সংসারে সবার দায়িত্ব ‘ফিফটি ফিফটি’ হওয়া চাই

আফরোজা চৈতী:

কিছু কথা কইতে মন চাইতেছে।
নারী-পুরুষের জীবনে বিয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি এই বিয়া না টিকলে বা ভালো বাসাটা হঠাৎ কদর্য বাসায় পরিণত হইলেও চোখ কপালে তুইলা হা-পিত্যিশ করনের কিছু নাই! জীবন একটাই, এই সাধের জীবন বারে বারে আসবে না। আর তাই এই সাধের জনম আমি কেমনে কাটাবো এইটা একান্তই আমরা ব্যাপার।

একজনের সাথে আর একজনের বনিবনা হইলো না বইলা মাথায় পাহাড় ভাইঙা পড়নের কিছু নাই! এই দুইন্যাতে একটা বিষয় এর গ্যারান্টি আছে, আর সেইটা হইলো পটল তোলা মানে মৃত্যু। আর তাই কারো সাথে বিশ-ত্রিশ বছর একসাথে থাইকাও তারা আলাদা হইলে এইটা ঠাডা পড়নের মতো কিছু নাও হইতে পারে। সবাই আমার মতন সোনায় বান্ধানো কপাল নিয়া শ্বশুরবাড়ি যায় না, আর তাই আমার কথা থাক।

যা কইতে চাইছি তা হইলো এই বিবাহ, দাম্পত্য এই বিষয়গুলানের কিছু দায়িত্ব, দায়বদ্ধতা থাকে। এইখানে দুইটা মানুষের পাশাপাশি দুইটা পরিবারের মইধ্যে সংযোগ ঘটে। বিবাহ পুরোপুরিই একটি সামাজিক প্রথা। আর তাই কিছু সামাজিকতা, সম্পর্কের দায়বদ্ধতা থাইকাই যায়। এর দায় কুনুদিন একতরফা না, দুই তরফা। এই দুই তরফের সম্পর্ক তখনই ঠিক থাকে, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার দড়ি বাঁধাটা শক্ত থাকে।

বিয়ার পর এই দুইজনের মধ্যে তৃতীয় কাউরে জায়গা (সন্তান বাদে) দেয়ার আসলে কুনু জায়গা, সময় কিছুই থাকে না।একটা খুব শক্ত বাঁধাই করা জায়গা আম্নেরে রাখতেই হইবো বাপ-মায়ের জন্য। কারণ তারাই আম্নের সুখের সংসারে লক্ষী।হমম আমি জানি শাশুড়ী মা কখনই নিজের মা হোন না, কিন্তু শাশুড়ী মা তো শাশুড়ী মা-ই। তারে সেই জায়গাটা দিলেও দেখবেন তিনি সেই সোনায় বান্ধানো স্থানেই আছেন। কারণ তিনিই আম্নের ভালোবাসার মানুষটারে আম্নেরে উপহার দিসেন। ভালোবাসার মানুষটা সে আম্নের জানু হউক, আর বাবুর বাপ হউক, তিনি আসমান থাইকা পড়েন নাই! আম্নের এই উপহার তিনি দশ মাস পেটে রাইখা খাওয়াই পরাই বানাইয়া তারপর আপ্নেরে দিসে। কাজেই শাশুড়ী মারে তার সম্মানটা দ্যান, তাইলে দেখবেন সেও আপনেরে মেয়ে না হইলেও বৌমার মতো ভালোবাইসপে।

সম্পর্ক একতরফা না দুতরফা। একটা মেয়ে তার বিশ-বাইশ বছরের চেনা গণ্ডি থাইকা আইসা পড়ে নতুন পরিবেশে। এই সময় তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার স্বামী। তার সবরকম ভালোমন্দের দায় কিন্তু নিতে হইবো স্বামীরেই। এই উপমহাদেশের ছেলেরা বিয়ে করতে যাওয়ার সময় বলে, মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাই। ঘটনাটা যে কতটা সত্য, এটা বিবাহিতা এবং জমিয়ে সংসার চালিয়ে যাওয়া মেয়েরা হাড়ে হাড়ে টের পান।

ভাইরে, আপনার যেমন আদরের বোনটি সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমায়, গেলাস থাইকা পানি গড়ায়ে খায় না, হাত পুড়ে যাবে বলে চুলোর কাছে যাইতে দেয়া হইতো না, তেমনি এই মেয়েটারেও তুলায় মুইড়া রাখা হইছিল, তারেও কেউ ফুলের টোকা দেয় নাই! এই নতুন বৌমাটাও তার বাড়ির অনেক আদরের মেয়ে ছিলো, তারও অনেক রাত জাইগা দেরিতে উঠার অভ্যাস, কষা মাংস দিয়া পরোটা খাইতে পছন্দ তার, ইলিশ মাছ না ভাইজা মাখায়া খাইতে তার পছন্দ, সেও জীবনে কলসী গড়াইয়া পানি খায় নাই! বাবার আদরে আহলাদে সেও বড় হইছে!

অথচ শাশুড়ি মায়েরা ধইরাই নেন পোলা বিয়া দিয়া বাড়িতে একটা দাসী আনছেন, আপনের সেবা করনের লাইগা। তার নিজের জীবনের স্বাদ নেয়ার সব অধিকার তার শ্যাষ। এখন সে আপনাদের যাবতীয় হুকুম তামিল আর খেদমতে বাকি জীবন পার করবে! কী হাস্যকর!!!
(পেট ফাইটা হাসি হা হা হি হি হো হো,,,, ,,)

তারে মেয়ে না ভাবতে পারেন, অন্তত দাসী ভাইবেন না! সে আপনের ঘরের লক্ষী, আদরের বৌমা! সেই সম্মানটা, ভালোবাসাটা দেন! সেই বাপ-মা ছাইড়া আসা মেয়ের জীবনটারে নিষেধের শেকল দিয়া না বাইন্ধা ছাইড়া দেন, দেখবেন যে সম্মান, আদর, ভালোবাসা যত্ন আপনি তারে দিতেছেন, সেই একই ভালোবাসা সে ফিরাই দিবে আপনেরেও। আমার শ্বশুর বলেন, মেয়ের চেয়ে বৌমার অধিকার বেশি, আর আদরটা, যত্নটাও সে বেশি পাবে। কারণ সে পরের মেয়ে, আমার আমানত। সে যেন আমার কারণে উহ্ উচ্চারণও না করে!

কয়জনা ভাবেন এরকম? মন জুগিয়ে, মানিয়ে চলা কেন শুধু মেয়ের বেলায়? কেন মানিয়ে নেবেন না তার শ্বশুরবাড়ীও?

আমার বিয়ের পর আমার শ্বশুরবাড়ীর সবাই মানিয়ে নিয়েছিলো আমার পেশা, আমার আচরণ, আমার জীবনধারার সাথে।আমাকে কোনদিন শুনতে হয়নি, ওমা এ আবার কী চাকরি, দিন রাতের বালাই নেই! অফিস থেকে ফিরে কাজের লোকের হাতের রান্না খেতে আমার বরের কখনও খারাপ লাগেনি! আমারও খারাপ লাগেনি ছুটির দিনে জমিয়ে রান্না করা, ঘর সাফাই বা কাপড়ধোয়া। আমার শ্বশুরকে দেখেছি, কাজের লোক না এলে থালাবাসন নিজেই ধুয়ে এনেছেন। আর তার ছেলে কতদিন অফিস থেকে ফিরে কাপড় ধুয়েছে! আমার ভীষণ শ্রদ্ধা জেগেছে এই পরিবারটির উপর। আমার কষা মাংস পছন্দ, তাই শাশুড়ী মা আলাদা করে কষিয়ে বাটিভরে মাংস রেখে দিয়েছেন ‘আমার চৈতী খাবে’!
ডানপিটে, বেয়াড়া আমি একটু একটু করে কবেই যেন সংসার নামের এই বৃত্তে গিন্নীবান্নি হয়ে জমিয়ে বসেছি, বুঝতেই পারিনি!!

তবে বেয়াড়াপনা ছাড়ি নাই। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ের পথে, পা ডুবিয়ে সাঁতার কেটে নদী এঁফোড়-ওঁফোড় করি এখনও! একটাই তো জীবন! মেয়েগুলানরে এট্টু বাঁইচপার দ্যান আপনারা, শুধু আপনের ঘর আর বাচ্চা পালার জন্য এই দুইন্যায় সে আসে নাইক্কা, তারও জীবনের স্বাদ নেয়ার অধিকার আছে, তারও কেওক্রাডং পাহাড়ের সকাল দেইখপার মুঞ্চায়, আদিবাসীর লগে বইসা পাহাড়ি গান গাইতে ইচ্ছা করে!!

আপ্নের কিইন্যা আনা বান্দী না, তারও শখ, ভালো লাগা খারাপ লাগা আছে!!ভরা জোসনায় তারও ভিজতে ইচ্ছা করে আপনের হাত ধরে!

খোলা হাওয়ায় তারে নিঃশ্বাস নেবার দ্যান,তার খুশীর খবর নেন, তারে তার আনন্দ নিয়া জীবনটা কাটানোর সুযোগ দেন, দেখবেন আপ্নের জীবনও সে ফুলে ফলে ভালোবাসায় ভইরা দিবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.