নীপা লায়লা:
আজ বিউটি পার্লারে গিয়েছিলাম পা পরিষ্কার করতে। বিভিন্ন বয়সী অনেক মেয়েই এসেছে যার যার প্রয়োজন মেটাতে।এক সত্তরোর্ধ্ব নারীও এসেছেন ওনার হাত, পা, মুখ এবং চুলের বিউটিফিকেশনের জন্য। এতো ভালো লাগলো ওনাকে দেখে যে ভাষায় বর্ণনা করার নয়। মাথায় ওনার খুব বেশি চুল নেই, অথচ ভীষণ বোল্ডলি এসে বললেন, আমার চুলে হট অয়েল ম্যাসেজ করে শ্যাম্পু করে দাও। তারপর হেয়ার কালার করে দেবে।
আমি গরম পানিতে দুই পা ডুবিয়ে দিয়ে আমার মায়ের বয়সী এক নারীর নিজের রূপ সচেতনতা দেখি। মাথায় ওনার হট অয়েল ম্যাসেজ করার সময় উনি দুই চোখ আরামে বুঁজে রইলেন, আর বার বার করে বলছেন, সেই ভোর চারটায় ঘুম ভেঙেছে, তারপর সারাদিন আর ঘুম হয়নি। এখন আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। পার্লারের মেয়েটা বললো, আপনি ঘুমান আন্টি, আমি শ্যাম্পু করার আগে আপনাকে ডেকে তুলবো। উনি আরামে ঘুমিয়ে গেলেন। দুইজন মেয়ে ওনার হাত আর পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে, আর লিলিয়ান ওনার চুলে হট অয়েল ম্যাসেজ করছে।
মধ্যবয়সী আমি একটু দূরে গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে এক বার্ধক্যে পাওয়া নারীর বোল্ডনেস দেখে মুগ্ধতার সীমা ছাড়িয়ে যাই।
এর মাঝেই চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে এক বিশ-বাইশ বছরের মেয়ে ঢুকেই বললো, আন্টি আমাকে ফেসিয়াল করে দেন।জসিন্দা বলে উঠলো, তুমি মাত্র গত সপ্তাহে ফেসিয়াল করেছো, মনে আছে? এতো ছোটো মানুষ এতো ঘন ঘন ফেসিয়াল করা ঠিক না। মেয়েটা হেসে বললো, বিদেশ থেকে আমার হাজবেন্ড এসেছে গতকাল। সে বলেছে আমাকে আবার ফেসিয়াল করতে হবে। সে নিজেই আমাকে আজ নিয়ে এসেছে। ওয়েটিং রুমে বসে আছে সে।
অগত্যা জসিন্দা ফেসিয়াল করার ব্যবস্থা শুরু করতেই মেয়েটা বলে উঠলো, আন্টি, আমার হাজবেন্ড বলেছে, আমার মুখে আর হাতে পায়ে নাকি অনেক লোম, সেইগুলিও পরিষ্কার করে ফেলতে। এইগুলি পরিষ্কার করতে কি আমি খুব বেশী ব্যথা পাবো?
আমি গায়ে পড়েই বললাম, আপনি কি লেখাপড়া করেন?
মেয়েটা বললো, জ্বী আন্টি আমি অনার্স পড়ি।
বললাম, আপনি নিজে চান না আপনার এইসব হেয়ার রিমুভ করতে? ও বললো, না আন্টি আমার এইগুলি ভালো লাগে, কিন্তু আমার হাজবেন্ড পছন্দ করে না।
আপনার নিজের পছন্দ অপছন্দকে মূল্যায়ন করা উচিৎ নয় কি? একটু হতাশ হয়েই বললাম।
মেয়েটা এক গাল হাসি দিয়ে বললো, আন্টি আমার হাজবেন্ড বিদেশে থাকে। কতো সুন্দর সুন্দর মেয়েদের সে সারাক্ষণ দেখে, এখন আমি যদি তার পছন্দ অপছন্দ মেনে না চলি, তাহলে তো সে অন্যদিকে নজর দেয়া শুরু করবে। আর আন্টি বিয়ে হয়ে গেলে তো হাজবেন্ডের পছন্দেই প্রত্যেক মেয়ের চলা উচিৎ, তাই না বলেন?
উত্তর না দিয়েই আবার প্রশ্ন করলাম, কোথায় থাকে আপনার হাজবেন্ড?
… ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বললো মেয়েটা।
আচ্ছা, আপনি হাজবেন্ডের পছন্দ মতো গায়ের সব লোম রিমুভ করে আবার ফেসিয়াল করেন। অসুবিধা কী, স্কিনের কিছু হয়ে গেলে উনি তো আপনাকে বিদেশে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবেনই, তাই না? বলেই আমি নিজের পা ঘষাঘষির দিকে নজর দিলাম।
নির্লিপ্ত দুই চোখ মেলে দেখছি-কোল্ড ওয়েক্স দিয়ে রূপবতী মেয়েটির মুখের অবাঞ্ছিত হেয়ার রিমুভ করা হচ্ছে, আর প্রতি টানে টানে বারবার সে প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। ব্যথা যতো তীব্রই হোক না কেন, তার ফল অতি সুমিষ্ট, কারণ প্রবাসী স্বামীর চোখে আজ রূপবতী স্ত্রী নির্লোম অবস্থায় আরও অনেক বেশী আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
কেন যেন মুখের ভেতরটা একদম বিষের মতো তিতা হয়ে গেলো আমার।
একই পার্লারে তিন প্রজন্ম! একজন বৃদ্ধা নারী বোল্ডলি নিজের চুলহীন মাথা আর কুঁচকে যাওয়া মুখ এবং হাত পায়ের চামড়ার বিউটিফিকেশন করছেন, একজন মধ্যবয়সী নারী (আমি) নিজের প্রয়োজনে গরম পানিতে পা পরিষ্কার করছেন আর আক্ষরিক অর্থেই একজন রূপবতী তরুণী, প্রবাসী হাজবেন্ডকে খুশি করতে নিজের সারা শরীরের সব লোম রিমুভ করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পুনরায় ফেসিয়াল করে তার সারা শরীরের সৌন্দর্য বর্ধন করছে।
কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতি!!
যেন তিনটি কাল এক জায়গায় এসে খাবি খাচ্ছে।
কবে জাগবে আমাদের মেয়েরা? কবে নিজেকে একটু সম্মান করতে শিখবে?
মাথার ভেতরে এই দুই প্রশ্ন নিয়ে পার্লার থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখি ওয়েটিং রুমে শিং মাছের মতো কালো রঙের লিকলিকে এক ছেলে বসে বসে পেপার পড়ছে, আর অতি সুন্দরী স্ত্রীর আরও অধিক সুন্দরী হয়ে বেরিয়ে আসার প্রহর গুনছে।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝলাম, মুখের তিতা ভাবটা কমে তো নাই-ই, বরং হাজার গুণ বেড়ে গেছে।