ফাহমি ইলা:
সোফিয়াকে ওড়না পরতে দেখে সবাই অবাক হয়েছেন, রাগান্বিত হয়েছেন, কেউ কেউ খুশিও হয়েছেন! গত ক’দিনে সামাজিক মাধ্যম একদম ভেসে যাচ্ছে এ আলোচনায়! অথচ আপনারা বুঝতে পারছেন না একটা রোবটের নাম যখন সোফিয়া, এবং সে আগে থেকেই একখানা জেন্ডার আইডেন্টিটি নিয়ে জন্ম নিয়ে এদেশে এসেছে তখন এদেশের নারীদের বস্ত্রই তার গায়ে থাকবে।
এখন সোফিয়া একখানা জামদানী শাড়ি পরলে যাদের ভালো লাগতো তাদের সাথে ওড়না পরানেওয়ালাদের পার্থক্য কই বুঝতেছি না! বরং প্রশ্ন করা উচিত- ‘নারীদের কেনো বাধ্যতামূলক ওড়না পরতে হয়?’/ ধর্ষণে কেনো পোশাকের দোষ হয়?’/ ‘ধর্ষক কিভাবে বিচার থেকে বেঁচে যায়?”মেয়েশিশুর বিকাশের পথে কেনো এতো কাঁটা?’‘নারীদের পুরো শরীরকে কেনো যৌনতার বিষয়বস্তু ভাবা হয়, যার জন্য ঢেকে রাখতে হয়?’’নারীর চুলেও কেনো যৌনতা?’ ‘নারী-পুরুষে কেনো এতো পার্থক্য?’ এমন বহু বহু প্রশ্ন করা জরুরি।
সোফিয়া ওড়না পরেছে ভালো কথা, হয়তো যেদেশে বিকিনির প্রচলন আছে, সেদেশে গেলে বিকিনিই পরবে! সো, ওড়নায় ক্ষতি কি বলো? নারীপুরুষের এতো এতো পার্থক্য না দেখে সোফিয়াকে নিয়ে মেতে আছে মাতামাতির জাতিগুষ্ঠি!
সোফিয়ার একটা জেন্ডার আইডেন্টিটি দরকার, কেননা পৃথিবীতে প্রায় সকল কিছুতে জেন্ডার আইডেন্টিটি বিরাজমান আছে, সোফিয়ার জাতিগত পরিচয়ও দরকার ছিল, দেওয়াও হয়েছে। সে এখন সৌদি নাগরিক।
আচ্ছা সোফিয়াকে একখানা ধর্ম কবে দেয়া হবে? এ মহাবিশ্বে আজ কেউ কি ধর্মহীন জন্ম নেয়? যাদের ধর্ম নাই, তাদেরতো আবার নাস্তিক বলে! সোফিয়ার ধর্ম নেই কেনো? সে কি নাস্তিক? আচ্ছা, সোফিয়ার গায়ের রঙ তো সাদা, ওর সৃষ্টিকর্তারা কি রেসিস্ট?
যারা রোবটের জেন্ডার আইডেন্টিটি দেয়া নিয়ে শঙ্কিত, তারা কী জানেন আপনার আশপাশে সকলকিছুর একটা জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে!
পোশাকে জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে- লুঙ্গি, জিন্স পুরুষের আর শাড়ি, কামিজ নারীর। এমনকি অন্তর্বাসেরও আলাদা জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে। আবার জিন্স নারী-পুরুষ পরে কিন্তু দু’রকম হয়।
প্রসাধনীর জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে। স্নো-পাউডার, সাবান, ক্রিম সবকিছুরই জেন্ডার আছে। এমনকি পুরুষের পারফিউম আর নারীর পারফিউম আলাদা যদিও উহারা একই কাজে ব্যবহৃত হয়।
গহনার জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে। নারীর গহনা আর পুরুষের গহনা আলাদা।
ব্যাগ, জুতা-মোজা, পার্টস, পানির বোতল থেকে শুরু করে সকল এক্সেসরিজের জেন্ডার আছে।
খাবারের জেন্ডার আছে যেমন মদ, গাঁজা, সিগারেট পুরুষের খাবার আর ফুচকা, আইসক্রিম নারীর খাবার।
স্বাদেরও জেন্ডার আছে। টক নারীর জন্য!
পেশার ও কাজের জেন্ডার আছে। পাবলিক বাসের ড্রাইভার, সিএনজি চালক, ভ্যানচালক পুরুষ হবে গৃহকর্মী নারী হবে। যদিও এখন দু একটা সেক্টর বাদে সকল জায়গায় নারী পুরুষের বিচরণ হয়েছে কিন্তু সেখানে এক্সেস পাওয়ার ক্ষেত্রে আবার ভিন্ন জিনিষ দেখতে হয়। ঘরের কাজ, বাচ্চা পালা নারীর কাজ আর শক্ত ভারী কাজ থেকে শুরু করে মেধার কাজ পুরুষের। এজন্যই গৃহিণী একপেশে নারীবাচক শব্দ আর বিজ্ঞানী কৃষক বললে আমাদের চোখে পুরুষের অবয়ব ফুটে ওঠে।
শিশুর খেলনায় জেন্ডার আছে। বারবি ডলটা মেয়েবাচ্চার জন্য, আর ব্যাট-বল, বন্দুক ছেলেটার জন্য। পুতুল যদি ছেলের হাতে ওঠেও সেটা সুপারম্যান ব্যাটম্যানের পুতুল!
খেলাধুলায় জেন্ডার আছে। কানামাছি, হাঁড়ি-পাতিল মেয়েরা খেলবে আর ফুটবল, ক্রিকেট ছেলেরা। এখন এ টেরিটরি ভেঙ্গে মেয়েরা বেরিয়ে এসে প্রমাণ করেছে কিছুই অসাধ্য নয়, অসাধ্য করে রাখা হয়! তবুও ক্রিকেটার, ফুটবলার বললে এখনো আমাদের পুরুষের চেহারা ভেসে ওঠে।
রঙের জেন্ডার আছে- গোলাপী নারীর, নীল পুরুষের।
আবেগেরও জেন্ডার আছে! হাসি-কান্না, রাগ-ক্ষোভ প্রকাশের ধরণের ক্ষেত্রে জেন্ডার আছে।
হাঁটাচলা, কথা বলা, বসা, দাঁড়ানো থেকে শুরু করে অঙ্গভঙ্গির জেন্ডার আছে। এমনকি নাচেরও জেন্ডার আছে। নারী নাচবে একভাবে, পুরুষ আরেকভাবে।
নামের জেন্ডার আইডেন্টিটি আছে। যেমন- সুর্য যদি হয় ছেলের নাম ওর থেকে নিঃসৃত ‘আলো’ মেয়ের নাম, চাঁদ মিয়া যদি হয় ছেলের নাম ‘জ্যোস্না’ তবে মেয়ের নাম। লতা নারীর নাম যে কী না একলা দাঁড়ায় থাকতে পারে না, কাউকে আশ্রয় করে জড়িয়ে ধরে বাঁচে! এমন বহু আছে!
ভাষায়, সম্বোধনে জেন্ডার আছে, এইটা তো আর ব্যাখ্যা করারই দরকার নাই!
আর যা যা আপনাদের মনে পড়ে সাথে যুক্ত করে নিতে পারেন। এই যে প্রতিটা পদে পদে জেন্ডার পরিচয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে এই সমাজ, সেগুলো নিয়ে কখনো চিন্তা করেছেন? যখন এর থেকে একটু এদিক-সেদিক বিচ্যুত হয়, তখনই মানুষের চোখে লাগে! ছোটবেলায় মাটিতে আসন গেঁড়ে বসলে নানী বলতো- ‘পা চাপাইয়া বস, পোলা গো মতো বইছস কেন!’ কিংবা ‘এইভাবে পোলাগো মতো দুমদুম কইরা হাঁটোস কেন? মেয়েরা এমন কইরা হাটে?’ অন্যদিকে ছেলে কাজিনটি পা চাপিয়ে বসলে শুনতে হতো-‘এটা এমন মাইয়া মানুষের মতো হইছে কেনো!’ এরকম বহু কথা অনেককেই শুনতে হয়, যারা তথাকথিত নারীসুলভ/পুরুষসুলভ আচরণটি করেন না।
এই পৃথিবীতে যে বিভেদ/বৈষম্য সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তা হলো নারী-পুরুষের বিভেদ। উঁচু থেকে নিচু সকল শ্রেণী, বর্ণ, জাতিতে আপনি নারী-পুরুষের বিভেদ দেখতে পাবেন, যেটা প্রাকৃতিক না এবং সেটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। সেই বিভেদ বা পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে নারীকে শোষণ করা হচ্ছে হাজার বছর ধরে। অথচ এ বিভেদ টিকিয়ে রেখে কোনদিন শ্রেণীহীন সমাজ আনা সম্ভব না। এটুকু বললে সব মৌলবাদী, প্রগতিশীল, ডান-বাম-ওপর-নিচ-কোনাকাঞ্চি ঘ্যাট ঘ্যাট করে দৌড়ে আসবে গালিগালাজ করবার জন্য! কিন্তু এটাই ফ্যাক্ট, এটাই সত্যি!
আপনারা সোফিয়াকে দেখে অবাক হয়েছেন আর আমি অবাক হয়েছি আপনাদের দেখে। এই যে প্রতিটা বিষয়ে নারী-পুরুষের পার্থক্য করে দেয়া হলো, এইগুলো নিয়ে জাতির মাথাব্যথা নাই, জাতির মাথাব্যথা সোফিয়ার ওড়না পরা নিয়ে?
সবকিছুর জেন্ডার পরিচয় বানানো হলে সোফিয়ার থাকবে না কেনো? সোফিয়া লিপস্টিক দেবে, সোফিয়া ব্রা পরবে, সোফিয়া মাথায় কাপড় দেবে, সোফিয়া মেপে মেপে নারীসুলভ হাসবে কাঁদবে হাঁটবে। ভুলে গেলে চলবে না, সোফিয়া একজন নারী(রোবট), একদম ভুলে গেলে চলবে না!