ঈশিতা বিনতে শিরীন নজরুল:
এই বিশ্বধরায় রহস্যের কোনো অন্ত নেই। যেদিকে তাকাই, সেদিকই আমার রহস্যময় মনে হয়। প্রকৃতির মাঝে লুকিয়ে থাকা অসংখ্য রহস্য, এই সমাজ গড়ে ওঠার অন্তরালের রহস্য, সমাজের অলিখিত বহু ধ্যান-ধারণা মানুষের মাথায় চিরস্থায়ীভাবে কীভাবে সংসার পেতে বসলো …সেটাও তো রহস্যই বটে!
একটি গবেষণার কাজে একজন কুলসুম (ছদ্মনাম) এর সাথে পরিচয়। দরিদ্র, নিরক্ষর এই গার্মেন্টস কর্মী একজন মা। আমার সাথে অনেকদিন ধরে তার কত কথা …একদিন হঠাৎ দেখলাম তাঁর সদা হাস্যজ্জ্বল মুখখানা কেমন যেন বিবর্ণ দেখাচ্ছে, কেমন যেন অন্যমনষ্ক!
পরে তিনি বললেন..
‘‘আপা, আমার দুইটা মেয়েরে আমি কতো কষ্ট কইরা নিজে না খাইয়া বড় করতাছি। মাইয়ার বাপে হ্যাগো দেহে না।আমার লগে মনে চাইলে থাহে, না চাইলে থাহে না। যহন থাহে মাইরা ফাডায় ফ্যালে (আমি আগেই তাঁর সারা শরীরের অসংখ্য ক্ষত দেখেছি আর শিউড়ে উঠেছি বারবার)।
..কিচ্ছুই গায়ে লাগাই না … শুধু এইডা ভাইব্বা যে আমার মাইয়া দুইডারে ইস্কুলে পাডাইতাছি; হ্যারা আমার মতো কষ্ট করবো না। কিন্তু মাইয়ার বাপ আইসা কাইলক্যা মাইয়ারে নিয়া গ্যাছে জোর কইরা, কইছে এরে ইস্কুলে পাঠাস যে আমারে জিগাইছস? মাইয়ার আবার ইস্কুলে যাওনের দরকার কী? সে যতো অত্যাচার করছে, কিছু কই নাই, খালি চক্ষের পানি ফেলাইছি।
কাইলক্যা কইছি,‘‘তুমি আমার মাইয়ারে কেন নিতাছো? এতো ছোট মানুষ, হ্যায়, আমারে ছাড়া কেমনে থাকবো?’’….আমার স্বামী কইছে,‘‘ঐ মাগী, মাইয়া তোর অয় কেমতে? মাইয়া তো আমার বংশের!!আমার মাইয়ারে আমি যহন খুশি, যেহানে খুশি নিয়া যামু; তোর কীরে?’’
আমি চুপ!!….
‘‘আপাগো, মাইয়া শুধু হ্যার কেমনে অয়? আমি জন্ম দিলাম; দিনের পর দিন কত কষ্ট কইরা হ্যাগো মানুষ করার চেষ্টা করতাছি…মাইয়া জন্ম দিছি বইলা আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই কত খোঁটা দিয়া বাড়ি থেইক্যা বাইর কইরা দিছে!! …মাইয়া নাকি আমার না! কেন গো আপা? মাইয়াডা কেন আমাগো দুইজনেরই না? কেন শুধু হ্যারই??’’
আমি যখন ‘কুলসুম’ এর সাথে কথা বলি, এবং তিনি আমার কাছে আকুলভাবে জানতে চান …‘‘কেন গো আপা? মাইডা কেন আমাগো দুইজনেরই না? কেন শুধু হ্যারই??’’
…তখন আপনা থেকেই মনে হলো তাদেরকে জিজ্ঞেস করি যারা আমাকে কটাক্ষ করেন….‘‘এই মেয়েটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান, জেন্ডার স্টাডিজ বা নারীবাদী পড়াশোনা বা এ ধরনের কোন বিষয় পড়েছেন?’’ কুলসুম কত গভীর একটি প্রশ্ন করেছেন আমার কাছে….
কিন্তু আমি নিরুত্তর, লজ্জিত, অসহায়, অপমানিত, ক্রুদ্ধ….কারণ তার সাথে আমার একটিই পার্থক্য…তিনি লেখাপড়া শিখতে পারেননি, আমি ‘হয়তো’ পেরেছি; কিন্তু আদৌ তাতে কোনো লাভ হয় না…আমরা দু’জনই নারী। তাঁর বুক ফাটা আর্তি শুনলে মানুষরা বলবে …‘‘অশিক্ষিত ‘মেয়েছেলে …বুঝে না, কিছু না, খালি আজাইরা প্যাঁচাল পারে; আর একই কথা আমি বললে শুনবো…‘উহহ…এইজন্যই ‘মেয়েমানুষে’র বেশি লেখাপড়া করা ঠিক না…. নারীবাদীরা দেশের বারোটা বাজায় দিচ্ছে।’’
মা ও বাবার কাছ থেকে ছেচল্লিশটি ক্রোমোজোম নিয়ে যে শিশুটি জন্মায়, সে কীভাবে শুধু বাবার পরিবারের বা বংশের হতে পারে? সৃষ্টিকর্তাই তো শিশুটির পরিচয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন কত সুশৃংখলভাবে ….শিশুটি বাবার বৈশিষ্ট্য এবং মায়ের বৈশিষ্ট্য-উভয়ই পাচ্ছে, মায়ের শরীরের রক্তে বড় হচ্ছে। জীবের কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত নিউক্লিয় প্রোটিন জাতীয় পদার্থ নির্মিত যে জটিল তন্তুর মাধ্যমে জীব তার সবধরনের বৈশিষ্ট্যসমূহ বংশানুক্রমে (এখানে কিন্তু এরা আলাদা করে জানে না যে কারা পিতার বংশ; এই বংশানুক্রম হলো মা-বাবা উভয়ের দিক থেকে আসা বৈশিষ্ট্যের ক্রমধারা) পরিবাহিত করে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রাখে, তাকে ক্রোমোজোম বলে।
শুধু যে মা-বাবারই বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিশুটি জন্মাচ্ছে, বোঝাই গেল, তা নয়। বরং মায়ের দিকের সকলের (নানা-নানী) বা বাবার দিকের সকলের (দাদা-দাদী) বৈশিষ্ট্যও প্রকট এবং প্রচ্ছন্ন এই দু’টি নিয়মে শিশুটির কাছে চলে আসে। কখনও তা দৃশ্যমান হয়, বা কখনও হয় না। এটিই তো প্রকৃতির নিয়ম। তবে কেন ছোটবেলা থেকেই সবার মুখে শুনতে হয় যে -চাচা, ফুফুদের সাথেই নাকি শিশুর রক্তের সম্পর্ক? রক্তের সম্পর্ক আবার হয় নাকি? আর হলেও সেটা মায়ের সাথে নয় কেন যখন মায়ের রক্তে-মাংসেই তার জন্ম?
পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে থেকে স্বয়ং যখন দাদা-দাদী চান তার ‘বংশের’ বাতি জ্বালাতে হবে এর মধ্যে আবার একটি মেয়ের জন্ম দিলা ইত্যাদি’ যখন বলেন তখন সদ্যজাত সন্তানটিকেই কি অপমান করা হয় না? বউ ‘পোয়াতি’ সবাই জানি এর অর্থ গর্ভবতী। কিন্তু আসলেই কি তাই? ‘পোয়াতি’র অর্থ হলো….পুত্র সন্তানকে যে ধারণ করে (পো-পু=পুত্র),ভাষার ভেতরেও কি গভীর কারুকার্যপূর্ণ বৈষম্য, তুচ্ছতাচ্ছিল্য। যেন ধরেই নেয়া যে গর্ভের সন্তানটি পুত্র! একটি কন্যাশিশু জন্মের আগে থেকেই বৈষম্যের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে!! তাই এরকম প্রেক্ষাপটে আমি কীভাবে, কীসের জোরে বলবো যে কুলসুম ….সন্তান শুধু তোমার স্বামীর একার নয়, তোমারও?
‘সুশীল’ সমাজ? তারা তো তত্ত্ব দিতেই ব্যস্ত…..সংজ্ঞায়নে ব্যস্ত … নারীর অনুভূতিকে, বাস্তবতাকে, শিশু কন্যার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণকে, ধর্ষণকে বা এরকম আরও হাজার হাজার নারী সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী নিয়ে ‘গবেষণা’ করার জন্যই তো তারা কোটি কোটি অর্থ বরাদ্দ পান। নারীর দারিদ্র্য, অসহায়ত্ব, নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি হলো পণ্য; এদের বিক্রি করেই না আজ ‘সুশীল’ সমাজ কত সভা সমিতি করছেন, বিদেশে দেশের করুণ অবস্থা বিবৃত করার সুযোগ পাচ্ছেন..!! তাই নারীর ওপর এসব বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে? তাই শুধু গবেষণাই হতে থাকে; কোনো প্রতিকার হয় না। হয় না চিন্তাধারার পরিবর্তন …চর্চার পরিবর্তন। আমরা এই শতাব্দীতে শুধু যেকোনো ফর্মে বাবার নামের পরে মায়ের নাম লেখার অপশনটি দিয়ে বলতে থাকি … এইতো মাকেও অধিকার দেয়া হয়েছে!
আমি একজন নারী….আমি নারীর ন্যায্যতায় বিশ্বাসী, যেটুকু একজন নারীর মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অন্তত সেটুকু নিয়ে যেন কাড়াকাড়ি না করা হয়। মানুষের নিজেদের মনগড়া ক্ষমতার চর্চার কারণে কেন নারীকে, একজন মাকে বঞ্চিত করা হবে? সে যে মায়ের নয় সেটা বোঝানোর জন্য হয়তো চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী তার নামের আগে বা পরে যুক্ত করা হবে ‘বংশে’র উপাধি, যে বংশের রক্ষক তার বাবা-মা নয়।
আসুন আমরা সবাই মিলে একটি সুন্দর প্রজন্ম গড়ে তুলি, যেখানে আমাদের প্রিয় সন্তানটির পরিচয় ‘ক্ষমতার চর্চা’ বা ‘চিরাচরিত অযৌক্তিক’ কোনো ধারণাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে না, যেখানে মাকে তার সন্তানের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে না বা কন্যা সন্তান ‘বংশ প্রদীপ’ জ্বালাতে পারে না, এই ধারণায় সেই ভ্রুণটিকে হত্যা করা হবে না।