প্রতিভা রানী:
আমরা অনেকেই এই দু’টোকে একটা মানদণ্ডে গুলিয়ে ফেলি। আসলে সকল নারীবাদী যেমন পুরুষবিদ্বেষী নন, তেমনি সকল পুরুষও নারীবাদীর বিপক্ষে নন। নারীবাদী হলেই যে তাকে পুরুষবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতে হবে, তা কিন্তু নয়। নারীবাদীরা পুরুষদের ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করেন বলে সহজেই পুরুষবিদ্বেষ ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়। পুরুষদের আরোপিত নিয়মগুলো নারীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয় বলে নারীবাদীরা এগুলো নিয়ে লিখেন।
অধিকাংশ নারীই মনে মনে নারীবাদকে সমর্থন করেন, যদিও বাস্তবে মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারেন না। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতার জন্য প্রকাশ করতে পারেন না। পৃথিবীতে যেমন অনেক খারাপ পুরুষ আছে, তেমনি অনেক খারাপ নারীও আছে। তবে আমরা যে নারীমুক্তি, নারী অধিকার বলে এতো আওয়াজ তুলি, সেই মুক্তি বা অধিকার পেতে হলে সর্বপ্রথম নিজ নিজ পরিবারের দিকে খেয়াল দিতে হবে।
প্রতিটা মানুষ তার প্রথম শিক্ষাটা তার পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। যেমন একটি পরিবারে ছেলেমেয়ে সবাই থাকে, কিন্তু মেয়েরা অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ পায়। এই বিভেদটা কিন্তু আমাদের পরিবারটাই সৃষ্টি করে দিয়েছে। খেতে বসলে ছেলেদের পাতে বড় মাছটা, মাছের মাথাটা তুলে দেন। আর এ কাজটা অতি যত্নের সাথে করেন আমাদের মায়েরাই। অথচ বড় হবার জন্য দু’জনেরই সমান পুষ্টি দরকার। আমাদের মায়েরা কিন্তু তাদের মায়েদের কাছ থেকে শিখেছেন, বা নিগৃহীত হয়েছেন মেয়ে হিসেবে। তারপরেও মায়েরা একই কাজ করেছেন তাদের মেয়েদের সংগে। এখানেই ছেলেশিশুর মধ্যেই তখন থেকে একটা আমিত্ব ভাবটা জেগে ওঠে। আর পক্ষান্তরে মেয়েশিশুটা কষ্ট পেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। তখন থেকে তার অাশেপাশের পুরুষদের সম্বন্ধে একটা বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হয়। এটা একটা উদাহারণ মাত্র।
তাছাড়া ধরুন সম্পত্তির কথা, সেখানেও মেয়েদেরকে কতটা বঞ্চিত করা হয়েছে। মেয়েদের জন্য রাখা হয়েছে নামেমাত্র। মেয়েদেরকে জন্মের সময় থেকেই একট কথা শুনে বড় হতে হয়েছে, তোমার বাড়ি এটা নয়। তোমাকে তো শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। অথচ একই বাবা-মায়ের সন্তান হয়ে শুধুমাত্র ছেলে হবার জন্যই সে বাবা-মায়ের অর্জিত সব সম্পত্তি আয়েশ করে ভোগ করবে, সেই ছেলেসন্তান যদি কুলাঙ্গারও হয়, তারপরও। ওই যে সোনার আংটি বাঁকাও ভালো। কী অসুস্থ চিন্তাধারা আমাদের মস্তিষ্ক জুড়ে আছে। এখান থেকেও পুরুবিদ্বেষের জন্ম হয়।
তারপরে ধরুন স্বামী বা স্ত্রী দু’জনেই চাকুরিজীবী। দু’জনেই কাজ শেষে বাসায় আসলেন ক্লান্ত হয়ে। পুরুষটি এসেই সোফায় গা এলিয়ে বসে গেলেন, আর নারী কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্না, বাসনকোসন পরিস্কার করতে নেমে গেলেন। রান্নাশেষে পুরুষ আপনি খেতে বসে খুঁত ধরা শুরু করলেন। এটায় নুন বেশি, তো ওটায় ঝাল বেশি। রান্নার সময় মন কোথায় থাকে? ঝাড়ি দিয়ে খাওয়া ফেলে উঠে গেলেন। আর নারী মুখ গোমড়া করে বাসন কোসন পরিস্কার করে না খেয়েই সারাটা দিন কাটিয়ে দিলো। আপনি একবারও দুঃখ প্রকাশ করলেন না নিজের কৃতকর্মের জন্য। একে তো কোনো হেল্প করেননি নিজের স্ত্রীকে, তারপরে আবার খারাপ ব্যবহার করলেন। এখান থেকেই চাপা একটা ক্ষোভ জন্ম নেয়াটা কি অস্বাভাবিক? ক্ষোভ থেকেও পুরুষের প্রতি বিদ্বেষের জন্ম। এবং এর জন্য দায়ী কিন্তু আপনিই। তাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করুন। নারীর প্রতি সহিংস না হয়ে সংবেদনশীল হোন।
তবে যুগের পরিবর্তনের সংগে সংগে মানুষের চিন্তাভাবনার অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের গতি অনেক শ্লথ। অনেক পরিবারেই ছেলেমেয়েকে সমানভাবে মূল্যায়ন করে এখন। সবার আগে আমাদের পরিবার তথা বাবা মাকে এইসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। তারপরে সমাজ। তা না হলে এই নারী পুরুষের বৈষম্য বাড়তে থাকবে বৈ কমবে না।
নারী পুরুষের মধ্যকার এই বিভেদ যতদিনে না দূর হবে ততদিনই সমাজের পরিবর্তন অসম্ভব। আজকাল নারীরা পুরুষের মত সর্বক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সচিবালয় থেকে খেলার মাঠে সর্বত্রই এদের অবাধ বিচরণ। তারপরেও দিনশেষে একটা কথাই শুনতে হয় তুমি তো অবলা মেয়ে। এটা শুনতে হয় পুরুষদের থেকেই। কেন?
পুরুষ, তুমি তোমার মস্তিস্ক থেকে ‘অবলা’ শব্দটা মুছে দাও। বরং তাকে মানুষ ভাবো। তাহলে আর অন্তত পুরুষবিদ্বেষী নারী জন্ম নেবে না।