ফাহমি ইলা:
‘হালদা’ দেখতে গিয়েছিলাম গতকাল। এক কথায় বললে- ‘বেশ ভালো লেগেছে’। হালদা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে বানানো ‘হালদা’ সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হয়েছিলো শুধু সিনেমা দেখছি না, একটি উপন্যাসও যেনো সংক্ষেপে পাঠ করছি। লক্ষ লক্ষ মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদী, এখানে জেলেদের জীবন জীবিকা এই নদীকে কেন্দ্র করে। কারখানার বর্জ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র ‘মাছেদের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র’ বিপর্যয়ের মুখে।
পাবনার রূপকথা সিনেমা হলের স্ক্রিন ঘোলা ছিলো, নাকি সিনেমায় লাইট কম ছিলো, বুঝতে পারিনি, তবে সিনেমায় লাইট কম মনে হয়েছে।
হালদা নদী ও নদীপাড়ের জীবন নিয়ে ‘হালদা’ সিনেমা। সেখানে দরিদ্র জেলে আছে, আছে জেলের সংসার, জেলের সঙ্গী-সাথী, ইটভাটার মালিক ও তার পরিবার, আছে মা-মাছ। এখানে যেমন আছে জলদস্যুর আক্রমণ, আছে ভূমিদস্যুর আক্রমণ। ভূমিদস্যুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে নিজের কন্যাসন্তানকে বিক্রি করে দিতে হয় পুঁজিপতির কাছে। সিনেমার শুরুতে ঢোল, সানাইয়ের মিউজিকটা বেশ লাগছিলো, শাঁখের আওয়াজও।
সিনেমাকে প্রথম দর্শনে ভালো লাগাতে পরিচালক সফল। ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয়ের ভক্ত আমি। তার অভিনয় দেখলে মনে হয় তিনি অভিনয় করছেন না, আসলে এটাই তার স্বরূপ। যেকোনো চরিত্রকে ধারণ করা তার মত জাতশিল্পীর কাজ। মোশাররফ করিমকে দিয়ে ‘দর্শক বেশি খায়’ বলে কমেডি অভিনয় করালেও করিমের অভিনয় দক্ষতা যে এর বাইরেও দুর্দান্ত– সিনেমায় তা ফুটে উঠেছে। আর জাহিদ হাসান যিনি একটি ইটভাটার মালিক, যিনি বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থারও ধারক এবং একই সাথে সামন্ত ব্যবস্থারও ধারক। জাহিদ হাসানের অভিনয় দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি কেনো যেনো পুরোটা দিতে পারছেন না, একটু আনমনা।
শীতে গ্রামগুলোতে নাচ-গানের আসর বসে, যেখানে হারমোনিয়াম, তবলায় আল্লাহবন্দনা করা হয়, আবার পাশাপাশি নাচও চলে, এটাই বাংলার সংস্কৃতি, এটাই সরল বিনোদন। এ দৃশ্যটুকু দেখে ভাবছিলাম বর্তমান অবস্থার কথা। সারাদেশে এখন শীতের আগমনী বার্তা আসবার সাথে সাথে শামিয়ানা টাঙানো শুরু হয় ওয়াজের জন্য। পালাগান, যাত্রা, গানের মজলিশ হারিয়ে যেতে বসেছে। থাক্ সে কথা।
নদীকেন্দ্রিক সিনেমা এর আগেও হয়েছে- ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ও ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এখানে যুক্ত হলো ‘হালদা’। পুরো সিনেমায় হালদার মানুষের জীবনযাপন, জীবনের টানাপোড়ন, নদী-মাছকে ধ্বংস করবার উপায়- ইটভাটা, ইটভাটা টিকিয়ে রাখবার ক্ষমতার কারসাজি, মানুষের প্রতিবাদ, অবশেষে সরকার কর্তৃক সিলগালা করা দেখানোর সাথে সাথে চমৎকার উপায়ে দেখানো হয়েছে মাতৃত্বকেও। মা-মাছের প্রতি অগাধ ভালোবাসা দেখানো হয়েছে, যেই ভালোবাসার সততা টেকে না পেটের তাড়নার কাছে। রাতের আধারে মা-মাছ মেরে বিক্রি করলেও মনু মিয়ার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় পাপবোধের দুঃস্বপ্নে। সে কাঁদতে থাকে নিজের পাপবোধে, অন্যদিকে অনেকেই এই মা-মাছ শিকার করে বিক্রি করে অসচেতনতায়। পেটের দায়ে মনু মিয়াকে যেমন সবচেয়ে আপন মা-মাছকে ধরে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে, সিনেমায় দেখানো হয়েছে পেটের দায়ে কিভাবে সবচেয়ে আপন কন্যা, যে ‘ভবিষ্যত মা’ তাকেও পুঁজিপতি জমিদারের কাছে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। এখানে কন্যা সন্তান হাশুকে মা-মাছের সাথে প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।
হাশুর মা-মাছের প্রতি ভালোবাসা, মা-মাছের মৃত্যুতে শোক, প্রতিবাদ এসবে তা ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। মা-মাছ রান্না না করবার প্রতিবাদে তাকে মার খেতে হয় পুঁজিপতি জমিদার স্বামীর কাছে যেখানে ‘বৌ পেটানো’ একটি সংস্কৃতি। হাশুর তথাকথিত অবৈধ সন্তানকে মেরে ফেলবার হুমকিও দেয় মা-মাছখেকো পুঁজিপতি জমিদার স্বামী। অথচ সে সবার সামনে প্রকাশ করে না এই সন্তান তার নয় এবং আদতে সে নপুংসক। এ প্রকাশ যে একজন পুরুষের পুরুষত্বকে নড়বড়ে দেয়- এ যেন তারই বহিঃপ্রকাশ, এবং একইসাথে নিজের বংশ টিকিয়ে রাখবার জন্য উত্তরাধিকারের অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তাও তাকে নিরব থাকতে একপ্রকার বাধ্য করে।
হাশু পালিয়ে ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর বাঁধে। তাকে পালাতে সাহায্য করে বাড়ির বড়-বৌ বা তার ‘সতীন’ যে সন্তান জন্ম দিতে না পারার দোষে দোষী এবং তার পরিচয় গিয়ে ঠেকে দাসীর পর্যায়ে। এদিকে হাশু যখন গর্ভবতী হয়, তখন তার আদর যত্ন বেড়ে যায়, কারণ সে সেই বংশের ধারককে ধারণ করছে! এখানেও গ্রামীণ পিতৃতান্ত্রিক যে চলমান প্রক্রিয়া তা পরিচালক সুনিপূণভাবে ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছেন।
অন্যদিকে বড়-বৌ সন্তান ধারণে অক্ষম ‘বাঁজা’ হবার কারণে এবং সতীন গর্ভবতী হবার কারণে তার যে ভবিষ্যত নিরাপত্তাহীনতার ক্রাইসিস, তাও ফুটে উঠেছে এবং শুধুমাত্র এই ভয়ে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে দু’বার। এদিকে আমাদের সুরত বানুর নিজের একটুখানি পরিচয়ের আকুতি কী তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে! সে নিজের নামটা পর্যন্ত এতো বছরে কখনো শোনেনি! নিজের নাম শুনবার আকুতিতে সে প্রতিবাদী ছোট বৌকে নিজ নামে ডাকতে অনুরোধ করে। নারীর পরিচয় যেভাবে এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিলীন হয়ে যায় ধীরে ধীরে এবং তাতে নারীর ভেতরে যে অপ্রকাশিত আকুতি কষ্ট থেকে যায়, তা এই দৃশ্যে ফুটে উঠেছে। সুরত বানুর যেনো প্রতিবাদী হাশুকে দেখেই নিজের মরে যাওয়া পরিচয়কে মনে পড়ে!
হাশু কিন্তু পালিয়ে গিয়েও পালাতে পারে না, তাকে আবার ফেরত আসতে হয় পুঁজিপতি জোতদার স্বামীর ঘরে। আর তার সন্তানের পিতা ভালোবাসার মানুষকে মেরে ফেলা হয় আগুনে পুড়িয়ে। সিনেমায় সন্তানের বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে যতটা চিন্তা নাদের চৌধুরী আর তার বড়-বৌ জুঁইয়ের মাঝে ছিলো, তার ছিটেফোঁটা আমরা দেখতে পাই না হাশু কিংবা বদীর মাঝে। হাশু আর বদী যেনো প্রকৃতির অংশ, যেখানে মাছেদের সঙ্গমের বৈধতার প্রয়োজন পড়ে না, ঘর বাঁধতে বৈধতার প্রয়োজন পড়ে না, প্রয়োজন পড়ে না পিতৃত্বের পরিচয়ের।
হাশু সবশেষে নিজেকে মুক্ত করে তথাকথিত স্বামীকে খুন করে, ঠিক এই দৃশ্যের আগেই হালদার মা-মাছেরাও মুক্তি পায় ইটভাটার কালোধোঁয়ার বর্জ্য থেকে, ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে। এখানে এসে (বা তার কিছু আগে থেকেই) হালদার মা-মাছ আর হাশু চরিত্রটি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। হাশুই যেনো হালদার মা-মাছের প্রতীক। যদিও হাশুর মুক্তি হাশু নিজেই করতে পেরেছে, মাছেদের মুক্তি নির্ভর করেছে মানুষের ওপর। গোটা প্রকৃতিই তো নির্ভর করে মানুষের ওপর। মানুষের প্রতিবাদে অবশেষে বন্ধ হয় পুঁজিবাদের গনগনে ইটভাটা। মানুষের একতাবদ্ধ প্রতিবাদ এনে দিতে পারে যে কোনো জয়- সিনেমায় এটাও স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছেন প্রিয় পরিচালক তৌকির আহমেদ।
গোটা সিনেমায় সবার অভিনয়শৈলী ভালো লেগেছে। শুধু তিশার অভিনয়ের অল্প কিছু জায়গায় ‘কী যেনো নেই’ মনে হয়েছে। তার শহুরে হাসির ঢং প্রকাশ পেয়েছে বেশ কিছু জায়গায়। এমনও হতে পারে যে শুধু আমার কাছেই মনে হয়েছে যে, কিছু জায়গায় তার ডায়ালগ শুনে মনে হচ্ছিলো শহুরে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা মেয়েটিকে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলানো হচ্ছে, যা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। তারপরেও তিশার অভিনয় বেশ ভালো লেগেছে। রুনা খানের অভিনয়ও বেশ ভালো লেগেছে। বড় বৌয়ের ঢং পুরো শরীরে এবং আচরণে ফুটিয়ে তুলতে তিনি সফল হয়েছেন। দিলারা জামান, শাহেদ আলী, মোমেনা চৌধুরীর অভিনয়ও ভালো লেগেছে।
ভালো না লাগার মাঝে একটিমাত্র বিষয় খুঁজে পেয়েছি। সেটা হলো সিনেমার গান-‘যার বুকে ঢেউ থাকে তার বুকে ঘর’। পুরো সিনেমায় আঞ্চলিক ভাষা শুনতে শুনতে শুদ্ধ প্রমিত বাংলার গানটি কেনো কেনো যেনো কানে ঠেকছিলো, মনে হচ্ছিলো সিনেমার সাথে যাচ্ছে না। এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এমনিতে গানটি চমৎকার, সিনেমায় শতভাগ আঞ্চলিক আলাপে গানটি খাপ খায়নি মনে হয়েছে।
সবশেষে বলবার মতো কথা একটি- সিনেমাটি ভালো লেগেছে। পরিচালক তৌকির আহমেদের ভক্ত হয়ে যাচ্ছি। তিনি গ্রামীণ জীবনব্যবস্থাকে, বিপন্ন হালদাকে ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণভাবে। মানুষের মাঝে তিনি হালদার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পেরেছেন, মা-মাছের প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পেরেছেন। ভালোবাসা ‘হালদা’ টিমকে।