রিয়াজুল হক:
পরিবর্তনে নারী। এই নীতিকে সামনে রেখে বাংলাদেশে সম্পূর্ণ নারীবিষয়ক প্রথম অনলাইন পোর্টাল হলো উইমেন চ্যাপ্টার। এই পোর্টালের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে তিনটি পক্ষ। সম্পাদক-সংগঠক(বৃন্দ), লেখক ও পাঠকবৃন্দ। উইমেন চ্যাপ্টার-এর সম্পাদক-সংগঠক, লেখক ও পাঠক–এরা ভূমিকায় ও অবদানে পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক।
একটি পোর্টাল হিসেবে উইমেন চ্যাপ্টার তার লেখকদের লেখা অনেক পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে। বিপরীতভাবে লেখকরাও তাদের লেখার মাধ্যমে উইমেন চ্যাপ্টারকে একটি পোর্টাল হিসেবে অগুণতি পাঠকের কাছে নিয়ে গেছেন, নতুন পাঠক তৈরি করেছেন। আবার অনেক পাঠক কোনো লেখকের এ পোর্টালে প্রকাশিত লেখার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে নিজেই লেখকে রূপান্তরিত হয়েছেন।
উইমেন চ্যাপ্টার আসলে একটি যৌথ অবদানের ওপর ক্রমবিকশিত নতুন যুগের একটি সামাজিক মাধ্যম। এ পোর্টালের একজন লেখক হিসেবে আমার প্রধান অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া হলো – উইমেন চ্যাপ্টার একটি এক্টিভিজম। এটি এক্টিভিস্টদের একটি সৃষ্টিশীল জ্ঞান অনুশীলনের পরিসর, যা নারীর পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত। এটি কোনো বাণিজ্যিক উদ্যোগ বা পোর্টাল নয়, মুনাফা যার লক্ষ্য।
উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক-সংগঠক(গণ) আমাদের অকুণ্ঠ অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা পাবেন এ কারণে যে, আজকের বাজারি ও পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ায় অর্থ ও স্বার্থ ছাড়া কম মানুষই শ্রম ও মেধা ব্যয় করেন। সেখানে এর সম্পাদক ও সংগঠক(গণ) শুধু শ্রম ও মেধা ব্যয় করেই ক্ষান্ত নেই, বরং নিজেদের অর্থও ব্যয় করছেন এর পেছনে। কারণ এ ধরনের একটি পোর্টালের অনেক পরিচালন ব্যয় আছে।
আমার ধারণা পোর্টালে যে দু-একটি বিজ্ঞাপন দেখি, তা দিয়ে এর পরিচালন ব্যয় নির্বাহ হওয়ার কথা নয়। সেইসঙ্গে যাঁরা লেখেন, তাঁরাও এখানে লিখে কোনো পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। তাঁরাও আমাদের অকুণ্ঠ অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা পাবেন। সেইসঙ্গে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন পাবেন এই পোর্টালের পাঠকগোষ্ঠী, যাঁরা প্যাসিভ নন, বরং এক্টিভলি লেখকদের লেখার ওপর সহমত, ভিন্নমত ও প্রতিমত নিষ্ঠার সাথে তুলে ধরেন। এতে লেখক ও সম্পাদক উদ্বুদ্ধ হন, সিনিথিসিস হিসেবে জ্ঞানের নতুন নতুন জানালা খুলে যায়।
উইমেন চ্যাপ্টার কী ধরনের লেখা প্রকাশ করছে? সেটি তার শ্লোগানই বলে দেয়; নির্ধারণ করে দেয়। এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এ পোর্টালটি যেসব বিষয়ে লেখা প্রকাশ করে, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে গুরুত্বের সাথে। উইমেন চ্যাপ্টার প্রধানত নারীর অধস্তনতা, নারী-পুরুষের বৈষম্য, পুরুষতন্ত্র, নারীমুক্তি, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষের যৌনতা, নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত লেখা প্রকাশ করছে। একবাক্যে নারীবিষয়ক লেখা প্রকাশ করছে।
নারীবিষয়ক লেখার অনেক উপাদান সমাজে বিবেচিত হয় ‘স্পর্শকাতর’, ‘সংবেদনশীলন’ বা ‘নীরব’ বিষয় হিসেবে। এর অনেক বিষয় আমাদের সমাজে কখনও পাবলিক ডিসকোর্স হিসেবে পাবলিক ডিবেইটে আসেনি, বা আসলেও কম এসেছে। যিনি বা যাঁরা এনেছেন, তাঁরা অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন।
পুরুষতন্ত্র আমাদের সমাজে এমন কিছু ট্যাবু ও সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-বিদ্যাজাগতিক পরিমণ্ডল তৈরি করেছে, যেখানে নারীবিষয়ক অনেক আলোচনা একান্ত ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘নিষিদ্ধ’ বলে প্রবলভাবে বিবেচিত হয়। এমনকি এসব বিষয়কে কার্পেটের নিচে রাখার প্রবণতা আমাদের বিদ্যাজাগতিক পরিসরেও বিদ্যমান। কিন্তু উইমেন চ্যাপ্টার বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে, পুরুষতন্ত্রকে অনেক সময়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এসব লেখা প্রকাশ করেছে এবং করে চলছে। লেখকরা স্বনামে এসব লেখা লিখে ব্যক্তিগতভাবেও পারিবারিক ও সামাজিক ঝুঁকি নিয়েছেন। সেইসঙ্গে পুরুষতন্ত্র সৃষ্ট ট্যাবু ও সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক-বিদ্যাজাগতিক পরিমণ্ডলকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমি এই পোর্টালে এমন অনেক তরুণ লেখকদের বিশেষ করে তরুণ নারীদের এমন বিষয়ে লেখা পড়েছি, যা আমরা আমাদের তরুণ বয়সে নারী-পুরুষরা ভাবিনি, বা আলোচনা করিনি নিজেদের মধ্যে-যারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল বলে দাবি করেছি।
আরো মনে রাখা দরকার, এখানে নারীরাই বেশি লেখেন। আমাদের সমাজে নারীর চোখে নারীর জীবনকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করার সুযোগ ও পরিসরও কম।
যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, উইমেন চ্যাপ্টারে সব লেখাই কি পদ্ধতিগতভাবে যৌক্তিক? পদ্ধতিগতভাবে যৌক্তিকতার প্রশ্নটি অপেক্ষিক, অনপেক্ষ নয়। সেটি কোন মানদণ্ডে বিচার করা হবে? এমনকি লিঙ্গ সম্পর্কিত বা নারীবিষয়ক ধারণা বিন্যাসেরও একাধিক বিদ্যাজাগতিক পন্থা-পদ্ধতি রয়েছে। তাই এসব বিষয়ে বিচারের দায়িত্ব পাঠকের ওপর ছেড়ে দেয়াই উত্তম। তাঁরাই বিচার করবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন লেখকের লেখা গ্রহণের ও বর্জনের। সেইসঙ্গে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার ওপর পাঠকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পরিসর তৈরি করাও একটি মাধ্যমের দায়িত্ব। আমার অভিমত হলো, উইমেন চ্যাপ্টার সেটি ভালভাবেই করেছে এবং করে চলেছে। এর ফলে উইমেন চ্যাপ্টার-এর লেখক ও পাঠকের মজবুত সেতুবন্ধন ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। পাঠকের আয়নায় লেখকগণ নিজেদেরকে এখানে দেখতে পাচ্ছেন।
উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত অনেক লেখা দেখে যে কেউ এর সাহিত্য মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। প্রশ্ন তোলাটা অস্বাভাবিক নয়। লেখকের লেখা নিয়ে পাঠকের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা সবার আছে। কিন্তু কোনো লেখক যদি সাহিত্যের প্রথাগত ছক অস্বীকার করেন, কথ্য ভাষাকে নিজের লেখায় নিয়ে আসেন, বৈঠকি ভাষাকে পরিত্যাগ করেন, তাহলে তাকেও সেটি করতে দেয়া উচিত। কারণ কনস্ট্রাকসন ও ডিকনস্ট্রাকসনের মধ্য দিয়েই ভাষা, চিন্তা এবং তা প্রকাশের ছক এগোয়।
যে নারী-পুরুষ (মনে রাখা দরকার পুরুষতন্ত্রের অভিঘাত নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও আক্রান্ত করে) তাঁর বা তাঁদের প্রতিদিনের জীবনের অভিজ্ঞতা ও অভিঘাত নিয়ে উইমেন চ্যাপ্টারে লিখিত বয়ান তৈরি করেন, সে সবের সাহিত্য মূল্যের যোগ-বিয়োগ আমার মতে প্রয়োজনীয়, কিন্তু জরুরি নয়। জরুরি হলো প্রতিদিনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া নারী-পুরুষের অভিজ্ঞতার-মতামতের প্রতিফলন, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বোঝা এবং নিজের জীবনের ও ভাবনার সাথে তা মিলিয়ে নেয়া; সর্বোপরি পরির্তনের উদ্যোগ নেয়া-তার পরিসর যাই হোক না কেন। যে নারী তার বয়ান কখনও পাবিলিক ডোমেইনে প্রকাশ করতে পারেননি, সবসময় তিনি সমাজের চাপিয়ে দেয়া অবদমনের ও পরাধীনতার মধ্য দিয়ে গেছেন, সেখানে তিনি এই পোর্টালে স্বাধীনভাবে নিজের কথা লিখছেন। এটিই সবচেয়ে বড় পাওয়া। অধিকারের চৌহদ্দিটা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে নেয়াই জীবন সংগ্রামে মূল উপজীব্য। এর মূল্য সাহিত্য মূল্য সংক্রান্ত বিতর্কের কাছে পরাজিত বা অধীন হতে পারে না।
উইমেন চ্যাপ্টারে যাঁরা লেখেন, তাঁদের অনেকেই স্বতঃফূর্তভাবে লেখেন। অনেকে এটিকে এক্টিভিজমের অংশ বলেও লেখেন। নারীমুক্তি, নারী-স্বাধীনতা, নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইটা নিশ্চিতভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক। তাই এসব বিষয়ে মত, প্রতিমত, সহমত ছাড়া এগোনোর অন্য কোনো বিকল্প নেই।
তাই বলে উইমেন চ্যাপ্টারের সব লেখকই কি একটি নির্দিষ্ট সামাজিক লক্ষ্যে লিখছেন? নারী হিসেবে একই সামাজিক বর্গের হলেও শ্রেণি হিসেবে সকল নারী এক আর্থ-সামাজিক বর্গের নয়। একটি লেখার সাথে একজন লেখকের ব্যক্তিগত এস্টাবলিস্টমেন্টের কি কোনো সম্পর্ক নেই? আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি, সম্পর্ক আছে অথবা নেই। দিনশেষে লেখকরাও (যাদের অধিকাংশ মধ্য ও উচ্চ আর্থ-সামাজিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত) একটি প্রোএস্টাবলিস্টমেন্ট ও কনজিউমারিস্ট সামাজিকায়নের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। সেখানে লেখক হিসেবে কেউ কেউ উইমেন চ্যাপ্টারকে তাঁর এস্টাবলিস্টমেন্টের হাতিয়ার বা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন-এটিই স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। এটিকে সমাজের একটি প্রবণতা হিসেবেই গণ্য করতে হবে।
আমরা কি দেখিনি, আমাদের অনেক ‘বিখ্যাত’ লেখকরা যৌবনে ‘এন্টি-এস্টাবলিস্টমেন্ট’ লেখা লিখে জনপ্রিয় হয়ে পরিণত বয়সে শুধু ‘প্রো-এস্টাবলিস্টমেন্ট’ ও ‘বাণিজ্যিক’ লেখা লিখেছেন। তাঁরাও কর্পোরেট পুঁজির অধীন হয়ে গিয়েছিলেন বা গেছেন। অবার অনেকেই তা হোননি। যারা হোননি, তারাই অনুপ্রেরণা হতে পারেন উইমেন চ্যাপাটারের সম্পাদক-সংগঠক এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের লেখকদের কাছে।
কোনো লেখক উইমেন চ্যাপ্টারে লিখে পরিচিত হয়েছেন। সেই কৃতিত্বের প্রধান দাবিদার কিন্তু লেখক, তারপরে পোর্টাল। পোর্টালের থাকবে সন্তুষ্টি যে, তার মাধ্যমে প্রকাশিত লেখা অনেক পাঠকের কাছে পৌঁছেছে। পোর্টাল তো আসলে মাধ্যম-প্রেরক হিসেবে লেখক এবং গ্রাহক হিসেবে পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ শৃঙ্খলে। একইসঙ্গে লেখককেও পোর্টালের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কারণ মাধ্যমটিকে অবলম্বন করেই তাঁর পরিচিতি বেড়েছে আপন মহিমায়। এটি অনেকটা ভেলায় ভেসে প্রতিকূল আবহাওয়ায় লড়াই করে একজন মানুষের নদী পার হওয়ার উপাখ্যান। সাফল্যের জন্য মানুষটি কৃতিত্বের দাবিদার, কিন্তু অবলম্বন হিসেবে ভেলাটির গুরুত্বও স্বীকার করতে হবে। ভেলার কারিগরদের স্বীকৃতি দিতে হবে।
অনেকদিন লিখে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে কোনো লেখক উইমেন চ্যাপ্টার-এ লেখা ছেড়ে দিলেন। তিনি এরপর অন্যকোনো সামাজিক পোর্টালে লেখা শুরু করলেন, অথবা একটি নতুন পোর্টাল গড়ে তুললেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাতে কোনো সমস্যা দেখি না। এতে আমি তার কোনো দোষও দেখি না। এটি লেখকের স্বাধীনতা, এটি তাঁর কর্মের স্বাধীনতা। নতুন উদ্যোগ নেয়ার স্বাধীনতা। লেখকের স্বাধীনতা কোনো মাধ্যমের অধীন হতে পারে না; কোনো প্রতিষ্ঠানের অধীন হতে পারে না। একে বরং দেখতে হবে অধিকার ও সামাজিক সুযোগ হিসেবে। কারণ এতে করে নতুন নতুন মাধ্যম বা পোর্টাল, সম্পাদক, সংগঠক, লেখক ও পাঠক তৈরি হবে।
এক্টিভিজমের কোনো একক ভরকেন্দ্র থাকা উচিত নয়। বরং সহমতের মাধ্যম ও পোর্টালগুলোর মধ্যে কর্মজালকে আরও সবল করতে হবে; ঐক্যের বাতায়ন তৈরি করতে হবে। পরিবর্তনের জ্ঞান ও দক্ষতাকে দেখতে হবে সামাজিক মালিকানার বিষয় হিসেবে, যা ছড়িয়ে পড়ে এক কেন্দ্র থেকে অন্য কেন্দ্রে, এক সময় থেকে অন্য সময়ে, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। কিন্তু একইসঙ্গে পরিচিত হওয়া লেখককে তার পুরোনো মাধ্যমের বা পোর্টালের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। সেই মাধ্যমের বা পোর্টালের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে উদারভাবে। মনে রক্ষণশীলতা থাকলে সমাজের রক্ষণশীলতা কীরূপে ভাঙ্গা যাবে?
লেখকের স্বাধীনতা কেবলমাত্র তার দায়িত্ব এবং মানবাধিকারবোধ দ্বারাই শৃঙ্খলিত বলে আমি জ্ঞান ও মান্য করি। এক্ষেত্রে অন্য কোনো ব্যক্তি বা এজেন্সি বা কোনো বিধিবিধান দ্বারা লেখকের স্বাধীনতা নির্ধারিত হতে পারে না। একজন লেখক একটি লেখা উইমেন চ্যাপ্টারে দিলেন এবং সেটি প্রকাশিত হলো। এই লেখাটি কি অন্য কোনো মাধ্যমে পুনপ্রকাশিত হতে পারবে? আমার অভিমত হলো-আইনত তা পারবে, যদি অন্য কোনো চুক্তি বা শর্ত না থাকে। একজন লেখক যদি তার লেখার ‘মেধাস্বত্ত’ বিনিময় মূল্যের মাধ্যমে উইমেন চ্যাপ্টারের কাছে হস্তান্তর না করে থাকেন, বা তিনি কোনো ধরনের চুক্তির বা শর্তের অধীন না হোন, তাহলে আইনি বাধ্যবাধকতা তাঁর ওপর প্রযোজ্য নয়।
কিন্তু আইনের বাইরেও একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও দায়বোধ থাকে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সমাজের মানুষ সেটিই বেশি মেনে চলেন। লিখিত ও সুসংজ্ঞায়িত আইনের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। কিন্তু মানুষ নৈতিক বাধ্যবাধকতার দ্বারাই সামাজিক সংহতি বেশি সমৃদ্ধ করেছেন। তাই যে লেখকের লেখা উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত হলো, যাঁর সাথে ঔ পোর্টালের কোনো চুক্তিপত্র নেই-তাঁর কি কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও দায় নেই? আমি মনে করি, এক্ষেত্রে অবশ্যই লেখকের নৈতিক বাধ্যবাধকতা ও দায় আছে এবং তা বেশ ভালভাবেই আছে।
উইমেন চ্যাপ্টারে একবার লেখা দিয়ে সেটি প্রকাশিত হওয়ার পর, অন্য কোথায়ও তা আবার প্রকাশ করার আগে সংশ্লিষ্টদেরকে (উইমেন চ্যাপ্টারের সাথে যুক্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ) অবশ্যই অবগত করা উচিত। সেইসঙ্গে যেখানে সেটি আবার প্রকাশিত হচ্ছে, সেখানে এই লেখাটি উইমেন চ্যাপ্টারে কবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে, তার তারিখসহ উইমেন চ্যাপ্টারের নাম থাকা উচিত। বিশ্বজুড়ে এটিই চল। এটি হলো লেখকের নৈতিক বাধ্যবাধকতা, সেইসঙ্গে দায়িত্ব। মুদ্রার একপিঠ যদি হয় স্বাধীনতা, তবে অন্য পিঠ হলো বাধ্যবাধকতা ও দায়িত্ব।
আমার এবং আপনার লেখা প্রকাশ করে সারথী হলো উইমেন চ্যাপ্টার। আমাদের লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশযোগ্য করলেন এর সম্পাদক-সংগঠক(গণ)। এখন আমি বা আপনি বা আমরা-যাঁরা উইমেন চ্যাপ্টারে লিখি, তাঁরা যদি এই পোর্টালের এবং এর সঙ্গে যুক্ত সম্পাদক ও সংগঠকদের বিনিয়োজিত মেধা ও শ্রম-এর স্বীকৃতি না দেই, তবে কি করে আশা করি লক্ষ লক্ষ নারীর বা পুরুষের শ্রমের ও মেধার উপযুক্ত স্বীকৃতি ও মূল্য দেবে মালিকপক্ষ, গোটা সমাজ এবং রাষ্ট্র। এটি নৈতিকতার চেয়েও আদর্শের প্রশ্ন, লেখকের সততারও প্রশ্ন। উইমেন চ্যাপ্টারের লেখকরা এ প্রশ্নে সবসময় উত্তীর্ণ থাকবেন বলেই আমার একান্ত প্রত্যাশা। এই পোর্টালের একজন লেখক ও পাঠক হিসেবে আমিও এ বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
উইমেন চ্যাপ্টার সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনে বা রূপান্তরে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে না। ইতিহাস তাই বলে। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য যে পুরুষতন্ত্রমুক্ত ও শ্রেণিহীন চিন্তা চাই, যে সমতার ও সাম্যের বিশ্ববীক্ষা চাই, তা তৈরির ক্ষেত্রে আরো অনেক উপায়ের সাথে পোর্টাল হিসেবে উইমেন চ্যাপ্টারও ভূমিকা রাখতে পারে, এবং আমার অভিমত হলো তা বর্তমানে হচ্ছেও-পরিসর ও গভীরতা যতদূর বিস্তৃত হোক না কেন। এখানেই এই পোর্টালের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বিদ্যাজাগতিক উপযোগিতা। এই উপযোগিতাকে বাস্তবে অনুদিত করার দায়িত্ব উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পাদক-সংগঠক, লেখক ও পাঠক-সবার। এটি একটি যৌথ প্রয়াস। এটি একটি অ্যাক্টিভিজম। উইমেন চ্যাপ্টারকে ঘিরে প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি এখানেই নির্ধারিত ও বিস্তৃত।
লেখক ও উন্নয়নকর্মী