প্রবাসের লোভে, ফাঁদে জীবন

শাফিনেওয়াজ শিপু:

রুবিনা, আজ থেকে প্রায় সাত বছর আগে অনেক আশা নিয়ে এসেছিলো বিলেতে স্বামীর সংসার করতে। তার মতো অনেক মেয়েরই স্বপ্ন থাকে বিদেশে অবস্থানরত ছেলেকে বিয়ে করা। কিন্তু একটা সময়ে রুবিনার সেই স্বপ্ন দু;স্বপ্নে পরিণত হলো। তখন রুবিনা পড়তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে। তার আশেপাশের অনেকেরই বিয়ে হয়েছে বিলেতে থাকা ছেলের সাথে। তারপর থেকে তারও ইচ্ছে হলো যদি কখনো সে বিয়ে করে তাহলে বিদেশে অবস্থানরত ছেলেকেই বিয়ে করবে।

অবশেষে তার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো, মানে বিয়েটা সম্পন্ন হলো বিলেতে থাকা প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে এবং সেই ছেলে মানে তার স্বামী সেখানে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে চাকুরী করছে। ঐ সময়ে রুবিনার পরিবার চিন্তা করেছিলো এই ধরনের ছেলে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার, তাই তাড়াহুড়া করে বিয়ের প্রোগ্রামটি সেরে ফেলেছিলো।

আর তাছাড়া শুধু যে রুবিনার স্বপ্ন ছিলো তা নয়, এমনকি তার বাবা মা এরও ইচ্ছে ছিলো বিলেতে থাকা ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া এবং বিয়েটা সম্পন্ন হলো টেলিফোনের মাধ্যমে। রুবিনার পরিবার থেকে বললো, মাস্টার্স শেষ করার পর সে বিলেতে যাবে, কারণ যাতে করে সে আবার পরে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে পারে। যাক খুব আশা নিয়ে অবশেষে পাড়ি দিলো স্বপ্নের দেশে সুখের সংসার করার জন্য। কিন্তু এইখানে এসে সে একেবারে অন্যরকম ভিন্ন চিত্র দেখতে পেলো, যা তার কল্পনার বাইরে ছিলো। ভেবেছিলো এক, কিন্তু হয়ে গেলো আরেক।

অনেক আশা করেছিলো, ইংল্যান্ডে যেহেতু যাচ্ছে, সেহেতু সংসারের পাশাপাশি হয় চাকুরী করবে, না হয় পড়াশোনা করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ আসার পর থেকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতে হয়েছিলো এই রুবিনাকে। আর যখনই চাকরি বা পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতো, তখনই অত্যাচারের শিকার হতে হতো।

তাছাড়া বিয়ের আগে জেনেছিলো তার স্বামী উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছিলো, কিন্তু আসার পর জানতে পেলো তার স্বামী নাকি একটা সময়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছিলো, যার কারণে অনার্সটাও শেষ করতে পারেনি। কিন্তু বিয়ের সময় স্বামীর পরিবার রুবিনার পরিবারের সাথে মিথ্যা বলেছিলো। তারপরও এতো মিথ্যার মধ্যেও রুবিনাকে সংসার করতে হয়েছিলো।

কিন্তু দিনের পর দিন অত্যাচারের পরিমাণ বেড়েই যাচ্ছিলো। এমনকি রুবিনা কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছিলো না। আর এই দেশে তো সে খুব একটা বেশি কাউকে চিনতো না, কারণ তার স্বামী কারও সাথে পরিচয় করে দিতো না। তারপরও এইভাবেই তিনটি বছর কেটে গেলো। এরপর একদিন হঠাৎ করে জানতে পেলো তার স্বামীর এক বন্ধুর কাছ থেকে, সে নাকি এই দেশে আরও একটি বিয়ে করেছিলো। জিজ্ঞেস করাতে সে উত্তর পেলো, এই মহিলাকে বিয়ে করার পর তার স্বামী এই দেশে পারমানেন্ট হয়েছে, এমনকি ওই সংসারে একটি বাচ্চাও আছে। শুধুমাত্র পরিবারের কথা চিন্তা করে সে নাকি রুবিনাকে বিয়ে করেছিলো। এখন রুবিনা বুঝতে পারছে, কেন তাকে বাইরে যেতে দিতো না আর কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিতো না। স্বামীর সব কুকর্ম যদি প্রকাশ পেয়ে যায়!

এরপর একটা সময়ে রুবিনা সিদ্ধান্ত নিলো এই ভাবে আর নয়। শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সের মাধ্যমে মুক্তি পেলো রুবিনা। এক কথায়, রুবিনা ফাঁদে পড়েছিল। কিন্তু রুবিনার একটাই কথা, তার মতো যাতে আর অন্য কারও জীবনে এই ধরনের সমস্যা না হয়, কেউ যাতে প্রবাসের লোভে ফাঁদে না পরে। এজন্য বাবা মায়েদের উচিত দেখে শুনে বুঝে মেয়েদেরকে বিয়ে দেওয়া বিলেতে থাকা ছেলের সাথে।

জানি, সবার কপাল এক রকম নয়, কিন্তু তারপরও যাচাই করে বিয়ে দেওয়াটা উচিত। ঠিক এই রকম আরো অনেক রুবিনা আছে এই দেশে, যাদের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে এবং মুখ বুঁজে সকল অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে, স্বপ্ন নিয়ে সবাই সংসার শুরু করে, কিন্তু সেই সংসারে যদি মিথ্যার বসতি তৈরি হয় দিনের পর দিন, তখন যে কারোর জন্য কষ্টসাধ্য হয় তা সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.