প্রতিভা রানী:
সব বাবা মায়েরাই স্বপ্ন দেখেন অনাগত সন্তানকে নিয়ে। জন্মের আগেই তাকে নিয়ে জল্পনা কল্পনা করেন। কিন্তু জন্মের পর যদি দেখেন সন্তান কালো বা শ্যামলা রং নিয়ে জন্ম নিয়েছে, তাহলেই পরিবারের সবার মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে যায়। বেচারী মায়ের তখন যে কী অবস্থা হয়, সেটা বোধ হয় অনেকেই আন্দাজ করতে পেরেছেন। আর যদি হয় মেয়ে শিশু, তাহলেই হয়েছে। যেন বিশাল একটা অপরাধ করে ফেলেছে কালো সন্তানের জন্ম দিয়ে। অনেকটা এরকম মনে হয় যেন বাবা মা কোনো গুরুতর অপরাধ করেছেন, যা কিনা অনেক সময় সন্তানের প্রতি অবহেলা তৈরি করে। যার প্রভাব ওই কোমলমতি শিশুটার উপর পরে। ছোটবেলা থেকেই সে এক ধরনের অাত্মগ্লানিতে ভুগে। এক ধরনের হতাশা অপরাধবোধ কাজ করে, যা শিশুর মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধির জন্য হুমকিস্বরূপ। এক পর্যায়ে সে কোণঠাসা হয়ে পরে।
যার শিকার কমবেশি আমিও হয়েছি। জিনগত ও আবহাওয়াজনিত কারণে আমার গায়ের রং শ্যামলা মতান্তরে কালো। ছোটবেলা থেকেই এটা শুনে বড় হয়েছি যে, তোমাকে বিয়ে দিতে হলে তো অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, যদিও আমার বাবা-মা কোনদিনও মুখ ফুটে একথা বলেননি। তবে নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে বহুবার শুনেছি। একসময় কষ্ট পেতাম। এখন আর কিছু মনে করি না।
অবশ্য ফর্সা কালোর ব্যবধানটা সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে এসেছে। যেটা এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বহাল তবিয়তে আছে। উদাহারণস্বরুপ বাজারে রং ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপনগুলোর কথাই ধরা যাক। এই বিজ্ঞাপনগুলোর কনসেপ্টটাই এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যা শুধুমাত্র সুন্দর বলতে রং ফর্সাকেই বোঝায়। আজও সেই প্রাচীন ধ্যান ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।
সুন্দরের সংজ্ঞাটা এক একজনের কাছে এক একরকম। কারো কারো কাছে সুন্দর বলতে শুধু ফর্সা রঙকেই বুঝায়। মানুষ সুন্দর হয় তার কাজে কর্মে মননে। তাই সন্তানকে ঠিকভাবে গড়ে তুলুন। বোঝা হিসেবে তাকে অন্যের মুখাপেক্ষি তৈরি না করে বরং আত্মনির্ভরশীলতার পথে সহায়ক হোন।
সবার আগে আসবে সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করার কথা, কিন্তু তা না ভেবে বিয়ের কথা ভাববে। এর কারণ হলো মেয়েদেরকে ছেলেদের সমকক্ষ না ভাবা, মেয়েদেরকে উত্তরাধিকারী না ভাবা এবং পরনির্ভরশীল তৈরি করা। একজন সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলাই বাবা মায়ের কিংবা অভিভাবক তথা পরিবারের কাজ। হোক সে ছেলে কিংবা মেয়ে। তাহলে আর কোনো মেয়েকেই বোঝা মনে হবে না।
অনেক বাবা মাকেই দেখেছি তাদের সন্তানদের আলাদা চোখে দেখেন। যে সন্তান দেখতে একটু ফর্সা, তাকে একটু আলাদা যত্ন স্নেহ করেন। কিন্তু কেন? সন্তান সন্তানই। অবশ্য সবাই যে এরকম তা কিন্তু নয়। তবে ব্যতিক্রমটা খুবই নগণ্য। এখানে বলে রাখা ভালো, সব বাবা-মায়ের উচিত সব সন্তাদের সমান ভালোবাসা দেয়া। কারণ একমাত্র বাবা মায়েরাই পারেন সন্তানের মনোজগতের সুষ্ঠুভাবে বিকাশে সহায়তা করতে। বাবা মায়েরাই সন্তানের অকৃত্রিম বন্ধু। তাই প্রতিটা বাবা মায়ের উচিত সন্তানের সংগে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা।
একজন মানুষের প্রথমিক শিক্ষাটা তার পরিবার থেকেই আসে। পরিবারই হচ্ছে সন্তানের আসল ভিত্তি। সন্তানকে এই শিক্ষাটাই দিন যেন কালো বা ফর্সা রং দিয়ে বিচার না করে। মানুষের কালো রুপ প্রকাশ পায় তার কর্মে। আমরা বাবা মায়েরাই পারি সন্তানকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে এজন্য আমাদেরকেই মনের কালো দূর করতে হবে। সন্তানকে গায়ের রং দিয়ে বিচার করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন নাতো? আপনার আমার প্রত্যেকের উচিত এই বর্ণ বৈষম্য দূর করা তাহলেই কোন মেয়েকে আর কালো হবার জন্য অপরাধবোধে ভূগতে হবে না। আসুন সবাই মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি আগামী প্রজন্মের জন্য।