুক, কাম্য নয়। কিন্তু যোগ্য নারী্কে তার কাজের পথ সুগম করে দিতে দ্বিধা করা আমাদের পোষাবে না। যে যোগ্য, তার ‘নারী বলে’ সম্মুখীন হওয়া বাঁধাগুলির প্রভাব কাটাতে ‘পড়ে পাওয়া’ সুযোগগুলোকে আঁকড়ে ধরাই সমীচীন। এখানে অভিমান কিংবা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সুযোগ নেই।
৮ ডিসেম্বর ২০১৭