ফারহানা আফরোজ রেইনী:
আপাত দৃষ্টিতে আদর আর কদর বিষয়টি একরকম মনে হলেও আমার মনে হয় শব্দ দুইটির মধ্যে সুক্ষ্ম একটা পার্থক্য আছে, আছে কিছুটা বৈষম্যও। কদরের সাথে শর্ত জড়িত থাকে, আর আদর শর্তহীন। সর্বোপরি কদর হয় গুণের, আর আদর হয় মানুষের।
তবে কিছু গুণী মানুষের গুণের কদর করে আদর পাওয়ার ভাগ্য হয় বৈকি! এই গুণী মানুষদের মধ্যে রয়েছে বাড়ির বউ, যে কিনা গুণী হলেই কেবলমাত্র আদর পাওয়ার যোগ্য হয়। যতক্ষণ সে তার গুণের প্রকাশ ঘটাতে পারবে ততক্ষণ আদর পাবে, একটু এদি- ওদিক হলেই রক্ষা নাই। বউ ভালো, কিন্তু ………………
শাহানার বিয়ে হয়েছে দশ বছর. স্বামীর বাড়িতে এসে প্রথম দিনেই তাকে বোঝানো হয়েছে তার দায়িত্বগুলো। খুব বেশি না। তার স্বামী যেহেতু বড়, তাই তার ছোট যে চারটি ভাই-বোন রয়েছে তাদের দেখাশোনা করা, শাশুড়ির বয়স হয়েছে তাই রান্নাটা করা, আর শ্বশুরের একটু সেবা-যত্ন করা। ব্যস, এর বেশি কিছু না।
শাহানা সব মাথা পেতে নিয়েছে। সবকিছুই কঠাক মতো করে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে আদরই করে। শুধু শাশুড়ি মাঝে মাঝে বলেন, বৌটা ভালো, তবে কোনো দিনই বিকালের চা’টা সময়মতো দিতে পারে না। কী যে করে বুঝি না!! এই গেলো, এই জায়গাটাতে সে কিছুতেই আদর পাওয়ার যোগ্য নয়। তাই একটু বাড়তি কথা শুনতে হয় তাকে।
আমরা জামাই আদর কথাটা হর হামেশাই শুনে থাকি। অর্থাৎ জামাইকে শর্তহীন ভালোবাসা। জামাই গুণী হোক, আর নাই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। সে যে জামাই, এই জন্যই তার আদর। বরং মাঝে মাঝে উল্টোটাও হয়, যে জামাই যত বেশি দায়িত্ব-কর্তব্যহীন, তার আদরও বেশি, আবার উপরি হিসেবে কদরও পায়। কী করে? বলছি , মিলিয়ে নিন।
মোহন আর রেখা। বিয়ে করে দূরে থাকে আলাদা বাড়িতে। বাড়িতে মোহনের বাবা-মা আর ছোট বোন থাকে। মোহন-রেখা দুজনেই চাকরি করে। শাশুড়ি বৌকে ভালো করে শিখিয়ে দিয়েছে প্রতিদিন ফোন করে তাদের খোঁজ নেয়াটা বউ হিসেবে তার কর্তব্য। রেখা সেই কর্তব্য ভালো মতোই পালন করে। কোনো কারণে যদি কোনো একদিন ফোন করতে না পারে, খোঁজ পরে যায় বউ কী নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে, একটা ফোন করতে পারে না!
এইবার আসেন মোহনের কথায়। মোহনকে কোনো দিনই শুনতে হয়নি প্রতিদিন ফোন করে শ্বশুর শাশুড়ির খোঁজ নেয়াটা তার কর্তব্য। মাঝে মাঝে রেখার মাই ফোন করে জামাই এর সাথে কথা বলতে চায়। কী করবে , জামাইটা যে তার বড় আদরের! মোহনও কখনো নিজ থেকে ফোন করে না। সে যে খুব ব্যস্ত থাকে, তাও না। তবু রেখার মা বলবে, জামাই আমার এতো ব্যস্ত থাকে, ফোন করবে কখন ? তবে রেখার কাছ থেকে ও ঠিকই আমাদের খবর নেয়।
একবার রেখার চাপাচাপিতে মোহন তার শাশুড়িকে ফোন করেছিল। ওরে বাবা, শাশুড়ি কী খুশি! জনে জনে বলে বেড়ায়, জামাই তার কত্ত ভালো , এতো ব্যস্ত থাকে তবু ফোন করে খোঁজ নেয় !
জামাই এর আদর আর দায়িত্বহীন হয়েও দায়িত্ববানের কদর কীভাবে মেলে এবার নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে!
নুপুরের বিয়ের তিন বছর পরও তাকে তার শ্বশুর বাড়ির মানুষের কাছে শুনতে হয়, তার বাবার বাড়ির লোকজন তাদের ছেলেকে যে ঘড়িটা দিয়েছে, সেটা খুব বেশি দামি নয়, আর ব্র্যান্ডটাও খুব হাইফাই কিছু না। স্যুটের কাপড়টা আরেকটু দামি আর ভালো কেনা যেত ইত্যাদি। অথচ তারা যখন নুপুরকে আনতে যায় বিয়ের দিন, সব মিলিয়ে চার ভরি গয়না নিয়ে গিয়েছিলো। না, এটা নিয়ে নুপুরের বাবা বা মায়ের কোনো আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী আর কিছু আত্মীয় স্বজন বলছিলো, এত কম গয়না! নুপুরের মা বরং তাদের দু কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, নুপুর এতো বড় ঘরে বউ হয়ে যাচ্ছে, এটা কি কম হলো? বিয়ের পর তো সবই তার!
এখানে বলা বাহুল্য, নুপুরের স্বামী যা পেয়েছিলো, তা কিন্তু সে উপহার হিসেবে, আদর হিসেবে, ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে। আর নুপুরকে যে গয়না দেয়া হয়েছে, তা কিন্তু আদর ভালোবাসা বা উপহার কিছুই নয়। তার বিয়েতে যে দেনমোহর ধরা হয়েছে, তা থেকে এই গয়নার দামটা বাদ যাবে।
তাহলে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন উপহার হিসেবে তাকে কী দিলো? কিছুই না, উল্টো তারা তাদের ছেলেকে দেয়া উপহারের সমালোচনা করতে বসেছে। আর নুপুরও বুঝতে পারে না, তার মা এই কথাটা কেন সবসময় বলে যে, বিয়ের পর সবই তার। তার বিপদে-আপদে এখন পর্যন্ত তার মা-বাবাই এগিয়ে আসে। অথচ আজও শুনে আসছে সবই তার। আবার জামাই কোনো আর্থিক সংকটে পড়লেও নিজের মা-বাবার কাছে যাওয়ার চাইতে নুপুরের মাধ্যমে নুপুরের বাবার কাছে চাইতেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নুপুরের মা-বাবাও ভাবে, জামাই তাদের কত আপন ভাবছে ! একেবারে নিজের ছেলের মতো ! এই জামাইকে আদর না করে পারা যায়? নুপুরের কপালে তাই আদর-কদর কোনোটাই জোটে না। আর অন্যদিকে তার স্বামী আদর তো পায়ই, সাথে নেতিবাচক স্বভাবের গুণে কদরটাও কিভাবে আদায় করে নিচ্ছে?
আমাদের দেশে বিয়ের পর মুসলিম রীতিতে মেয়েকে ছেলের হাতে তুলে দেয়া হয়, হিন্দু রীতিতে যেটাকে বলা হয় সম্প্রদান। তাহলে হিসাব মতো দায়িত্ব পালন করা উচিত জামাই এর। যে মেয়েটাকে তার হাতে তুলে দেয়া হলো, যে মেয়েটাকে সে নিয়ে এলো তার প্রতি, তার পরিবারের প্রতি তো দায়িত্ব পালন করার কথা তার ! যে মেয়েটাকে তার মা-বাবার কাছ থেকে সে বুঝে নিয়ে এলো তাকে আদরে রাখার দায়িত্ব তো তারই। যাকে আপন করে নিজের ঘরে নিয়ে আসা হয়, তার সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব তো জামাই আর তার বাড়ির লোকজনের উপরই বর্তায়। অথচ বউকে পদে পদে অসম্মান করা, আর অপমানিত করার কত চেষ্টাই না চলতে থাকে।
অন্যদিকে মেয়ের বাড়ির লোকজন সব সময় চেষ্টা করেন তাদের জামাইকে কতভাবে সম্মানিত করা যায়, শুধুমাত্র মেয়েটি একটু ভালো থাকবে, এই আশাতে !
জামাই বলে কথা !!