ছত্রিশে বিয়ে করতে কলিজা লাগে বটে!

কামরুন নাহার:

ছত্রিশে বিয়ে!! মেয়ের কলিজা বটে! কীভাবে সম্ভব! এতো বুড়ো মেয়েকে কেউ বিয়ে করে! ক্যামনে কী!! আমার বরটাও আমার মতো বুড়ো! বুড়ো বয়সে, বুড়ো মেধায়, বুড়ো জ্ঞ্যানে, বুড়ো মননে আর প্রগতিশীলতায়! আচ্ছা, এটা ওনার দ্বিতীয় বিয়ে নয়তো! ফেসবুকে ছবি দেখার পর অনেকে এমনও বলেছেন।
অনেকে ইনবক্সে বলেছেন, অনেকে সামনা সামনি ‘ও আপনি তাহলে একা থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন’! আমি বসে বসে সব দেখি, হাসি, মজা পাই। না, আমার একটুও রাগ হয় না। লেখাপড়া জানা, নিজেকে সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত দাবি করা আমি যদি এসব কথায় মন খারাপ করি, তাহলে কীভাবে হবে?

হাঁটু সমান লম্বা, রেশমের মতো, খুব সুন্দর চুল ছিল আমার। কিন্তু আমি নিজেকে কখনও রেপুঞ্জেল ভাবিনি। ভাবিনি বা বলা চলে ভাবতে শিখিনি যে সাদা ঘোড়ায় চড়ে টগবগ করে রাজপুত্র আসবে, আর আমার খুলে দেয়া লম্বা চুল বেয়ে সে উপরে উঠে আসবে; আবার আমায় তার সাথে ঘোড়ায় করে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ মেয়েদের স্বপ্নের রাজপুত্র টাইপ যে স্বপ্ন থাকে, আমার সেসব কোন কালেও ছিল না।

মেয়েদের বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়, ওটাই তার ঠিকানা, এই জাতীয় কথা আমার পরিবার থেকে কখনও বলা হয়নি। বিয়েটা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে দরকার, এটা আমাকে বলা হয়েছিল। তাই বিয়েকেই জীবনের ব্রত মেনে বড় হইনি।
যে সমাজ পুরুষ শাসন করে, সে সমাজে তাদের উপর যাতে নিরন্তর নির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে না হয়, সেই যোগ্যতাটা অর্জন করে, নিজের মতো নিজের একটা জীবন যাপন করে আমার যখন মনে হয়েছে, তখনই বিয়ে করেছি। বিয়ে করার জন্য আমার ঘর থেকে কেউ আমায় প্রেশার দেয়নি। আমার ইচ্ছে হয়েছে আমি বিয়ে করেছি।

বিয়ের শারীরিক যোগ্যতা এবং সামর্থ্যের তুলনায় মানসিক যোগ্যতাটা অনেক বেশি দরকার। আমি তখন যদি নিজেকে রেপুঞ্জেল ভেবে সারাদিন চুলের যত্ন করতাম, তাহলে এই যে আজকে নিজের ইচ্ছেমতো জীবন বেছে নেয়া, সেটা সম্ভব হতো না। আমি বলছি না, আমি খুব হাতিঘোড়া কিছু মেরে ফেলেছি, কিন্তু নিজের অর্থনৈতিক মুক্তিটা তো আমি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। একা থাকার যোগ্যতা আমি হারাইনি, বরং এখন আরও শক্তভাবে বিশ্বাস করি একা থাকতে ভয়ঙ্কর যোগ্যতা লাগে। যুগল জীবনে আসার পর আমার অনেক কিছু সহজ হয়েছ।

এই ৩৬ এর আমি নিজেকে ১৬ বছরের তরুণীই ভাবি – কারণ আমার মন চির তরুণ। ভাবতে পারেন অনেকে যে আপনার ইচ্ছা হলো আর আপনি বিয়ে করে ফেললেন, এতো সহজ! সহজ তো বটেই! নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারলে বিয়ের পাত্রের অভাব হয় না (যোগ্যতার মাপকাঠিটা যদিও আপেক্ষিক)। আর আমার তো একযুগের ভালবাসার বিয়ে! বিয়ে করা না করা, একা থাকা না থাকার ব্যাপারটা হোক প্রতিটি মেয়ের ইচ্ছের অধীন। না, বিয়ের পাত্রী হিসেবে যোগ্য হবার জন্যই মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে সেটা বলছি না – লেখাপড়া শিখে প্রতিটা মেয়ে নিজের মতো একটা জীবন বেছে নেবে; স্বাধীন- স্বনির্ভর হবে, সেটাই হোক সব মেয়েদের প্রত্যয়। সেই জীবনে বিয়েটা একটা অনুষঙ্গ হোক, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ যেন না হয়!

এই দেশের প্রতিটি মেয়ে বিয়ের পর বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি এই দুই বাড়ির কোনো এক গলিতে তার পরিচয় হারিয়ে ফেলে। আমি সেটা হতে দেইনি। কারণ আমি স্বনির্ভর, সাবলম্বী; বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি কোন বাড়িও যদি আমার না থাকে, সমস্যা নেই। নিজের বাড়িতে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেই আমি বিয়ে করেছি। প্রতিটা মেয়ে নিজের বাড়িতে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে তবেই বিয়ের পিঁড়িতে বসুক।

আর বয়স! সেতো একটা সংখ্যা মাত্র! শরীরের বয়স বাড়ে, কিন্তু মনন, মেধা যদি থাকে তারুণ্যে ভরপুর, তাহলে মনের বয়স বাড়ে না কখনও। আর মনের তারুণ্য দিয়েই ধরে রাখতে হয় শরীরের তারুণ্যকে।

সহকারী অধ্যাপক
বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.