তনয়া দেওয়ান:
চাকমা ভাষায় একটা কথা খুবই প্রচলিত, দেওয়ান মানে এমান! এমান অর্থ পশু বা জন্তু! আমিও “দেওয়ান” টাইটেলধারী “এমান”। কারণ আমার নাম- “তনয়া দেওয়ান”। “তনয়া” নামটা বাবার দেওয়া আর “দেওয়ান”টা টাইটেল। বাবার বংশের দাদা-দাদী থেকে শুরু করে মায়ের বংশের নানা-নানী সবাই “দেওয়ান” টাইটেলধারী।
ইতিহাসে আছে এবং লোকমুখে প্রচলিত চাকমাদের মধ্যে রায়, দেওয়ান, তালুকদার, খীসা টাইটেল ধারীরা নাকি একটু উচ্চ বংশের! তবে এটাতে আমার বেশ সন্দেহ আছে! কারণ সারাজীবন ঘেটেঘুটে কোনভাবেই বের করতে পারি নাই কোন দিক থেকে এরা উন্নত প্রজাতির!!! যতদূর জানি এরা ছিল অত্যাচারী, অনেকটা স্বৈরাচারী এবং মানবতা বর্জিত প্রানী। যাদের মনে মানবতার প্রেম বাস করে না, তারা কিভাবে উন্নত প্রজাতির হয়!!! যাইহোক, এদের চরিত্র খন্ডন করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
ছোটবেলা থেকেই তো টাইটেল নিয়ে এই এক কুৎসিত প্রথার উপস্থিতি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। স্কুলে একদিন “সাজেদা” নামের এক বান্ধবীর সাথে আলাপকালে অনেকটা উচু্ঁ গলায় বললো, “জানিস, আমি কিন্তু সৈয়দ বংশের মেয়ে!” আর অন্য আরেকদিনের ঘটনা হলো, “ব্যানার্জি” টাইটেলের এক বান্ধবীর দিকে ইঙ্গিত দিয়ে এক হিন্দু “নাথ” টাইটেলধারী বান্ধবীর মন্তব্য, “ও তো ব্রাহ্মণ, উচুঁ বংশের! আমাদের সাথে তো এদের যায় না।”
যে টাইটেল মানুষে মানুষে এতো জাত-বিজাত ভাগ করে, সেই টাইটেলের কী প্রয়োজন!
সেই পিচ্চি মফস্বল শহরের মেয়েটা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে আবিষ্কার করলো, টাইটেল শুধু জাত-বিজাত নয়, উঁচু বংশের-নিচু বংশের নয়, কে কোন ধর্মের সেটাও বলে দেয়! শুধু টাইটেল কেন, এখনকার মানুষের নামও বলে দেয় কে কোন ধর্মের! অথচ নামকরণ করার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র প্রত্যেকটা মানুষকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা। সেই নাম দিয়েই এখন মানুষে মানুষে কত বিভেদ!
যেমন, “হিমাংশু” কী সুন্দর একটা বাংলা নাম, কিন্তু কোনো একজন মুসলিমকে জিজ্ঞ্যেস করেন, সে বলবে আরে এটা তো হিন্দু নাম, আবার “শাহরিয়ার” নামটা যদি কোনো এক হিন্দু বা বৌদ্ধকে রাখতে বলেন- সে বলবে, এটা তো মুসলিমদের নাম! আবার একইভাবে যদি “ক্রিস্টিনা” বা “জন” নামের কারো নাম শোনার সাথে সাথেই আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে করে নিবেন- এ লোক খ্রিষ্টান!
অর্থাৎ পৌরাণিক বা প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত কোনো নাম মানেই হিন্দু নাম, আরবি টাইপ নাম মানেই মুসলিম আর ইংলিশ কোনো নাম মানেই খ্রিষ্টান!
কেন? হিন্দুরা আরবি টাইপ নাম রাখলে বা মুসলিমরা পৌরাণিক, প্রকৃতিগত নাম রাখলে বা খ্রিষ্টান ছাড়া অন্যরা ইংলিশ টাইপ নাম রাখলে তাতে সমস্যা কী? তাতে কি জাত যাবে?
আচ্ছা, “জান্নাতুল বা পূজা” এই টাইপ নাম রাখলেই কি পরকালে “বেহেশত” বা “স্বর্গ” নিশ্চিত হয়ে যাবে? তাহলে কি ইহজন্মের কর্মের কি কোনো দরকার নেই? যদি তা না হয় তাহলে কেন এতো নাম বিভ্রাট? এই নাম-টাইটেল যদি মানুষে মানুষে এতো শ্রেণী-বিভেদ এনে দেয় তাহলে এই ধর্ম কেন্দ্রিক নামটারই বা কি দরকার! নামের শেষে এই টাইটেলটারই বা কী প্রয়োজন!
আবার অন্যদিকে দেখুন তো, আমরা যখন কোন মুসলিম বন্ধুর বাসায় যাই, তখন মুসলিম বন্ধুটির মা বাবাকে “আস্সালামু-ওয়ালাইকুম” বলে সালাম দেই, আবার অন্যদিকে যখন কোন হিন্দু ভাইয়ের দোকানে যাই বা কোন হিন্দু বন্ধুর বাড়ি, তখন “নমষ্কার” বলে সালাম দিই। “আস্সালামু-ওয়ালাইকুম” বা “নমষ্কার” দুটোতেই কিন্তু শ্রদ্ধাপূর্ণ সৌজন্যতা বিদ্যমান। আবার বেশি সৌজন্যতা কিন্তু ভালো নয়, জানেন তো, “অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ!”
মোট কথা হচ্ছে, আপনি যদি “আস্সালামু-ওয়ালাইকুম” এ অভ্যস্ত হোন, তাহলে তাই বলুন, এতে কী সমস্যা? আবার আপনি যদি “নমষ্কার” এ অভ্যস্ত হোন, তাহলে তাই বলুন, এতেও তো কারো কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। আপনি মুসলিম হলে “নমষ্কার” বলতে পারবেন না, আবার হিন্দু বা বৌদ্ধ হলে “আস্সালমু-ওয়ালাইকুম” বলতে পারবেন না, এমন তো কোন নিয়ম নেই, তাই না?
আমি যেহেতু পাহাড়ি, তাই আরেকটি চিত্রও প্রায় চোখে পড়ে, পাহাড়ে ঘুরতে এলে আল্ট্রা মডার্ন সব ছেলমেয়েই পাহাড়িদের সাথে কথা বলার সময় “দাদা-দিদি” বলে সম্বোধন করে! আর ঢাকা শহরে দেখা হলে সেই দাদা-দিদিরাই “ভাইয়া-আপু” হয়ে যায়!
অসাম্প্রদায়িক বলে মুখে ফেনা তোলা এই আমরাই তো বড় সাম্প্রদায়িকতার শুরুটা করি নিজের নাম-টাইটেল আর আমাদের আচার-ব্যবহার দিয়ে।
“শোনো হে মানুষ ভাই- সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”
চন্ডিদাসের এই কথাটা কি আমরা একবারও উপলব্ধি করতে পারি নাই?
যেখানে গোড়াতেই গলদ সেখানে আমরা দিনশেষে কোন ধরনের উৎকৃষ্টমানের ফল আশা করি?
এই প্রশ্নটা নিজেকে কখনো কি করেছি আমরা?