টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অফ দ্যা ইয়ার’

নাসরীন শাপলা:

অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত টাইম ম্যাগাজিন তার ২০১৭ সালের ‘পারসন অফ দ্যা ইয়ার’ প্রকাশ করলো। এবারের কাভার ফটোর জন্য, একজন ব্যক্তির পরিবর্তে টাইম ম্যাগাজিন বেছে নিয়েছে একটি মুভমেন্টকে। টাইম ম্যাগাজিনের এবারের ক্যাপশন “সাইলেন্স ব্রেকার” আর কাভার পেজে স্থান করে নিয়েছে একদল নারী যারা অনেক ঝুঁকি নিয়ে, স্রোতের বিপরীতে যেয়ে,’সেকচুয়াল অ্যাসল্ট এবং হ্যারাসমেন্ট’-এর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন।

এই তালিকায় যেমন আছেন বিখ্যাত অভিনেত্রী এবং অ্যাকটিভিষ্ট অ্যাশলী জাড, কান্ট্রি সিংগার টেইলর সুইফট, তেমনি আছেন অনেক নাম না জানা নারী। এদের সকলেই তাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের দ্বারা সেকচুয়াল অ্যাসল্ট বা হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছেন। পরিস্থিতির চাপে অথবা নানা ভয়ভীতির মুখে এইসব নারী কোন অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছেন।

এই বছরের শেষের দিকে অ্যামেরিকায় একের পর এক স্রোতের মতো অভিযোগের আঙ্গুল উঠতে থাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের দিকে। এই তালিকায় আছেন অ্যামেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, অভিনেতা বিল কসবি, হলিউড প্রোডিউসার হার্ভি ওইয়াইনষ্টিন, অ্যামেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিঊ বুশ সিনিয়র, এনবিসি অ্যাংকর ম্যাট লাউয়ার, সিবিসি হোষ্ট চার্লি রোজ, অভিনেতা ক্যাভিন স্পেসী এবং আরো অনেকে। যারা এইসব প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তাদের অনেকেই এদের অধীনে কাজ করার সময় বা তাদের ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে সেকচুয়াল অ্যাসল্ট এবং হ্যারাসমেন্ট এর শিকার হয়েছেন। ফলে সহজেই অনুমেয় কেন তাদের এতো কষ্টের পরেও মুখ বন্ধ রাখতে হয়েছিলো।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে যখন কোন নারী বা পুরুষ সেকচুয়াল অ্যাসল্ট এবং হ্যারাসমেন্ট এর শিকার হন, তখন সেটা প্রমানের দায়ও তার উপরই বর্তায়। ফলে তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়ের কষ্টের ক্ষত আর অন্যায় প্রমানের দায় দুটোই একই সাথে হ্যান্ডেল করার মানসিক শক্তি সবার থাকেনা। আর সেই সুযোগে অন্যায়কারীরা খুব সহজেই পার পেয়ে যায়, নির্দ্বিধায় হাত বাড়ায় তাদের পরবর্তী শিকারের দিকে।

‘সাইলেন্স ব্রেকার’ এই মুভমেন্ট সমাজের এই অচলায়তন ভাঙ্গার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বছর। ফলে প্রায় প্রতিদিনই এখন বেড়িয়ে আসছে একের পর এক পতিত প্রভাবশালীর নাম। কেউ কেউ আইনের আওতায় আসছেন, কেউ কেউ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবুও আশার কথা, মানুষ (নারী পুরুষ উভয়ই) এখন আর নিজেকে অসহায় ভাবছেনা, নিজের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের জন্য নিজেকেই দায়ী ভাবছেনা, নিজেকে প্রমান করার জন্য দ্বারে দ্বারে ছুটছেনা-সমাজ তাদেরকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। চারিদিকে আলোচনা হচ্ছে। কিভাবে কাজের পরিবেশকে আরো সম্মানজনক এবং সবার জন্য গ্রহণযোগ্য করা যায় সেটা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

২০০৭ হলিউড অভিনেত্রী টারানা বার্ক # Me Too মুভমেন্ট শুরু করেন সেকচুয়াল অ্যাসল্ট এবং হ্যারাসমেন্ট এর স্বীকার সকল নারীদের নিয়ে। এই বছরের শেষের দিকে আরেক হলিউড অভিনেত্রী অ্যালিশা মিলান এই মুভমেন্টকে নিয়ে যান আরেক স্তরে। ফলে সারা বিশ্বে লাখো লাখো নারী এই আন্দোলনের সাথে তাদের একাত্ন্তা প্রকাশ করেন। প্রকৃতপক্ষে তখনই এই সমস্যার ভয়াবহতা সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। টাইম ম্যাগাজিনও অনেকটা এই আন্দোলনের দ্বারা উদবুদ্ধ হয়েই এবারের কাভার পেজের সিদ্ধান্ত নেয়।

কাভার পেজের বামে নিচের দিকে শুধুমাত্র অবয়ববিহীন একটি হাত ব্যবহার করা হয়েছে। এটি যেসব নারীরা সেকচুয়াল অ্যাসল্ট এবং হ্যারাসমেন্ট-এর শিকার হয়েছেন কিন্তু অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসার সাহস করেননি তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর ভিতরের পেজে একটি মেয়ের মুখ না দেখিয়ে পিছন থেকে তার ছবি দেয়া হয়েছে। এটি যেসব মেয়েরা তাদের পরিচয় গোপন রেখে অভিযোগ করেছেন তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে।

যদিও জানি যাত্রাপথের মাত্র শুরু, অনেকটা পথ এখনও হাঁটতে হবে সবাইকে। শুধু আশা, এই যাত্রায় বিশ্বাস নিয়ে, সম্মান নিয়ে অভিযোগকারীদের পাশে সবাই থাকবেন- সব্বাই।

ধন্যবাদ টাইম ম্যাগাজিন। অশেষ কৃতজ্ঞতা ‘সাইলেন্স ব্রেকার’ নারীদের প্রতি।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.