বৈশালী রহমান:
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের নতুন সংশোধনীটি আনার পর যারা “ধর্ষণের শিকার নারীর সাথে ধর্ষকের বিয়ে বন্ধ হলো” বলে সাধুবাদ দিচ্ছেন, তাঁদেরকে আমি বিনয়ের সাথে কিছু বিষয় ধরিয়ে দিতে চাই। আমার স্বল্প জ্ঞানে আমি যে বিষয়গুলো ধরতে পারলাম সেগুলো এরকম,
১. আইনটি নতুন কোনো আইন নয়। পূর্বের বিতর্কিত বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের একটি সংশোধনী মাত্র। পূর্বের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনটি বিতর্কিত ছিল এই কারণে যে, এটিতে “বিশেষ পরিস্থিতিতে সন্তানের মঙ্গলের জন্য ১৮ বছরের কম বয়সে কন্যা সন্তানদের বিবাহ দেওয়া যাবে” এরকম একটি ধারা ছিল। এর ফলে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষকের সাথেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। যার জন্য এই সংশোধনীটি আনা। সংশোধনীর মূল বিষয় হচ্ছে, “ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিবাহ দেওয়া যাবে না”। অর্থাৎ এখানে ধর্ষণের শিকার সব নারীর কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র অপ্রাপ্তবয়স্কদের কথা বলা হয়েছে।
এই সংশোধনী আনার ফলে আমরা হয়তো মনে করছি যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের আর ধর্ষকের ঘর করতে হবে না। কিন্তু বিষয়টা আসলে সেরকম নয়। লক্ষ্য করুন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিতে কিন্তু নিষেধ করা হয়নি। বিশেষ পরিস্থিতি বলতে কী বোঝায় সেটা যেহেতু এখনো সংজ্ঞায়িত নয়, কাজেই যেকোনো পরিস্থিতিকে বিশেষ পরিস্থিতি ঘোষণা করে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বা চল্লিশ বছরের দামড়া কিছু পুরুষ বিয়ের জন্য আজও চৌদ্দ-পনের-ষোল বছরের কচি ছুঁড়ির সন্ধান করে। এই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েগুলোকে যদি এসব পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়, তবে বিয়ের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের স্বামীর হাতেই ধর্ষণের শিকার হয়। অর্থাৎ বিয়েটা হয়তো ধর্ষকের সাথে হচ্ছে না, কিন্তু বিয়ের পরে যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার হাতেই ধর্ষণের আশংকা থেকে যাচ্ছে। ম্যারিটাল রেপের ভিক্টিম হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ধর্ষক স্বামী না হলেও স্বামী হতে পারে ধর্ষক, আর মেয়েটিও সারাজীবন এই ধর্ষকের সাথেই সংসার করতে বাধ্য হচ্ছে।
২. বাল্যবিবাহের একটা খুব বিপজ্জনক আফটার ইফেক্ট হচ্ছে অল্পবয়সে সন্তান ধারণের ফলে নারীর নিজের এবং সন্তানের উভয়েরই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে। এছাড়া বিয়ের পর যেহেতু নারীর ওপর সংসার এবং বাচ্চা উভয়ের দায়িত্বই প্রায় একতরফাভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাই তার পক্ষে পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভবপর হয় না। অনেক কিশোরীরই অল্পবয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে নারীশিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত সামাজিক সূচকের অবনতি ঘটে। নতুন সংশোধনীতে অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর ধর্ষকের সাথে বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, কিন্তু “বিশেষ পরিস্থিতিতে সন্তানের মঙ্গলের জন্য” বিয়ে দেওয়ার কালো ধারাটি বাতিল হয়েছে কি?
৩. দেশে যে শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীই ধর্ষণের শিকার হয়, তা নয়। প্রাপ্তবয়স্ক, মাঝবয়সী এবং বৃদ্ধ নারীও হয়। বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক ধর্ষণের শিকার নারীকে (যারা প্রাপ্তবয়স্ক) ধর্ষককে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়, যাতে ধর্ষক শাস্তি এড়াতে পারে। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ হয়েছে কি? অর্থাৎ কোনো বয়সের নারীকেই যেন ধর্ষককে বিয়ে করতে না হয়, ধর্ষক যেন তার অপরাধের শাস্তি না এড়াতে পারে, সেজন্যে কোনো আইন কারো চোখে পড়েছে কি?
কাজেই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়া বন্ধ করাটাই যথেষ্ট নয়। দেশে এমন আইন প্রয়োজন যাতে করে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের কোনো অবস্থাতেই জোর করে বিয়ে দেওয়া না যায়। সব নারী যেন শিক্ষা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। ধর্ষিতা প্রাপ্তবয়স্ক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক যাই হোক না কেন, ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে তার সম্পূর্ণ জীবনটাই যেন অবমাননাকর করে তোলা না হয়।
সাধুবাদটা না হয় সেদিনের জন্যেই তোলা থাক।