তালাক নারীর কপালের তিলক

শেখ তাসলিমা মুন:

ব্রিটিশ রাজপুত্র হ্যারি একজন আমেরিকান অভিনেত্রীকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, যিনি একজন ‘ডিভোর্সড’ ওম্যান। এ খবর পরিবেশন করতে মিডিয়া বেশ রঙ লাগিয়ে, ঝাল মিশিয়ে রুচিকর করে তুলছে। অষ্টম এডওয়ার্ডের গল্পও আসছে। হ্যারির অত কসরৎ করতে হবে না। ব্রিটিশ রাজপরিবার একজন ক্যামেলিয়া পার্কারকেও ঢুকতে দিয়েছে। আজ ব্রিটিশ রাজপরিবারের ছুৎমার্গ আর অই পর্যায়ে নাই! থ্যাঙ্ক গড এন্ড লং লিভ দ্য কুইন!

বলছিলাম, ‘ডিভোর্সি’ টার্ম বিষয়ে। রাজপুত্রের বিবাহ বিষয়ে নিবন্ধ খবরগুলিতে শব্দটি বারবার আসছে। একজন ‘ডিভোর্সড’ নারী মানে তার পূর্বে একবার বিবাহ হয়েছিল। সে অন্য এক পুরুষের সাথে ‘আই ডু’ বলেছিল। পরে সে বা তার পার্টনার ‘আই কান্ট’ বলে বেরিয়ে এসেছে। বা বেরিয়ে গেছে। তাতে তার কপালের মাঝখানে একটা গর্ত হয়ে সিল পড়ে গেছে। আর তার নাম হয়ে গেছে ‘তালাকপ্রাপ্তা’ মহিলা। বিবাহ কত কুৎসিত একটি প্রতিষ্ঠান সেটি এটা দিয়েই বুঝতে পারা সম্ভব। ছেলেমেয়ে একসাথে জীবন যাপন করতে পারে। প্রেম প্রণয় থাকতে পারে, কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে সে থাকবে ‘বিবাহ বিহীন’ ‘ভার্জিন’!

যদি একজন মেয়ের পূর্বে বিবাহ হয়ে থাকে তাহলে বিবাহের মার্কেটে তার দামে ধস নামবে। নতুন গাড়ি কিনলে বছরে ৩০% দাম কমে গড়ে। গাড়ির থেকে নারীর দাম কমে যায় আরও এ ক্ষেত্রে। তার আগে একটি মালিক ছিল। এক মালিকের হাত হয়ে এসছে। তার দাম কমে গেছে ধপ করে। মানুষের দ্বৈত চরিত্র এবং ভণ্ডামি কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে ওঠে, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

বিবাহিত বা অবিবাহিত বা ডিভোর্সড বা বিধবা এখানে সেই মানুষটি কে সেটি মুখ্য নয়। সেই পারসোনালিটি কে এবং কি সেটি নয়, তার নামের আগের এ ডেজিগনেশন দিয়ে তার মুল্য এবং মূল্যহীনতা এখনও প্রকট করে তোলা হয়। যে বিয়ে টেকেনি, সেই ‘বিয়ে’র জন্যই এই ‘বিয়ের’ আইডেন্টিটি প্রকট হয়ে ওঠে।

বেশকিছু বছর আগে নরওয়ের ক্রাউন প্রিন্স এ নিয়ম ভেঙেছিল। একজন সিংগল মাদারকে ভালবেসে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে এনেছিল। মিডিয়ার ইনিয়ে বিনিয়ে এ বিষয়কে হাইলাইট করা দেখে বুঝেছিলাম মানুষ দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায় আসলে। এক ইঞ্চিও সামনে যায়নি।

আমাদের পরিবার এবং সম্পর্কগুলোর অতি প্রয়োজনীয় পরিবর্তিত কনসেপ্ট নিয়ে মানুষের মনের ভেতর এখনও যে কোন আগ্রোহ ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়নি, সেটি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটলেই পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়।
মানুষ এখনও অন্যের তৈরি করা ছকে পা দিয়ে চলে যাচ্ছে এবং বলে যাচ্ছে। নিজের ভেতর যে একজন আছে সে কে তার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার মাথার টিউব লাইট এখনো জ্বলেনি।
মানুষ! তালাক দেওয়া বা পাওয়া কোন গর্হিত অপরাধ নয়। সেজন্য সে ‘পতিত’ হয়ে যায় না। পতিত হয় তার নিচুতায়, অসততায়, ঘৃণ্যতায়। বিবাহ বিচ্ছেদে সে ‘মন্দ’ মানুষ হয় না!

সম্পর্ক বিষয়টি ম্যাচিং এর। মানুষ তার সঠিক সঙ্গী পেতে সঙ্গী হিসেবে মানুষটিকে দেখবে। তার গুণাবলী দেখবে। তার বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ দিয়ে তাকে নিক্তিতে মেপে দাম নির্ধারণ করার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়। সে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সাহস চর্চার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া এবং থাকা উচিত নয়।

(লেখাটি শেখ তাসলিমা মুনের ব্লগ থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.