নীল জোনাকি:
নারীবাদ ও নারীবাদী নিয়ে অনেক লেখালেখি দেখছি। সবাই শুধু নারীকে নিয়েই লিখছে। যারা নারীর পক্ষে লিখছে তাদের সাবজেক্ট নারী আবার যারা নারীর বিপক্ষে লিখছে তাদের সাবজেক্টও সেই নারীই। পুরুষ নামের বিরল প্রজাতিটি উপেক্ষিতই থেকে যায় সবার লেখায়। বিষয়টা দেখে আমার বুকে বড্ড ধাক্কা লাগে। আহা! আমার স্বজাতিকে আমার সম্মুখেই এমন অবহেলা! সহ্য করতে না পেরে, আমার স্বজাতির ঘটানো হালি খানেক ঘটনা নিয়ে হাজির হলাম।
ঘটনা-১
এরশাদ সরকারের পতনের পর যখন সারাদেশে সর্বহারার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়, তখন আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে একজন গৃহশিক্ষকের আমদানি হয় আমাদের বাড়ীতে (পরে জানতে পারি সে সর্বহারা কর্মী)। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। গৃহশিক্ষক থাকা মানেই আমার পায়ে শিকল তা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম। তাই আমার প্রবল আপত্তি ছিল বিষয়টাতে। আমার বোনও আমার সাথে একমত। অবস্থা বেগতিক দেখে মাস্টার মশাই শুরু করলো এক নাটক। কাঁদো কাঁদো মুখে আমার মাকে জানিয়ে দিল, তার মা নেই, সে এতিম। এতিম শব্দটা শুনেই মা আমার কেঁদে দেয়ার অবস্থা। আমাদের ধমক মেরে তাকে নিয়োগ দিয়ে দিল। মাস্টারের মুখের কান্নাভাবও উধাও। পরক্ষণেই আমার দাদীর বয়ানে সবাই বেকুব বনে যাই। দাদীর ভাষ্য-হুনো মাস্টর, আমার বউ রাজী হইছে বইলা তোমারে বাড়িতে ঠাঁই দিলাম।বুইজ্যা হুইন্যা চইল্যো। আর নাইলে আমার আতের কাছে ডান্ডা তৈয়ারই থাকে। তুমি আমার নাতিরে পড়াইবা, নাতিনে তোমার কাছে পড়বো না। আমি চাড়া দিয়া দাগ দিয়া দিতাছি, এই দাগ ডিঙ্গাইবা না। এসব কথা শুনে মা দাদীকে থামাতে চেষ্টা করলে দাদী ধমক দিয়ে বলে- তুমি থামো। আমি ভাদ্দুর মাসের কুত্তা বিশ্বাস করি, তয় মরদ বিশ্বাস করি না।
তিন বছর পর বাড়িতে অতিরিক্ত মেহমানের কাণে রাতে আমার ঠাঁই হয় মাস্টারের ঘরে। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে উপলব্ধি করি, আমার শরীরের উপরে ওজনদার কিছু একটা চেপে আছে। শরীরের মাঝে শক্ত কিছুর উপস্থিতিতে ঘটনা বুঝে ফেলি। এমনিতেই মাস্টারের উপর আমার প্রচণ্ড রাগ আমার সবকিছুতেই বাগড়া দেবার কারণে। এমন একটা সুযোগ পেয়ে তা কাজে লাগাতে ভুল করিনি তাই।
তাকে ধাক্কা মেরে শোয়া থেকে উঠেই শুরু করি লাত্থি, মনে যত ক্ষোভ ছিল তা ঢালার ইচ্ছা। মাস্টার লাত্থি খেয়েও কোন শব্দ করে না। শব্দ করলে বিপদ আরও বাড়বে বুঝেই চুপচাপ হজম করছিল। রাগ কিছু কমার পর দরজা খুলে বের হয়ে যাই। পরে আমার দখল হয়ে যাওয়া ঘরে খালাতো বোনের পাশে শুয়ে গালাগালি দিয়ে রাত পার করি। পরদিনই মাস্টার সাব তার গাট্টি বোচকা নিয়ে আমাদের বাড়ি ছাড়ে। ঘটনাটিও আমি গোপন রাখি।
ঘটনা-২
মাস্টাার সাহেব দণ্ডধারী বিদায় নেয়ার দুই মাস পর শুরু হয় আমার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে সময় কাটে সারাদিন মাসুদ রানা, ওয়েষ্টার্ন, সমরেশ আর তসলিমা নাসরিন পড়ে। বিকেল কাটে ক্রিকেটে, বন্ধুবান্ধব তো আছেই। এর মাঝে নতুন উৎপাতের শুরু-ব্রিটেনবাসী এক খালাতো বোন এসেছে দেশে। ঢাকায় আসার কয়েকদিন পরেই আমাদের বাড়িতে পদার্পণ। ক’দিন থাকার পর ঢাকায় ফিরে যাবে, কিন্ত ঝামেলার বিষয় হলো সাথে আমাকেও যেতে হবে। গাঁইগুঁই করেও পার না পেয়ে, কিছু বই সাথে নিয়ে শর্তসাপেক্ষে মিরপুরের কাজীপাড়ায় তাদের বাড়ি গেলাম। পরদিন থেকেই শেওড়াপাড়ায় শুরু করি ক্রিকেট। আর সন্ধ্যার পর শৈবাল চক্রের সাথে কঞ্জুস নাটকের রিহার্সাল। সাথে খালাতো বোন প্রিয়াংকা। ভেবে দেখলাম সময় ভালোই কাটছে। কয়েকদিন পর খালার এক দেবর ফরিদ উপস্থিত। বিকেলে ফরিদ চাচাকে নিয়েই মাঠে যাই। তিনজন রিহার্সালে যাই সন্ধ্যায়। বিপত্তি বাধে রাতে। ফরিদ চাচার শোয়ার জায়গা আমার সাথে। শুয়ে শুয়ে হেনরী রাইডার হেগার্ডের লেখা রিটার্ন অব শী পড়ছি। চাচা লাইট অফ করার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসছিল না। গল্পের পার্শ্ব চরিত্র কালুনের খানিয়া আমেনার্তাসের বিষয়টা বারবার ভাবনায় চলে আসছিল। হঠাৎ টের পেলাম আমার পিঠের উপর চাচার হাত। পিঠ হতে ধীরে ধীরে হাতের স্থান পরিবর্তন হচ্ছে। পিঠ থেকে পেট, পেট থেকে বুক।
প্রথমে আমি কুঁকড়ে যাই, পরক্ষণেই মাস্টারের কথা মনে হয়ে যায়। শব্দ না করে খাটের সাইডে হাত দিয়ে ব্যাটের অবস্থান নিশ্চিত হই। চাচা মহাসুখে আমাকে দলাইমলাই করছে। তার হাত এবার চলে গেছে আমার ট্রাউজারের ফিতায়।এখন আর চুপ থাকার মানে হয় না। চাচার হাত ধরে আস্তে বললাম, ফরিদ চাচা এবার রেডি হোন। চাচা কী বুঝলো, জানি না। মনে হলো যেন খুব খুশি হয়েছে। আমি ব্যাট হাতে নিয়ে অন্ধকারেই শুরু করলাম চাচার উপর ব্যাটিং। প্রথম বারেই ছক্কা। ব্যাটের পিট্টি খেয়ে চাচা কোঁৎ করে উঠলো। এবার শুরু আন্দাজে পিটানি। লাফ দিয়ে চাচা দরজার উপর পড়ে যায়। আমি খাট থেকে নেমে লাইট অন করে শুরু করি পিটানি। চাচা আমাকে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করছে না দেখে খুশি মনেই হামলা শুরু করলাম আবার। এবার চাচার লুঙ্গি হাতছাড়া হয়ে গেছে। লুঙ্গি ফেলেই দরজা খুলে দৌড়।
পরক্ষণেই শুনি বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ। আমি বুঝে গেছি ডাইনিং টেবিলের সাথে চাচার সংঘর্ষ হয়েছে, ফলে প্লেট গ্লাস ফ্লোরে পরে এই শব্দের উৎপত্তি। শব্দের কারণে খালা, দুই খালাতো বোন দৌড়ে লিভিং রুমে চলে আসে। ততক্ষণে আমি সব লাইট অন করে দিয়েছি। দেখি সিরামিক ভাঙ্গার মাঝে চাচা বেকুবের মতো বসে আছে, পরনে শুধু গেঞ্জি। তার এই অবস্থা দেখে দুই বোন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দেয়, আর চাচাকে লুঙ্গির হদিস জানতে চায়। খালা আমার হাতে ব্যাট দেখে জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী? আমি বললাম, চাচাকেই জিগাও, ঘটনা কী! খালা ঘটনা বুঝে ফেলে।
দুই মেয়েকে ধমক দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে চাচাকে লুঙ্গি এনে দিয়ে বলে এবার ইজ্জত ঢাকো। আমি বলি-চাচার ইজ্জতের কিছু আর বাকি আছে যে ঢাকবে? চাচাকে একা রেখে খালা আমাকে নিয়ে দুই বোনের সাথে শুতে দিয়ে চলে যায়। এবার নতুন হামলা দুই বোনের। প্রিয়াংকা জিজ্ঞেস করে, কীরে পিল টিল কিছু লাগবে নাকি? লাগলে আমি সকালে কিনে দেব, তুই কোনো চিন্তাই করিস না। ছোট বোন মিশুর প্রশ্ন, ভাইয়া ঘটনা কদ্দুর আগাইছিল, ফাইনাল হইছে নাকি? দুইটাকেই প্রথম থাপ্পর-লাথি দিয়ে পরে সব বলে দেই।
সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনি ফরিদ চাচা নেই। চমকে উঠি আমি। নেই মানে কি! ফাঁসি টাসি দিল নাকি আবার!! জেলখানার চৌদ্দ শিকের ছবিটা ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে। পরে শুনি চাচা নেই, মানে তার ব্যাগসহ নেই। ঘুম থেকে কেউ উঠার আগেই ভেগেছে। বুঝলাম তার নুরানী খোমাটা কাউকে দেখাতে চায় না। মিশু এসে বললো, চাচা খুউব লজ্জা পেয়েছে মনে হয়। খালা শুনে উত্তর দেয়, লুচ্চার জায়গা দোজখেও নাই। বেহেস্ত তো দূরের কথা। কথাটা পছন্দ হলো আমার। চাচার স্বভাবটা যদি ভাল হতো, তাহলে এভাবে পালিয়ে যেতে হতো না তাকে ভাইয়ের বাড়ি থেকে। বরং আরামেই কিছুদিন থাকতে পারতো। নিজের শিশ্ন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ইজ্জত গেল, কপালে জুটলো পিটুনি আর বোনাস হিসেবে অন্ধকারে পলায়ন।
ঘটনা-৩
ফরিদ চাচার উইকেট পতনের পর লম্বা সময় অতিবাহিত হয়েছে নির্ঝঞ্ঝাটেই। ইতিমধ্যে আমার ডিগ্রী পরীক্ষা শেষ। পরীক্ষার রেজাল্টও হয়ে গেছে। আমার রেজাল্টে পরিবার খুব বেশি খুশি হতে না পারলেও আমি নিজে খুশি, নিজের কাছে যেহেতু অতিরঞ্জিত কিছু আশা করতে পারি না। সহপাঠীরা যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে, আমার পরিবার তখন আমাকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দিল বিদেশি সার্টিফিকেট বগলদাবা করার জন্য। একসময় মায়ের চোখ ভিজিয়ে এয়ারপোর্টে চলে এলাম। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে বোর্ডিং ব্রিজ পেরিয়ে থাই এয়ারওয়েজের বিমানের দরজার কাছে যাওয়ার পরই লাস্যময়ী বিমানবালা হাই বেবি বলে এগিয়ে আসে আমার দিকে। বেবি শব্দটা শুনেই আমার তালু গরম হয়ে উঠে। বলে কী! আমি নাকি বেবি!! মনে মনে বিমানবালার পিণ্ডি চটকিয়ে তার নির্দেশিত সিটে গিয়ে বসি। যথাসময়ে ব্যাংককের সুবর্ণভূমি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণ।
কয়েকমাস পরই আমি টের পেয়ে যাই বিদেশে পড়াশোনার নামে পরিবার আমার সাথে কী নির্মম প্রহসন করেছে। তবুও এক বছর অতিবাহিত করি সাদা হস্তির দেশে। একবছর পর ক্রেডিট ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাই মালয়শিয়ার সানওয়ে কলেজে ইউনিভারসিটিতে। প্রতিটি সেকেন্ড গুনে গুনে যখন সেখানে তিন বছর অতিক্রম করি, তখনই শব্দ পাই দেশে আমার আকাশ ভাঙ্গার।
সব ফেলে ছুটে গিয়েও ভাঙ্গন রক্ষা হয়নি। বড় সুক্ষ্ম হাতে আমার আকাশটাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে আমার জন্য বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাত রেখেছিল সযতনে। মাস দুই দেশে থেকে এবার পাড়ি জমাই রাশিয়া। আর আমার ছন্নছাড়া জীবনের শুরু এখান থেকেই। কোন পিছুটান নেই, কোন দায়িত্ববোধ নেই। কারও জন্য অপেক্ষার প্রহর নেই, আমার অপেক্ষায়ও কেউ নেই। এভাবেই একবছর কাটিয়ে দিলাম সেখানে। সামারের ছুটি কিভাবে কাটানো যায় এই নিয়ে দুজন ইসরায়েলী বন্ধুর সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো পেরু ভ্রমণের। উদ্দেশ্য-মাচু পিচু আর ইনকা সভ্যতা ও আর্টিফেক্ট কাছে থেকে দেখা। এর আগে তারা নরওয়ে থাকবে কয়েকদিন। এক্ষেত্রে আমি তাদের সফরসঙ্গী হতে পারিনি। সিদ্ধান্ত হলো নাইজেরিয়ায় তারা আমার সাথে মিলিত হবে নির্দিষ্ট দিনে।
আমি খোঁজ নিয়ে অল্প খরচে কিভাবে নাইজেরিয়া পৌঁছা যায় তা নিয়ে গবেষণা করেই সপ্তা খানেক পার করে দিলাম। সস্তায় বিমানের টিকেটও যোগাড় করে ফেললাম। তবে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে নাইজেরিয়া পৌঁছতে সময় লাগবে আট দিন। আর এই আট দিন আমাকে বিমান এবং এয়ারপোর্টেই কাটাতে হবে। প্রস্তুতি হিসেবে একজোড়া স্লিপিং ব্যাগও কিনে ফেললাম। একসময় নির্দিষ্ট বিমানে চেপে যাত্রা শুরু করে মাঝে বিভিন্ন বিমান পরিবর্তন করে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের পাশের দেশ নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজার এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাই। এখানেও অপেক্ষা প্রায় দশ ঘন্টা। এর মাঝেই দুই ইহুদী বন্ধু পৌঁছে যাবে।
স্লিপিং ব্যাগে ঢোকার জন্য এয়ারপোর্টের নির্জন এলাকার খোঁজে এদিক-সেদিক হাঁটছিলাম। একটু দূরে আমার অতি পরিচিত টিভি তারকা ফিমাকে দেখে অবাক হয়ে দ্রুত সেদিকে যাই। কাছে গিয়ে বুঝতে পারি, এ মেয়ে ফিমা নয়। পরনে জিন্স আর হাতা গুটানো শার্ট। কী আর করা! সোফা জাতীয় আসনের চতুর্ভুজ সারির একদিকে আমি বসে পড়ি। একটা জলজ্যান্ত মেয়ের সামনে ব্যাগের ভিতর ঢুকতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই ব্যাগেজ থেকে বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম বের করে পড়ায় মনোযোগ দেই। একটু পরেই আরও তিন ব্যক্তির আগমন সেখানে। অল্প দূরত্বে তারাও আসন গেড়ে বসে। তিনজন বাংলায় কথা বললেও তারা বাংলাদেশী নাকি কলকাতার লোক তা বুঝতে পারছিলাম না। শব্দের উচ্চারণে অন্য কোনো দেশের টান রয়েছে। তাদের কথাবার্তা কানে এলেও আর মনোযোগ দিচ্ছিলাম না। যদিও এতদূরে এসেও বাংলাভাষী কাউকে পেলে খুশিতে কাছে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি তো সব মায়া কাটিয়ে উঠতে শিখে গেছি ততদিনে।
হঠাৎ করেই আমি আবিস্কার করি লোক তিনজন কাছাকাছি থাকা মেয়েটিকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠলো মেয়েটির দেহের বিভিন্ন অঙ্গ। এই প্রথম আমি ক্লিভেজ শব্দটি কারও মুখে উচ্চারিত হতে শুনি। আলোচনা এতই মারাত্মক আকার ধারণ করলো, আমার মনে হলো যে, আমি বধির হলেই বোধহয় ভাল হতো। মেয়েটি অভিব্যক্তিহীন বসেই আছে। তাকে দেখেও বোঝার উপায় নেই সে কোন দেশী। তবে এটুকু বোঝা যায় সেও উপমহাদেশীয়। হঠাৎ করে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে তিন ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বাংলায় বলে উঠে-আপনাদের মানসিকতা এতো নোংরা কেন? ব্রোথেলে বড় হয়েছেন নাকি তিনজনই? সন্তানের বয়সী একটা ছেলের পাশে বসে এমন ইতরের মতো আচরণ করতে বিবেকে বাধে না? আমিও সোজা হয়ে বসি। তিনজন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকায়। মধ্যবয়সী টাকলু বলে ওঠে, আসলে আমরা বুঝিনি ছেলেটা বাংলা বুঝে! মেয়েটি উল্টা প্রশ্ন করে, হাতে বাংলা বই দেখেও আপনাদের মাথায় এটা ঢুকেনি?
আমার মাথায় তখন অন্য ভাবনা। আমি বাংলা বুঝি কীনা এটা নিয়ে ভদ্রলোকদের চিন্তা। কিন্তু যাকে নিয়ে অশালীন ভাষায় আলোচনা করলো, সে তাদের ভাষা যে বুঝতে পেরেছে তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই! একটু পর মেয়েটি ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে- ব্যাগ নিয়ে ওঠো, এসব জানোয়ারের কাছ থেকে দূরে গিয়ে বসি। আমি নির্দ্বিধায় ট্রলির হাতল টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। তিনজনের উদ্দেশ্যে বলি, আপনাদের মতো নোংরা মানুষের মুখে থুথু দিতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। জানোয়ার।।
উপরোল্লিখিত তিনটি ঘটনা আমার বাস্তবজীবনের। এবার নজর দেই ভার্চুয়ালে।
ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় প্রত্যেক পুরুষই নিজেকে সাধু সন্ন্যাসী দাবি করে থাকে স্ট্যাটাস প্রসব করে কিংবা মেয়েদের পোস্টের কমেন্টে গিয়ে। ভাবখানা এমন, যেন তারা মেয়েদের দিকে ভুলেও তাকায় না। যদিও বা তাকাতে হয় তার আগে চোখে টিনের চশমা পরে নেয়। আর কেউ যে মেয়েদের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে পারে তা তারা বিশ্বাসই করতে পারে না।
কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। প্রতিটি মেয়ের ইনবক্সই সাক্ষী পুরুষ কতটা নির্লজ্জ আর লুল হতে পারে। ঘটনাক্রমে আমার ইনবক্সও এমন ঘটনার ঐতিহাসিক সাক্ষী। কতটা গায়ে পড়া স্বভাব তাদের হতে পারে তা আমার ইনবক্সের দিকে তাকালে পৃথিবীর অন্য কোনো দিকে তাকানোর প্রয়োজন হয়না। এক্ষেত্রে বয়সও কোন পার্থক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।
প্রায় ছ’মাস আগে আমার ইনবক্সে একটা লিঙ্ক আসে। লিঙ্কটি পাঠিয়েছেন আমার লিস্টের একজন ভারতীয় বন্ধু। যদিও তার সাথে আমার কখনো হাই হ্যালো পর্যন্ত হয়নি। তবে মধ্য বয়স্ক এই বন্ধুটিকে সবাই দাদা বলেই সম্বোধন করে এবং সম্মান করে থাকে। লিঙ্কটি ওপেন করে আমি স্থির হয়ে যাই। সেখানে সম্ভবত কয়েক হাজার হার্ডকোর ফটো। অজান্তেই আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে যায়। অনুভূতিটা লজ্জা, ঘৃণা নাকি অপমান তাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। আমাকে কেন এই ছবিগুলো পাঠানো হলো তাও বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই সত্যিটা অনুধাবন করতে সক্ষম হলাম। অনেকের মতো এই ভদ্রলোকও আমাকে মেয়ে ভেবেই ছবিগুলো ইনবক্স করেছে। এবং তাৎক্ষণিকভাবে আমার অনুভূতিটাও বুঝতে পারলাম। সেখানে প্রচণ্ড ঘেন্না ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। তখন তসলিমা নাসরিনের লেখা ‘নারীর কোন দেশ নেই’ কথাটা মনে পড়লো আমার। আরও মনে হলো কথাটা অসম্পূর্ণ। কথাটা হওয়া উচিৎ ছিল ‘নারীর কোন দেশ নেই, পুরুষের কোন সীমানা নেই’। পুরুষ সে পুরুষই, তা যে প্রান্ত বা যে অঞ্চলেরই হোক না কেন। আর নারী তার কাছে শুধু যৌনতার প্রতীক।
এবার উপরের ঘটনাগুলোকে পোস্টমর্টেম করে দেখা যাক :
ঘটনা-১ ও ঘটনা-২: গৃহ শিক্ষক, ফরিদ চাচা এবং আমি তিনজনই ছিলাম পুরুষ প্রজাতি। আমার বুকে মেয়েদের মতো দুটি স্তন নেই। ছোট পোষাক পরে তাদেরকে আমি সুড়সুড়িও দেইনি। তথাপি তাদের দুজনেরই কামের উদ্রেক হয়েছিল আমাকে ঘিরে। আমার স্থলে যদি কোন মেয়ে হতো, তখন দোষ চাপতো কিন্তু মেয়েটির কাঁধেই। তখন খোঁজ নেয়া হতো ওড়নার, খোঁজ নেয়া হতো মেয়েটির বুক ঢাকা ছিল কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সবশেষে এক হাতে তালি বাজে না। নিজের কামরায়ও যদি মেয়েটি আক্রান্ত হতো, তখন প্রশ্ন আসতো দরজার ছিটকিনি আটকায়নি কেন? পুরুষের একটু আধটু দোষ থাকেই, মেয়েটির উচিৎ ছিল দরজা জানালা ভালমতো বন্ধ করা, বন্ধ যেহেতু করেনি তাহলে বুঝাই যায় তারও সম্মতি ছিল। পুরুষের অপরাধ তখন দরজা জানালা আর ওড়নার নিচেই চাপা পড়ে যায়।
ঘটনা-৩: বিমানবন্দরে তিনজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ যে মেয়েটিকে রীতিমতো মৌখিক ধর্ষণ করলো, সে মেয়েটার পোষাক কিন্তু শালীন পোষাকবাদীদের চাহিদার চেয়েও শালীন ছিল। মোটা জিন্স এবং শার্ট। শার্টের সবগুলো বোতামও লাগানোই ছিল। পায়ে ছিল হালকা কেডস। তারপরও তার দেহটাকে পোষাকের ভেতর থেকে বের করে আনা হয়েছে নির্লজ্জ ভাবে। তার স্তন, যৌনাঙ্গ এমনকি নিম্নাঙ্গের কেশও বাদ যায়নি আলোচনা থেকে। যারা নারীর পোষাককে দায়ী করে থাকে ধর্ষন বা অপ্রীতিকর কোন ঘটনায়, এখানে তাদের বক্তব্য কি তা খুব জানতে ইচ্ছে হয়।বিমানবন্দর না হয়ে যদি নির্জন কোন জায়গা হতো তাহলে মেয়েটির পরিনতি সহজেই অনুমেয়।
ঘটনা-৪ঃ আমার বিশিষ্ট ভদ্রলোক বন্ধু আমাকে মেয়ে ভেবে ইনবক্সে যে হাজার খানেক ছবি পাঠিয়েছে তা নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রায় সব মেয়ের ইনবক্সেই এমন ছবি, কুরুচিপূর্ণ মেসেজ যায়। এটা সবশ্রেণীর মাঝেই বিদ্যমান। যখন ফেসবুক ছিল না তখন ছিল মোবাইল ফোনের ইনবক্স। যখন মোবাইল ফোন ছিল না তখন অন্যভাবে হতো। হয়রানি সবসময়ই ছিল। বেশিরভাগই প্রকাশ হতো না। যদিও দুয়েকটা ঘটনা প্রকাশ করে উচ্চশ্রেণীর কারও কারও মুখোশ খুলে দেয়া হয়েছিল, বিপরীতে একশ কোটি টাকার মানহানির মামলার রেকর্ডও আছে আমাদের দেশে!
পোষাক এবং পোষাকের স্বাধীনতাকে অনেকেই দায়ী করে থাকেন ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের জন্য। অথচ কোন মেয়ে যদি তার শরীরকে কাপড়ে মুড়েও রাস্তায় বের হয়, তখন কাপড়ের ভাঁজ গলেও আমাদের চোখ নারীর স্তন খোঁজে, দেহের ভাজ খোঁজে। পোষাকের স্বাধীনতা শব্দটাকে আমরা বুঝে নেই নগ্নতা। অর্থাৎ কোন মেয়ে যদি পোষাকের স্বাধীনতার কথা বলে, আমরা ভেবে নেই মেয়েটি নগ্ন থাকতে চাইছে। এখানেই আমাদের চিন্তাশক্তির দৈন্যতা। পোষাকের স্বাধীনতা মানে নিজের পোষাক নিজে পছন্দ করা। সাধারণ এই বিষয়টা না বুঝেই আমরা নারীদের উপর চাপিয়ে দেই দোষারোপ। এবং তাদেরকে আচ্ছাদিত করি কয়েক পরত কাপড় দিয়ে। অথচ আমরা মানে পুরুষেরাই আবার আবিস্কার করি পোষাক ভেদ করে নারীদেহ অবলোকন করার জন্য এক্সরে চশমা।
একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী দেখা যায় যারা নারীকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নারীবাদ এবং নারীবাদীকে কটাক্ষ করেন।নারীবাদীকে তারা বলে থাকেন নারী পটানোর মন্ত্র। অথচ নিজেকে পুরুষ ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন। তারা নারীবাদকে অস্বীকার করে নারীকে মানুষ ভাবেন। অথচ নিজেকে পুরুষ ভাবেন। নারীকে আপনি মানুষ ভাবলে নিজেকে কেন মানুষ না ভেবে পুরুষ ভাবছেন। এবং পুরুষের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজে খুঁজে নারীর দুয়েকটা অপরাধকে দাঁড় করাচ্ছেন!
তাদের কথায় মনে হয় নারীর জন্য কোন প্রতিবন্ধকতাই নেই আমাদের সমাজে। তারা এও জানে না, নারীর হেসে কথা বলাও নিষিদ্ধ পুরুষশাসিত সমাজে। নারীরা সেখানে শুধুই-রামগড়ুরের ছানা, হাসতে তাদের মানা।
হেসে কথা শুনলে বলে, হাসবে না না না!!