“প্রবাসে হিজড়া নয়, মানুষ হিসেবে পরিচিত আমি”

শাফিনেওয়াজ শিপু:

আমাকে ডাক্তার বলেছেন এখন থেকে প্রতিদিন ২০ মিনিট করে হাঁটতে। বাসার কাছের পার্কটা অনেক বড় হওয়াতে প্রতিদিনই এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে আমার এখন বের হতে হয় হাঁটতে। প্রথম দিন অনেক কষ্ট হয়েছিলো, কিন্তু এখন আর খারাপ লাগে না, কারণ একজন বান্ধবী পেয়ে গিয়েছি, যে কিনা প্রতিদিন বিকেল বেলায় এই পার্কে হাঁটতে আসে।

মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো হাঁটার দ্বিতীয় দিনে। তাকে দেখে মনে হয়েছিলো ইন্ডিয়ান, পরে পরিচয় হওয়ার পর জানতে পেলাম বাংলাদেশী। স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে এই দেশে অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে। মেয়েটি অনেক সুন্দর করে কথা বলে, যার কারণে পরিচয় হওয়ার প্রথম দিনই আমি তার কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বার বার সে শুধু তার স্বপ্নের কথা বলছিলো, সে নাকি অনেক বড় আশা ও স্বপ্ন নিয়ে এই দেশে এসেছে।

জিজ্ঞাসা করি, ‘তোমার সেই স্বপ্নটি কী?’

সে বললো, “মানুষ হিসেবে মরনের আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই। জানেন! পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে কখনও মানুষ হিসেবে সম্মান পাইনি, বরং প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হয়েছি। কেউ তো আমাকে বাবা-মায়ের দেওয়া নামে ডাকে না, বরং “হিজড়া” নামে পরিচিত। হিজড়া শব্দটি আমার কাছে গালি মনে হয়।

অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম সুইসাইড করতে, কিন্তু পারলাম না। শুধু মনে হচ্ছিলো, আমি তো ইচ্ছে করে হিজড়া হইনি, জন্মগতভাবে হয়েছি, সুতরাং আমার কোনো দোষ নেই। সৃষ্টিকর্তাই আমাকে এইভাবে বানিয়েছেন। জানেন, আগে নিজেকে ভিন্ন গ্রহের জীব মনে হতো, এখন নিজেকে মানুষ মনে হয়, তাও এই দেশে আসার পর। অনেকেই বাবা-মাকে বুদ্ধি দিয়েছেন আমার চিকিৎসা করাতে, কিন্তু তখন সময় পার হয়ে গিয়েছে। এটি আসলে শিশু থেকে পরিণত বয়সে যাওয়ার আগে চিকিৎসা করাতে হয়।

কী বলবো আপু আপনাকে, একটা সময়ে আমার বাবা -মাও চায় না, তার সন্তান তাদের সাথে থাকুক। প্রতিদিন বাবার অত্যাচারের শিকার হতে হয় আমার মাকে। শুধুমাত্র মা এর কথা চিন্তা করে আর আত্মীয়-স্বজনের কটু বা বাজে কথা এড়ানোর জন্য এই দেশে চলে আসলাম। প্রথমদিকে খুব ভয় কাজ করছিলো এইখানে এসেও যদি হিজড়া শব্দটি শুনতে হয়, তাহলে আমি কোথায় গিয়ে ঠাঁই নিবো?
কিন্তু এসে বুঝলাম, কে হিজড়া, কে সমকামী এগুলো কারোর পরিচয় নয় এই দেশে, এইখানে একটাই পরিচয় আমি মানুষ।”

আমি তখন বললাম, “তুমি তো অনেক ভাগ্যবতী। তোমার মতো আরও যারা আছে আমাদের দেশে, তারা তো অনেক অবহেলিত সমাজে। সমাজ তো তাদের বাঁচতে দিচ্ছে না। কেড়ে নিচ্ছে তাদের স্বপ্ন, আশা-ভরসা সব। গরীব ও মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণে তাদের স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেলো। কিন্তু তুমি আজকে ধনী পরিবারে জন্ম নেয়ায় আজকে এই দেশে আসতে পেরেছো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তোমার মতো তো সবার কপাল এক না।

হিজড়া মানে অভিশাপ, হিজড়াদের চেহারা দেখা বা স্পর্শ করা হারাম, এই ধরনের ধারণা ও কুসংস্কার আমাদের সবার মধ্যে। কিন্তু আমরা সবাই ভুলে যাই এরাও কিন্তু আমাদের মতো মানুষ। তারপরও তারা সমাজে মানুষ হিসেবে বাচঁতে পারছে না কুসংস্কার ও গোঁড়ামির কারণে। সবদিক দিয়েই এরা অবহেলিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত। তাছাড়া আমাদের দেশে হিজড়াদের জীবিকা নির্বাহ করে বাঁচার মতো ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই এবং সেই সাথে সরকারেরও কোনো উদ্যোগ নেই।

তবে এই দেশে কেউ তোমাকে “হিজড়া” নামে ডাকবে না, বরং তোমার একটাই পরিচয় হবে তুমি “মানুষ”। কেউ তোমার স্বপ্ন পূরণে বাঁধা দিবে না, বরং স্বপ্ন পূরণে সবাই তোমাকে সাহায্য করবে। কারণ এটি বাংলাদেশ নয়, এটি ইংল্যান্ড, যেখানে সকল শ্রেণির সবাইকে সমমর্যাদা ও পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.