সাদিয়া রহমান:
গর্ভধারণ ব্যাপারটা নিতান্ত প্রাকৃতিক হলেও এর সাথে জড়িত অনেক কষ্ট এবং ধৈর্য্য। এই সময়ে নারীকে যেতে হয় বড় ধরনের হরমোনাল পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে। যার সাথে জড়িত বড় ধরনের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তন। সব পরিবর্তন এবং প্রচলিত প্রথাগুলো মাঝে মাঝে নারীকে এতটা ভীতির মাঝে ফেলে দেয় যে, সে এটাকে জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাগুলোর মাঝে একটা মনে করে।
অনেকের কষ্ট হয় মাতৃত্বকে আপন করে নিতে। কিন্তু গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব এমন একটি প্রক্রিয়া যা প্রতিটি মানুষের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে পারে। এই ভীতি দূর করার এবং এটি সহজ করার সবচে বড় উপায় হচ্ছে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা। এই আস্থাকে মূল ভিত্তি বানিয়ে আরো কটি ধাপ অবলম্বন করলেই এই সময়টা হয়ে উঠতে পারে অনেক সহজ এবং আরামদায়ক।
প্রথমত, নিজের শরীরের ওপর আস্থা রাখতে হবে। বিবর্তনের শুরু থেকেই নারীরা সন্তান জন্ম দিয়ে আসছে। এমনকি, মানুষ বাদে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়াটা সাধারণত স্বয়ং সম্পূর্ণভাবেই করেই থাকে। অনেক প্রাণী আছে যারা এই প্রক্রিয়াটা রাতের আঁধারে নিরিবিলিতে বিঘ্নহীনভাবে সারে। মানুষের ক্ষেত্রে সুবিধাটা হলো, সে অন্যের সাহায্য পায়, যেটা আসলে খুবই প্রয়োজনীয়। এই সাহায্যের পাশাপাশি প্রয়োজন নিজের শরীরের ওপর আস্থা। কেননা শরীর নিজের ধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। তাই গর্ভাবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিজের শরীর নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকা।
দ্বিতীয়ত, এই পুরো প্রক্রিয়াতে কারা পাশে থাকবে সেইসব মানুষ বেছে নেয়াটা খুব জরুরি। এটা নিজের ওপর ভরসা রাখতে সহায়তা করে। সেই মানুষগুলো হতে পারে তার বাচ্চার বাবা,তার মা, বন্ধু অথবা মিডওয়াইফ। ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা মাথায় রেখে, আর্থ সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে এই সঙ্গী নির্বাচন করা উচিত। এমনকি একজন ভালো আলোকচিত্রীও হতে পারে একজন ভালো সঙ্গী। যে আসলে মূল্যবান মূহুর্তগুলোকে ধারণ করে সময়টা করে তুলতে পারে চিরস্মরণীয়।
এরপর যেটা খুবই গুরত্বপূর্ণ, তা হলো, ইতিবাচক চিন্তা। একজন গর্ভবতী মায়ের উচিত সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করা এবং ইতিবাচক পরিবেশ বজায় রাখা। লেবার পেইন সম্পর্কে অনেক ধরনের কল্প কথা প্রচলিত আছে, যা স্বাভাবিকভাবেই প্রথমবার গর্ভ ধারণ করছে এমন মায়েদের মনে ভয় জাগাতে পারে। কিন্তু সেসব নিয়ে চিন্তিত হবার প্রয়োজন নেই, কেননা প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আলাদা এবং নতুন। কেউ যদি সেসব গল্প শোনাতে চায় তবে অন্তত জন্মদান পর্যন্ত তা এড়িয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কখনও ভীতিকর কোনে সিনেমা না দেখা, ভালো, পছন্দের গান শোনা, ভালো মানুষের সঙ্গ এসময়টাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা গবেষণায় দেখা গেছে, এসময়টাতে গর্ভে থাকা শিশুর সাথে কমিউনিকেট করা সম্ভব। সেজন্য কথা বলতে হবে তার সাথে। মা-বাবা, বা পরিবারের যে কেউ এটা করতে পারে। তাকে গল্প পড়ে শোনানো, গান শোনানো সবই করা যেতে পারে। এতে নিজের মনটাও ভালো থাকে।
যারা এই নয় মাস সময়টিতে নিয়মিত চেকাপ করান তাদেরকে ডাক্তাররাই অনেক ধরনের কৌশল শিখিয়ে থাকেন এসব দুঃশ্চিন্তা দূর করে মনকে উৎফুল্ল রাখার। “দ্য ক্লোক অফ প্রটেকশন” পদ্ধতিটা খুবই কার্যকর, যা জন্মদানের পরেও জীবনে কাজে আসতে পারে।
চতুর্থ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সম্পূর্ণ ভারমুক্ত থাকা। ভারমুক্ত মন শরীরের পেশিগুলোকে সহজ রাখে, যা জন্মদান প্রক্রিয়া সহজ করে। মেডিটেশন অথবা সাধারণ সুখী, ইতিবাচক চিন্তা মনকে ভারমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
এরপর হলো শ্বাস প্রশ্বাসের ধাপ। ভারমুক্ত মন পূর্ণ শ্বাস প্রশ্বাসে সাহায্য করে, যা জন্মদান প্রক্রিয়ার জন্য খুবই সহায়ক। শ্বাস প্রশ্বাস সহজ করতে দুই ধরনের হালকা ফুসফুসের ব্যায়াম করানো হয়ে থাকে, যা লেবার পেইনের সময় এবং সার্জারির সময় কাজে দেয়। একটা হলো ৫ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টা দিকে গোণা, আরেকটিকে বলে “ওয়েভস অফ রিলাক্সেশন”। এই দুটোই পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরকে সহজ করতে বেশ সাহায্য করে।
লেবার পেইনের সময় অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাটাকে বের করার জন্য পুশ করা বা ধাক্কা দেয়ার প্রবৃত্তিটাই তাৎক্ষণিকভাবে বেশি কাজ করে। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত পুশ অনেক সময় প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে পারে। তাই এর ওপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতেও প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
সর্বোপরি বাচ্চার সাথে মানসিক এবং শারীরিকভাবে একটা বন্ধন তৈরি করে নিতে হবে। একটা বাচ্চা যা মায়ের ভেতরেই বেড়ে উঠছে; তার ছোট্ট চলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে গতিবিধি সবকিছুর সাথেই একটা ভালোবাসার বন্ধন, একটা সমঝোতা তৈরি করে নিলে লেবারের সাথে সাথে সেই বন্ধন আরও দৃঢ় হবে এবং তাতে কষ্টটাও কমে যাবে অনেকখানি। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মেয়ের শরীরই তৈরি হয় সন্তান জন্মদানের উপযুক্ত করে। ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ না, কাজেই যাদের সমস্যা থাকে, তাদের কথা আলাদা। আর যারা সুস্থ আছেন, সবকিছু যাদের ঠিক আছে, তারা অনায়াসে হেসে-খেলেই নয়টা মাস কাটিয়ে দিতে পারেন, এবং কোনরকম কাঁটাছেড়া ছাড়াই সন্তান জন্ম দিয়ে মাতৃত্বের অনাবিল সুখটুকু পেতে পারেন।
তথ্যসূত্র: বিদেশি নিউজ অবলম্বনে