সম্পর্ক হোক টক-ঝাল-মিষ্টি বন্ধনের

আফরোজা চৈতী:

সম্পর্ক। তিন অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ। এই সম্পর্কগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব মাধুর্য। এক একটি সম্পর্কের ভাষা এক এক রকম।
ধরা যাক বৌ-শাশুড়ি। এই সম্পর্কটার আসল তিক্ততা শুরু হয় রান্নাঘর থেকেই। না না, বিষয়টা এমন নয় যে দা-খুন্তি নিয়ে শুরু হচ্ছে! এটা যুগ যুগ ধরে চলা কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার লড়াই।

শাশুড়ি চান তার হাতে লাগাম রেখে দিতে, আর বৌমা চান তার মতো করে সব গুছিয়ে নিতে। দুটোই ভালো। লাগাম টেনে রাখাটাও জরুরি, আবার গুছিয়ে নেয়ার মানসিকতাটাও দরকার। তবে বাদ সাধেন এখানে বেচারা পুত্র বা স্বামী। তার কাছে বৌ এর রান্নার স্বাদ কখনও মায়ের হাতের স্বাদকে অতিক্রম করে, তখন তিনি বৌ এর রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করে ফেলেন। আবার কখনও তার উঠতে বসতে মায়ের রান্নার স্বাদ মুখে লেগেই থাকে, ফলে ভদ্রতাবশত বৌ এর রান্না খান ঠিকই, তবে অন্তর কান্দে মায়ের রান্নার জন্য।

অপ্রিয় সত্য হলো, ৯৯% পুরুষই জিহবা আর বিছানার স্বাদের দ্বারা প্রভাবিত হোন। সামাজিক ও ধর্মীয় কারণ ও ব্যবস্থাপনাও এর জন্য দায়ী। তো, বৌটি তো আর ঘাস খায় না, দিনের পর দিন আপ্নের জিহবা অনুযায়ী জোগান দিতে গিয়া তারই তো ক্লান্ত লাগতে পারে! কারণ সে বেচারী তো আর আপ্নের মায়ের রান্না খাইয়া বড় হোন নাই!

কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য নিজের অনেক চাহিদা জলাঞ্জলি দিয়া, জিহবা ও বিছানার ইচ্ছা-অনিচ্ছা গলা টিপিয়া মারিয়া এই সুখের সংসার রচনা করেন অনেক ত্যাগী নারী! সমাজে এখনও তাদের নিয়া ধন্য ধন্য পড়ে, ঠিক যেমন প্রাচীন বাংলায় যখন বিধবা কোনো নারী স্বইচ্ছায় তার সহমরণের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। আর তাকে সতী বলে মাথায় নিয়ে নাচা পুরোহিতরাই ঐ বিধবা বেঁচে থাকলে পাপ মোচনের নামে তাকে ভোগ করতেন।

ধর্ম যুগে যুগে কালে কালে এই পুরোহিতরাই বা ধর্ম রচয়িতা পুরুষগণ নিজ আয়েশ ও সুবিধার নিমিত্তে পরিবর্তিত পরিবর্ধিত করিয়াছেন। সেটা আরেক প্রসংগ, সেই প্রসংগে না হয় আর একদিন কথা হবে। যাই হোক কথা হচ্ছিলো, বৌ-শাশুড়ির সম্পর্ক নিয়ে। এই সম্পর্কটির মাধুর্য ধরে রাখার দায়িত্ব অনেকখানি নির্ভর করে পুত্রটির উপর। সংসার এর যাবতীয় সারটুকু আপনি উপভোগ করে বৌকে শুধুই সং সাজিয়ে রাখার চিন্তাটা বাদ দিলেই দেখবেন এই সম্পর্কের চেয়ে মধুর সম্পর্ক হয় না।

আমার শাশুড়ি মা ট্রাডিশনাল বাংলা রান্না পছন্দ করেন, আর আমি এক্সপেরিমেন্টাল রান্না করি। আজ এতোগুলো বছর পর অনুভব করি, বেচারা স্বামী আমার হাতের কতো কুখাদ্যই না খেয়েছেন! আর আমি তারে তার মাড় ফেলানো খিঁচুড়ি রান্নার তরিকা দেইখা কতোই না হাসছি!! অথচ আমার মতো কখনও বলে নাই, ছিঃ কী খারাপ খেতে! মাঝে মাঝে বৌকে প্রশংসা করুন মায়ের সামনে, আর মায়ের ভুলগুলোও তাকে ভালোবেসে বুঝিয়ে বলুন।

একসাথে এখন অনেকেই থাকেন না। এখন একক পরিবারই বেশি, কিন্তু যৌথ পরিবারের মাকে অনেক উদার মনের পরিচয় দিতে হয়। মা এরই দায়িত্ব অবাধ্য হিংসুটে আবেগী বৌটাকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেয়া। মেয়েরা কি এতোই বোকা যে আপনার ভালোবাসা পেয়েও সে ঠেলে ফেলে দেবে আপনাকে? বেশির ভাগ শ্বশুর-শাশুড়ির মানসিকতা থাকে, মেয়েটি অবনতমস্তকে তাদের সেবাদাসী হয়ে দিন গুজরান করবেন। অনেক মেয়ে করেনও সেটা। আর দিনশেষে তার ক্ষোভ বা কষ্টগুলো উগরে দেন স্বামীর উপরই। বেচারা স্বামী হয়তো বুঝতেও পারেন না, কেন বৌ এর এই মূর্তি!

আবার উল্টোটাও আছে। শাশুড়ির কিছুই মেয়েটি সহ্যই করতে পারছে না! তার আদর করে দেয়া উপহারটারও একশ একটা খুঁত বের করছেন! বিয়ের পরপরই স্বামীকে তার পরিচিত গণ্ডি থেকে ছাড়িয়ে নিজের কব্জায় আনতে চান! বেচারা স্বামী!! সত্যি মায়া হয় এই ছেলেগুলোর জন্য। তারা তখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় পড়েন। বৌ এর রান্না এতোই ভালো যে ছেলেটি মুখ ফসকে বলেই ফেলে, কী রান্ধো মা? তেল-মসলা কম দিতে পারো না?বা বৌরে বললো, এতো তেল-মসলা কম দিলে খাওয়া যায়? মায়ের কাছে রান্নাটা শিখে নিও।

এক্সকিউজ মি! রান্নাটা আপনিও তো শিখে নিতে পারতেন আপনার মায়ের কাছ থেকে? তারপর দুজনে মিলেই না হয় রসনাতৃপ্তির কাজটা করলেন। প্রয়োজনে মাকে রান্না করে খাইয়ে একদিন চমকে দিন। ঈর্ষার বীজ তো বপন আপনারাই করেন হে পুরুষজাতি।

আমার এক বন্ধুর কথা শুনে একবার চোখে জল এসে গিয়েছিল,’জানো চৈতী, আমার এখন কম খেতে খেতে আর বাসী খেতে খেতে আর টাটকা ভালো খাবার দেখলেও খেতে ইচ্ছে হয় না!’সে একটি যৌথ পরিবারের কর্ত্রী আর তার শাশুড়ি যথারীতি রান্নাঘর নিজের দখলেই রেখেছেন। তার স্বামী বাড়ীর বড় ছেলে। ছোট ভাইবোন এবং মা-বাবার চাহিদা মিটিয়ে বৌ এর খোঁজ নেয়ার সময় পান না। তো, আমার এই বান্ধবী শুধুই সেই বাড়ির লক্ষী বৌ বলে ইচ্ছা থাকলেও হাতে তুলে টাটকা খেতে পারেন না, বরং তিনি ও তার শাশুড়ি একসাথেই আগের রাতের বাসী খাবার সাফ করেন, তারপর সেই টাটকা খাবার বাসী করে খান!

কেন বাড়ীর পুরুষ লোক টাটকা খান, আর স্ত্রীগণ বাসী, সেটার সমীকরণ আসলেই জটিল। আবার পরিচিত এক খালাম্মা যিনি চাইলেও ছেলের সংসারে হাতে তুলে কিছু করার ক্ষমতা রাখেন না। কেন এই দূরত্ব? যে বাবা-মা আপনার জীবনসঙ্গীকে পেলেপুষে আপ্নেরে উপহার দিলো সেই আপ্নেই তখন ডাক্তার বা পাইলট স্বামীর গর্বে এতোই মাতোয়ারা হইলেন যে, সে যে কারো সন্তান এইটাই ভুলে গেলেন। মায়ের হাতে দশটা হাজার টাকা মাসে তুলে দিলেই দায়িত্ব শেষ? নির্মম সত্য হচ্ছে, খুব কম সৌভাগ্যবান আছেন যারা শেষ জীবন পর্যন্ত ছেলের সংসারে দাপটের সাথে রাজত্ব করেন। অথচ একটা বার ভেবে দেখুন, আপনার ভাই বৌটি যদি আপনার মায়ের সাথে একই আচরণ করতো কেমন লাগতো আপনার?

আমার শাশুড়ি মায়ের কাছে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন আমার দাদী শাশুড়ি। তাদের সম্পর্ক ছিলো টক-মিষ্টি-ঝাল। এ এক দারুণ সম্পর্কের রসায়ন। আমার ব্যাংকার শাশুড়ি নিশ্চিন্তে অফিস যেতেন পিঠাপিঠি তিন সন্তান রেখে। আর তার শাশুড়িও ছেলের চেয়ে ছেলেবৌ এর কাছেই আবদার করতেন বেশি। তাদের সম্পর্কের মিষ্টতা কখনও একটু টক বা ঝাল হয়েছে, তবে তেতো হয়নি। মায়ের রান্না তার শাশুড়ি মায়ের চেয়ে ভালো হতো, তাই ছুটির দিনে হাঁড়িতে ভাত একটু বেশিই লাগতো। এটা নিয়ে তিক্ততা নয়, বরং হাসাহাসি হতো তাদের মধ্যে! আমার শ্বশুর মশাইকে বিয়ের পর থেকেই বলতে শুনেছি এই বাড়ির জায়গা সবই তেনার (আমার শাশুড়ি মায়ের)। কখনও বৌ এর উপর আস্থা হারাননি। আবার মায়ের চাহিদাকেও সবার আগে প্রাধান্য দিয়েছেন, তার সম্মান ইচ্ছার ব্যাপারে আপোষ করেননি। আমার দাদী শাশুড়ির সাথে আমার শাশুড়ির সম্পর্ক সুন্দর থাকার একটি বড় সেতুর কাজ করেছেন তিনি।

সম্পর্কের জন্য একটা খোলা জায়গা দরকার। তাকে আঁটোসাঁটো করে রাখলেই সেই সম্পর্ক তার মাধুর্যতা হারায়! কখনও অধিকারবোধ ছেড়ে দিয়ে ভালোবাসার জায়গা করে দিতে হয়! আপনার ত্রিশ বছরের সংসারে আপনি হয়তো সারাজীবন একভাবে খাবার টেবিল গুছিয়েছেন, রান্নাঘর সামলেছেন, কিন্তু আজ একটা বার ছেড়ে দিন না আপনার ছেলে আর ছেলে বৌ এর হাতে! দায়িত্ব ছেলেকেও দিন, যেন একদিন ব্রেকফাস্ট সেও করে আপনাদের খাওয়ায়। বৌকেই আপনার উত্তরসূরি হয়ে ছেলের ও আপনার ভালোমন্দের খেয়াল রাখতে হবে কেন? আপনার ছেলে কি শ্বশুরবাড়ী গিয়ে রান্না করে একবেলা তার শালাশালী আর শ্বশুরকে খাওয়াতে পারেন না?

চর্চাটা হোক সমানে সমান। তুমি নাই আমার ছেলের খাওয়ার কী হবে বলে যেসব মা সাত আসমান কপাল চওড়া করেন, তাদের বলি ছোটবেলা থেকে মেয়ের পাশাপাশি ছেলেকেও শেখান পরের বাড়ি গিয়ে ভালোমন্দ রান্না করে অন্যদের খাওয়ানো। তাইলে তুমি নাই! আহা আমার ছেলের কষ্ট হচ্ছে বলে গলা শুকানোর প্রয়োজন হবে না! যতদিন রান্নাঘর এর দায়িত্ব একতরফা বৌ-শাশুড়ির হাতেই থাকবে, ততদিন এই দ্বন্দ ঘুচবে না। দায়িত্বটা শ্বশুর জামাইও ভাগ করে নেন, দেখবেন এই দ্বন্দ্ব অনেকটাই দূর হয়েছে।

পুরুষতন্ত্র শুধু নারীদের খাচ্ছে না স্যার! খাচ্ছে আপনাদেরও! আর তাই বলি, চলুন গড়ি সমতার পৃথিবী। তবেই জীবন হবে টক-ঝাল-মিষ্টির ভালোবাসায়।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.