শিক্ষকরা কেনো শিক্ষার্থীর ‘নাইটমেয়ার’ হবেন?

কামরুন নাহার রুমা:

আমার সাড়ে ১২ বছরের বান্টি (আমার ভাইয়ের ছেলে) অনেক কথা জমিয়ে রাখে; আমি গেলে বলবে বলে। আমার যাওয়াও হয় না, ওর কথাও শোনা হয় না। তবে গত ক’দিন আমি ওর সাথে থাকছি, অনেক লম্বা সময় ধরে গল্প করছি। ওর সাথে গল্প করতে গিয়েই অনেক বিষয় জেনেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। অনেক কথা ও হয়তো বলছে, কিন্তু ঠিক যেটা বোঝাতে চাইছে, সেটা বোঝাতে পারছে না; কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছি। ওর যেহেতু পরীক্ষা চলছে তাই স্কুল, পরীক্ষা এসব নিয়েই কথা হয় বেশি।

বান্টি’র স্কুলিংটা শুরু অস্ট্রেলিয়াতে; ওখানে ও সাত বছর ছিলো মা-বাবার সাথে। দেশে ফেরার পর ওকে দেশের একটা নামি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু ভর্তির ঠিক এক বছর পর ওকে ও বর্তমানে যে স্কুলে পড়ছে, সে স্কুলে নিয়ে আসা হয়। আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম যখন শুনেছিলাম যে, এতো ভালো একটা স্কুল থেকে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। সেদিন ওর মায়ের সাথে গল্প করতে গিয়ে আসল ঘটনা জানলাম।

নামকরা যে স্কুলটাতে ও পড়তো সেটা একসময় যেমন ছিলো, এখন আর তেমন নেই। আমার ভাবীর ভাষ্যমতে, প্রতি শনিবার রাতেই বান্টি স্কুলে না যাবার নানান বাহানা করতো, তার জ্বর আসতো। প্রথমে উনি বুঝতে পারেননি ঘটনা কী; কিন্তু পরে বান্টির কাছে সব শোনার পর উনি বুঝলেন, কেন ও স্কুলে যেতে চায় না। ঐ স্কুলের শিক্ষকদের আচরণ খুব বাজে পর্যায়ে চলে গেছে শিক্ষার্থীদের সাথে। লেখাপড়া হয় না আগের মতো। বিশেষ করে ফিমেল টিচাররা খুবই স্যাডিস্ট; শিক্ষার্থীদের মারধর করেন পান থেকে চুল খসলে। বান্টি বলছিলো, “জানো ফুপি, টিচার ডাস্টার ছুঁড়ে মারেন একটু কথা বললে বা পড়া না পারলে; চুল একটু বড় হয়ে গেলে চুল টেনে ধরে গালে জোরে চড় দেয়; আর কোনো কারণ ছাড়া অযথাই চিৎকার চেঁচামেচি করেন”।

শিক্ষকদের এই ধরনের আচরণ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে, স্কুলের প্রতি, লেখাপড়ার প্রতি তাদের ভালবাসা কমে গিয়ে ভীতির সঞ্চার করে, তারা স্কুলে যেতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম, আমাদের এমন একজন শিক্ষক ছিলেন, আমি তাঁর ক্লাশে ভয়ে সিটিয়ে থাকতাম। উনি কারণ ছাড়াই অবান্তর প্রশ্ন করতেন, আর জালি বেত দিয়ে পিটাতেন। ওনাকে আমি আমার পুরো জীবনে হাসতে দেখিনি – ছাত্রছাত্রী ছিলো ওনার কাছে মারধোরের সামগ্রী। আমি আসলে বান্টিকে এম্পাথাইজ করতে পারছিলাম।

ওই নামী স্কুলে ও যেতে চাইতো না, অথচ নতুন স্কুলে ও আনন্দের সাথে যায়। আমাকে ও ওর নতুন স্কুলের মিসদের গল্প করছিলো, ওনারা কতো দারুণ সেটা বলছিলো, এবং বলার সময় আমি ওর চোখে মুখে একধরনের আনন্দ দেখেছি। শিক্ষকরা তো এমনই হবেন যাতে শিক্ষার্থীরা তার ক্লাশে আসে আগ্রহ নিয়ে, স্কুলে যায় আনন্দের সাথে, পড়ালেখা শিখে নির্ভয়ে, সবার সাথে মিশে মন খুলে।

শিক্ষকরা কেনো এমন হবেন যে, তাঁর নাম শুনলেই শিক্ষার্থীর গায়ে জ্বর চলে আসবে? শিক্ষকরা কেনো এমন হবেন যে তাঁকে এক্সাম হলে দেখলে জানা উত্তরও ভুলে যাবে শিক্ষার্থী! শিক্ষক এমন হবেন যাকে দেখলে শিক্ষার্থী যে প্রশ্নের উত্তর ভালো করে জানে না, সেটাও উত্তরপত্রে লেখার তার আগ্রহ জাগবে; তাঁর সাথে সব অকপটে শেয়ার করা যাবে; তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটি মনে হবে। আমি এই কথাগুলো বলছি কারণ আমি জানি এমনটা হয়েছে, এমনটা হয়।

নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যে সব স্কুল তার সবগুলোতেই ফিমেল টিচার বেশি আর তার কারণটাও স্পষ্ট। নারীরা মা, বোন; তারা তাদের সন্তানের ভাইবোনের যত্ন নেন খুব নিবিড়ভাবে, আর তাই সন্তান সমান ছোটছোট ছাত্রছাত্রীদেরও তাঁরা সেই মমতায় স্কুলে শিক্ষাদান করবেন সেটাই স্বাভাবিক। মাধ্যমিক পর্যন্ত স্কুলগুলোতে মেল-ফিমেল সব শিক্ষকরাই আছেন কিন্তু তারপরও একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ফিমেল টিচারের সংখ্যাই বেশি, আর কারণটা ওই একই।

তো, মায়ের মতো শিক্ষিকারা যদি এতো স্যাডিস্ট হন, বাবার মতো শিক্ষকরা যদি যৌন হয়রানির কারণ হোন, তাহলে এই বাচ্চাগুলো কেনো স্কুলে যেতে চাইবে? মা-বাবারাই বা স্কুলে দেবেন কোন ভরসায়? বাচ্চাদের সামলানো তুলনামূলক কঠিন আর তাই স্কুল টিচারদের হতে হবে অনেক বেশি ধৈর্যশীল। বাচ্চারা ভুল করবে, মারামারি করবে, দুষ্টামি করবে, না বুঝে বেয়াদবি করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু, তাদের এই ব্যাপারগুলোকে শক্তহাতে নয়, কোমলভাবে বুঝিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। একজন শিক্ষকের ব্যাক্তিগত জীবন থাকবে, জীবন যন্ত্রণা থাকবে স্বাভাবিকভাবেই, কিন্তু সেইসব যন্ত্রণার প্রতিফলন যাতে পেশাগত জীবনে না ঘটে।

শিক্ষার্থীদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্কুলিং। তাই স্কুল শিক্ষকরা যদি কোয়ালিটি টিচিং না দেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে না তুলতে পারেন, ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়ালেখায় আনন্দ জাগিয়ে না তুলতে পারেন, পড়ালেখার প্রতি প্রেমটা জাগিয়ে তুলতে না পারেন, তাঁরা যদি ছাত্রছাত্রীদের ‘নাইট মেয়ারে’ পরিণত হোন, তবে শিক্ষার পরের ধাপগুলোতে শিক্ষার্থীরা যেতে আগ্রহ পাবে না।

আমি নিজেও একজন শিক্ষক, তাই বলবো স্কুল শিক্ষকদের হতে হবে অনেক বেশি ধৈর্যশীল, সহনশীল, স্নেহশীল, বন্ধুবৎসল এবং সেই সাথে অতি অবশ্যই কোয়ালিটি টিচিং এ পারদর্শী। কারণ স্কুল শিক্ষার ভিত যতো ভালো হবে, পরবর্তী শিক্ষাও একজন শিক্ষার্থীর ততো ভালো হবে। স্কুল টিচাররা যদি স্যাডিস্ট হোন, কোয়ালিটি টিচিং না দেন, তাহলে একজন শিক্ষার্থীর সব ধরনের ভিত নড়বড়ে থাকবে। না সে ভালো ছাত্র হবে, না সামাজিক হবে, না ভালো বন্ধু হতে শিখবে, আর না থাকবে তার মধ্যে নীতি-আদর্শ।

আমার মতে তাই স্কুল শিক্ষকদের দায়িত্ব শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের যে আচরণ বা শিক্ষার কোয়ালিটি দেখি, সেটা মূলত স্কুল শিক্ষার প্রতিফলন।

আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং তাদের শেখানোর কোয়ালিটি নিয়ে এমনিতেই নানান প্রশ্ন আছে। মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাশ ছেলেমেয়রা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন। তো তাদের কাছ থেকে আসলে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। ঘুষ দিয়ে যিনি শিক্ষকতার মতো পেশায় আসছেন তার কাছ থেকে নৈতিকতার শিক্ষা আশা করা, ভাল ম্যানার আশা করা, শিক্ষা আশা করা ভুল। এই জায়গাটায় আমাদের নজরদারির সময় এসেছে। এবং এই বিষয়টা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

অনেকে বেতনের কথা বলেন। স্কুল শিক্ষকদের বেতন কম তাই তারা কাজে উৎসাহ পান না। শিক্ষকরা কোচিং করিয়ে অনেক টাকা আয় করেন; বাড়ি-গাড়ি করেন, তাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের প্রতি আগ্রহ কম। কিন্তু মনে রাখতে হবে শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার মতো পেশা না, এটা একটা প্যাশন। আর এই প্যাশন থেকে যারা শিক্ষকতায় আসবেন, তাদেরকে শিক্ষাদানের ব্রত নিয়ে আসতে হবে, বেতনের সাথে কম্প্রোমাইজ করে আসতে হবে।

আমি শুধু একটা স্কুল উদাহরণ হিসেবে আনলাম; এমন অনেক স্কুল আমাদের দেশে আছে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা নিয়ত শিক্ষকের আক্রোশে পরিণত হচ্ছে নানানভাবে। এমনটা আমাদের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও হয়। একজন শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদ হলেন স্কুল শিক্ষকরা আর তাই তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। পৃথিবীর সব শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখেই আমি আমার এই কথাগুলো লিখলাম। কারো ভিন্ন বা আরও গভীর মতামত থাকতে পারে, আমি তাকে স্বাগত জানাই।

এরিস্টটল বলেছেন “Those who educate children well are more to be honored than they who produce them; for these only gave them life, those the art of living well” আর তাঁরই ছাত্র আলেকজান্ডার দি গ্রেট বলেছেন “I am indebted to my father for living, but to my teacher for living well”.

লেখক: সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.