নারীর মাতৃত্ব ও প্রজনন ক্ষমতা-দুই নিয়েই পুরুষতন্ত্রের প্রাচীন ষড়যন্ত্র

শেখ তাসলিমা মুন:

নারীর মাতৃত্ব এবং প্রজনন ক্ষমতা ভীষণ আলাদা দুটি বিষয়। দুটি নিয়েই পুরুষতন্ত্রের ষড়যন্ত্র অনেক প্রাচীনকালের। এ দুটি বিষয় নিয়েই পুরুষের রাজনীতি এবং দুটি বিষয়ই খুব দরকারি বিষয়। পুরুষ সেখানে ক্ষমতাহীন।

মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে অনেক কিছু শেখে। তারা চাষ করতে শেখে। জমি দখল করতে শেখে। তারা রান্না শেখে। তারা গোত্র তৈরি করতে শেখে। গোত্র থেকে পরিবার। এই পরিবারের প্রথম বলি নারী। নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে দখল করা হয় পরিবার পত্তনের মাধ্যমে। পরিবার প্রথার আগে নারী তার পছন্দ অনুযায়ী সঙ্গী নির্বাচন করতে পেরেছে এবং তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তখন নারীর আপন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। পরিবার প্রথার মাধ্যমে নারীর সে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় পুরুষের হাতে। নারীর যৌন ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার সাথে নারীর বায়োপ্রোডাক্টিভ ক্ষমতা চলে যায় পুরুষের দখলে। পুরুষতন্ত্র পত্তনের শুরু এবং নারীর প্রজনন ক্ষমতা হরণ।

গোত্রের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক ওতপ্রোত। পুরুষ পেশী বলে জমি অরণ্য পশু দখলের সাথে সাথে নারী দখল করতে শিখলো। ক্ষমতার সাথে তাই নারীকে কুক্ষিগত করা পুরুষের জন্য অত্যন্ত দরকারি হয়ে ওঠে। মানুষের ভেতরের একটি নেগেটিভ ইন্সটিংক্ট ‘প্রভুত্ব’। সেটির বিকাশে তারা মুগ্ধ হলো। প্রভুত্বে আনন্দ পেতে শুরু করার সাথে অন্যদের দাসত্ব বিষয়টি চলে এলো। উপনিবেশবাদ থেকে সামন্তবাদের স্বাদে তারা গোত্র এবং পরিবারকে বিকশিত করতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু হয় নারীর কপালে চিহ্ন দেওয়া। নারীকে ট্যাগ করা। নারী তার তার মালিকানাধীন সম্পত্তি। নারীর যোনি এবং জরায়ুর মালিকানা স্থায়ী করা এবং তার প্রজনন ক্ষমতা।

নারীর প্রজনন ক্ষমতা বেদখল হলো এভাবে, শরীর তার প্রজনন ক্ষমতা তার কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলো পুরুষ। পতিত জমি দখল করে চাষাবাদের মতো নারীর প্রজনন ক্ষমতাকে তারা দখল করলো। নারীর শরীরও তাদের কাছে হলো শস্যক্ষেত্র। যেখানে বীজ বপন করা হবে। ফসলের মালিক হবে পুরুষ। তারা গোত্রের এবং বংশের শক্তি বৃদ্ধি করবে। পুরুষই প্রথম বোঝে নারীর শরীর ছাড়া এ বিষয়টি সম্ভব নয়। তার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার ক্ষমতাহীনতা এখানে সীমাহীন সেটি তারা বুঝতে সক্ষম হয়। যত সীমাহীন তার অক্ষমতা তত সে দখল পরায়ণ।

ডিএনএ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত, নারীর গর্ভের সন্তান ‘তার কিনা’ সে বিষয়ে শতকরা ৯০% পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় ভেবেছে, সন্দিহান হয়েছে। এ অক্ষমতা নিয়ে তাকে মেনে নিতে হয়েছে পুরুষ তার পিতৃত্ব নিয়ে নারীর মুখাপেক্ষী। নারীকে গৃহবন্দী এবং অজ্ঞ রাখার প্ররোচনার শুরু সেই প্রাচীনকালের।

যে প্রজনন ক্ষমতা নারীর অথচ তার উপর দখলদারিত্ব পুরুষের, নারী বুঝলো, পুরুষ পৃথিবী কুক্ষিগত করতে নারীর দেহকে কুক্ষিগত করে রেখেছে এবং নারীকেই অবদমিত রাখার প্রক্রিয়ায় অবশ্যই নারীকেই তার প্রজনন ক্ষমতাকে মুক্ত করতে হবে পুরুষের তাঁবেদারি থেকে। এ ক্ষমতা একটি বড় ক্ষমতা এবং এ ক্ষমতার মালিক নারী।

সে অর্থে প্রজনন ক্ষমতাকে নারীর অধিকারে আনা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ নারীর এ বিষয়ে সচেতনতা। নারীকে সচেতন হতে হবে তার এ ক্ষমতা বিষয়ে। এটি তার শরীরের একটি অতুলনীয় প্রক্রিয়া যার গর্বিত অংশিদার শুধু নারী নয় সে তার মালিক। তাকে তার শরীরকে সেজন্য জানতে হবে। তাকে তার শরীর স্টাডি করতে হবে। তাকে জানতে হবে এ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ডিটেইলস শুধু গর্বেরই নয় আনন্দের। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারী তার এ ক্ষমতাকে বহন করে, কিন্তু জানে খুব কম। একজন নারী এ বিষয়ে যত জানবে, তত সে তার ক্ষমতাকে অনুভব করবে। তার আত্মবিশ্বাস, নিজের প্রতি ভালবাসা সম্মান অনেক বেশি বেড়ে যাবে।

সে আত্মবিশ্বাসের স্বাদ নারী যাতে না পেতে পারে সেজন্য নারীর ব্রেইন ওয়াশ করা হয় নানা ভাবে। তার ভেতর বড় একটি নারীর এ ক্ষমতাকে ‘মা’ রোলে পরিণত করা। বাড়াবাড়ি রকমের ইমোশন ঢালা। আদর্শায়িত করা, ‘নারী মা নারী জায়া নারী কন্যা’ মন্ত্র ও আফিমে নারীর ভেতর বাহির ওয়াশ করা। কিন্তু অবশ্যই এর কিছুই নারীর ক্ষমতা নয়। এগুলো নারীর বিরুদ্ধে সোশ্যাল ষড়যন্ত্র যা পুরুষতন্ত্রের সূচনালগ্নে নকশায়িত।

নারীর ক্ষমতা যেমন রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, লৈঙ্গিক এবং নেতৃত্বের। নারীর আরও বড় ক্ষমতা তার প্রজনন ক্ষমতা। আর এ ক্ষমতার সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.