লাভ, সেক্স এন্ড ধোঁকা

প্রমা ইসরাত:

এক দেড় মাস আগে একটা মেয়ে আমার কাছে আইনি পরামর্শ চাইতে এসেছিল। আমার বাসা-বাড়ির অবস্থা তখন খুবই জঘন্য, কাওকে বসতে দেয়ার মতো পরিবেশও আমার ছিল না। মেয়েটার কথা শুনে আমার মনে হলো, তাঁর কথা বলাটা খুব জরুরি। তাই আমার বাসাতেই ওকে ডাকলাম।

এমনিতে ফোনে কথা বলেছিলাম, সামনা সামনি যখন দেখলাম, দেখলাম খুব সুন্দর দেখতে একটা মেয়ে। দেখতে ভালো, ছাত্রী ভালো, পড়ালেখার পাশাপাশি একটা চাকরিও করছে। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর সমস্যা, তাঁর কথিত প্রেমিক তাকে ছেঁড়ে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এবং দীর্ঘদিন গভীর একটি সম্পর্ক রাখার পর, এখন তাকে আর বিয়ে করতে চাচ্ছে না।

সে তাঁর জীবনের দুটি সম্পর্কের কথা আমার সাথে শেয়ার করলো। আমি বুঝতে পারলাম না, দেখতে এতো স্মার্ট একটা মেয়ে, কী করে বুঝতে পারছে না যে তাঁর জীবনে থাকা দুটো সম্পর্কই বিষাক্ত সম্পর্ক। কী করে সে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে একটা সম্পর্ক ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাঁর একটাই কথা, “হয় আমাকে ওর বিয়ে করতে হবে, নয় আমিও ওকে সামাজিকভাবে নিচে নামিয়ে দেবো” ।

ওর চোখে-মুখে একই সাথে অসহায়ত্ব আর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা দেখতে পেলাম। আমার খুব খারাপ লাগছিল। আমি প্রায় দেড় ঘন্টা ওর কথা শুনেছি। আমি যখন কিছু পড়ি বা শুনি, আমার সমস্যা হচ্ছে আমি সেক্ষেত্রে এমনভাবে ইমপ্যাথেসাইজড হয়ে যাই যে, মনে হয় এগুলো ঠিক আমার চোখের সামনেই হচ্ছে।

মেয়েটার এবরশান করাতে হয়েছিল। মেয়েটা আমাকে সেই কষ্টের কথা বর্ণনা করে বলছিল যে, আপু জানেন হাতের পাঁচটা আঙ্গুল গোনা যাচ্ছিল, এই দৃশ্য আমি কী করে ভুলি? কিন্তু ওই ছেলেটার কোনো ফিলিংসই হলো না।
মেয়েটা ধাতস্থ হলে, ভেবেছিলাম কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেই, এবং ওর এইসব শাবানা কিংবা অপু বিশ্বাস টাইপ ন্যাকামি মার্কা ইমোশনের জন্য কষে একটা চড় লাগাই। কিন্তু সেটা আমার প্রফেশনের সাথে যায় না। তাই যথেষ্ট শান্তভাবেই বললাম, যে ছেলের কোনো ফিলিংসই নেই, যে ছেলে একটা দায়িত্ব নেয়ার মন মানসিকতা রাখে না, তুমি তাঁর সাথে কী করে বাকি জীবন থাকার কথা ভাবতে পারো?

সে বার বার আমাকে বললো, আমি ভুল করেছি, আমি পাপ করেছি ইত্যাদি।
দুঃখের বিষয় হচ্ছে তাঁর আইনি প্রক্রিয়াতে যাওয়ার মতো কোন স্ট্রং গ্রাউন্ড নেই, কেননা এবরশান সে কী একটা ক্লিনিক্যাল কিট ইউজ করে নিজের বাসায় করিয়েছে, এবং নিজের সিদ্ধান্তে। হাসপাতালের কোনো রিপোর্ট নেই। ওই ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়নি।
আর এই কেসে রেইপ কেস মানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০৩ অনুযায়ী বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক, ধারা ৯(১) এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ষোল বৎসরের অধিক কোনো নারীর সাথে প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। এখন প্রতারণা তো এটাই করেছে যে বিয়ে করবো, বিয়ে করবো বলে শারীরিক সম্পর্ক করেছে, কিন্তু এখন অস্বীকার করছে যে বিয়ে করবে না। এরকম একটা সেনসেটিভ ইস্যুতে সত্যিকার অর্থে আইনি প্রক্রিয়াতে যাওয়ার স্ট্রং কোন গ্রাউন্ড নেই। এবং গেলেও সেখানে মেয়েটিকে জেন্ডার ইনসেন্সেটিভ আদালত প্রাঙ্গণে, জেন্ডার ইনসেন্সেটিভ পুলিশ প্রশাসনে, জেন্ডার ইনসেন্সেটিভ হাসপাতালে, আরও কয়েকশ বার নিজের আত্মসম্মান এবরশান করাতে হবে।

বিয়ের পড়ে জামাইয়ের লাত্থি গুতা খেয়ে যদিওবা মেয়েরা এখন সিমপ্যাথি পায়, বাইরে কাজ করতে গিয়ে রেইপ হলে মেয়েরা যদিওবা সিমপ্যাথি পায়, কাঁদতে কাঁদতে মেয়েরা যদিওবা সিম্প্যাথি পায়, কিন্তু নিজের ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করা মেয়ে যদি নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে সেটা তাঁর কর্মফল, নিজের ইচ্ছায় যদি ডিস্কোতে গিয়ে কেউ রেইপড হয়, তবে সেটা তাঁর কর্মফল, চিৎকার করে প্রতিবাদ করা মেয়েকে যদি লাঞ্ছিত হতে হয়, তবে সেটা তাঁর কর্মফল, আধুনিক বা পশ্চিমা পোশাকে যদি কোনো মেয়ে ইভ টিজিং এর শিকার হয়, তবে সেটা তাঁর কর্মফল।

মেয়েটার একটা বক্তব্য শুনে আমার ধারণা পরিষ্কার হলো যে কেন সে, দ্বিতীয় সম্পর্ককে কিছুতেই ছাড়তে রাজি ছিল না। সেটা হচ্ছে তাঁর প্রথম প্রেমিকের সাথে ঘটে যাওয়া শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি দ্বিতীয় প্রেমিক জানতো। এবং সে এটা জেনেই যেহেতু মেয়েটির সাথে সম্পর্ক করতে রাজী হয়েছে, মেয়েটি ধরেই নিয়েছে এইরকম দেবতা লেভেলের মানুষকে জীবনে যে করেই হোক ধরে রাখতেই হবে। আর তাই সে ওই সমস্ত কিছু করেছে যা সেই ছেলেটি তাকে করতে বলেছে।

ইউনিভার্সিটিতে থাকতে একটা ছেলে ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিল যেো সে প্রেম করার জন্য নন ভার্জিন মেয়ে খুঁজছে। আমি বললাম, কারণ কী? সে উত্তর করলো, মেয়েরা ভার্জিনিটি লুজ করে মনে করে যে, তাঁর মতো ইউজলেস নষ্ট মেয়েকে আর কেউ বিয়ে করবে না, তো, যে ছেলে একটা মেয়ে নন ভার্জিন জেনেও তাকে প্রেমিকা বানায় বা বিয়ে করতে চায়, সেই ছেলে ওই মেয়ের কাছে ফেরেশতা তূল্য।

সেইসব মেয়েকে পা এর নিচে রাখা যায়, এবং ইচ্ছামতো পরিচালনা করা যায়। তো আমার সেই ছেলে ফ্রেন্ড একটা নন ভার্জিন মেয়ে খুঁজে পেয়েছিল এবং ইউনিভার্সিটি চলাকালীন তাঁর সাথে নিয়মিত সম্পর্ক করতো, তাকে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে রান্না করানো, কাপড় ধোঁয়া, তাঁর এসাইনমেন্ট করানো, নোট করানো সব করিয়েছিল, এবং ইউনিভার্সিটি শেষে সে বিয়ের জন্য বাছাই করেছিল দেখতে তেমন আহামরি সুন্দরী নয়, কথা কম বলা মিষ্টি একটি মেয়েকে। তাঁর যুক্তি ছিল, বিয়ে করতে হলে এইরকম কম সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করা উচিৎ, তাহলে তাকে পা এর নিচে রাখা যায় এবং ইচ্ছামতো পরিচালনা করানো যায়।

সেক্স করতে হলে আমাদের সোসাইটিতে একটা ছেলেকে বিয়ের প্রলোভন দেখানো জরুরি, কারণ বিয়ের কথা না তুললে শুধু সেক্স করতে চাই এই রকম দাবি পেশ করা, ছেলেকে ট্রেডিশন অনুযায়ী একটা মেয়ে স্যান্ডেল দিয়ে পেটানোর কথা ভাববে। আবার বিয়ের আগে সেক্স করতে রাজী হয়ে যাওয়া একটি মেয়েকে ছেলেরা “মালটাকে খেয়ে ছেঁড়ে দেয়া যায়” হিসেবেই ধরে নেবে।

কী এক অদ্ভুত মানসিকতা। নারী-পুরুষ উভয়কেই একটা ভাণ বজায় রাখতে হয় যে, আমরা সবাই গুড গার্ল, এন্ড গুড বয়। আর তাই একটা গুড বয় ইমেইজ নিয়েই একটা ছেলে মেয়েটাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সম্পর্ক করে, আর একটা মেয়ে গুড গার্ল তাই অনেক বার সেক্সের আহ্বান ঠেলে সরিয়ে, ছেলেটাকে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, ভালো মতো বাজিয়ে তারপর শারীরিক সম্পর্ক করে এবং যে করেই হোক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারপর একদিন ধোঁকা খায়। সেটা বিয়ের আগে হোক, পড়ে হোক।

প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ব্রেক আপ থিওরি ইদানিং কালের কী অবস্থা আমি জানি না, পাঁচ-সাত বছর আগেও ছিল যে, মেয়েটাকে সেক্স এর প্রস্তাব দিতে হবে। রাজি হলে, কেন রাজি হলো বিয়ের আগে সেক্স করতে, সেই জন্য ব্রেক আপ, আর রাজি না হলে কেন সেক্স করতে রাজি হলো না, সেইজন্য ব্রেক আপ।

একবার কোনমতে একটা নারীকে বিছানা পর্যন্ত নেয়া মানে সেই মেয়েটার মালিকানা পেয়ে যাওয়া। এটা প্রতিষ্ঠিত ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে কেননা একটা মেয়েও মনে করে যে তাঁর সাথে যে প্রথম সেক্স করবে সেই ছেলেটিই হবে তাঁর একমাত্র পুরুষ। তাই যেকোনো ভাবেই মেয়েটা সেই ব্যক্তিকে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে। আর ছেলেটাও দারুণ সুবিধা পেয়ে যায়, He gets the right to take that girl for a granted.

আমার যত ছেলের সাথে জীবনে পরিচয় ঘটেছিল, তাদের বেশিরভাগই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনার। এটাই স্বাভাবিক ছিল, সমাজটাই তো পুরুষতান্ত্রিক। তো, আমার এক ফ্রেন্ড তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে রাতে গ্রুপ করে মেয়েদের সাথে ফোনে কথা বলতো, অনেকেই নানান মেয়ের সাথে প্রেম করে বেড়াতো, ডেটিং করতো। তাদের থিওরি ছিল, একটা মেয়ে বাছাই করতে হবে যাকে বিয়ে করবো, এবং এরপর বাদ বাকি ফূর্তিফার্তা যা করার করবো।

ঘরের মুরগি রেখে, মাঠে গিয়ে কানা মাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ। আর অপরদিকে মেয়েটা যে কত বয়ফ্রেন্ডবতী, এবং কতো লক্ষী, ঘরের বউ হবার জন্য সে যে কতটা পারফেক্ট, সেই চেষ্টায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকতো। বড়জোর দু একটা ইটিশ-পিটিশ ফোন কল এলে, কাজিন, দেশের বাইরে থেকে কল দিয়েছে, বান্ধবীর ব্রেক আপ হইছে ইত্যাদি নাদান মিথ্যা চালিয়ে দেয়া। আর একটা বা দুইটা সাইড প্রেম যদি মেয়েটাও করে, তবে তো চরিত্রহীন গার্লফ্রেন্ড এবং ব্রেক আপ। একটা ছেলে এইরকম করতেই পারে, কিন্তু একটা মেয়ে!!! না না না না! ছিঃ তওবা!

একটা ছেলের চাইতে একটা মেয়ের সেক্স এর ইস্যু সকলের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়াটাই লজ্জা আর অসম্মানজনক ব্যাপার। একটা ছেলে পাঁচটা দশটা মেয়ের সাথে সেক্সুয়াল সম্পর্কে জড়াতে পারে, সেটা সেই ছেলের দুষ্টমি, একটা মেয়ের জন্য সেটা ভয়ংকর, ভয়ংকর লজ্জার, কলঙ্কের এবং অসম্মানের ব্যাপার। অসম্মান শুধু তাঁর নিজের না, অসম্মান তাঁর পিতার, তাঁর মাতার তাঁর ভাই এর তাঁর আত্মীয়ের, তাঁর প্রতিবেশীর তাঁর চৌদ্দগোষ্ঠীর।
একটা ছেলে প্রেম ছাড়া শুধু মৌজ মাস্তি করার জন্য সেক্স করতেই পারে, কিন্তু একটা মেয়ে যদি সেক্স করেও ফেলে, তাকে প্রুফ করতে হবে যে সে তাকে তাঁর হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে, এক্কেবারে বিশ্বাস করে, তাকে তাঁর জীবনের স্বামী ভেবে শুয়েছে। নইলে সেই বিয়ের আগে শোয়াটাও জায়েজ হয় না।

একটা ছেলের এট্রাক্টিভ ফিগার দেখে, তাঁর প্রতি একটা শারীরিক আকর্ষণ থেকেই একটা সেক্স হয়েছে, এই কথা স্বীকার করা আমাদের সোসাইটিতে একটা মেয়ের পক্ষে স্বপ্নেও ভাবা অসম্ভব। আর একবার সেক্স যেহেতু হয়েছে, তাই সেই রিলেশন থেকে বের হয়ে আসা মেয়েটা তো অচ্ছুৎ, তাই যে করেই হোক মানসিকতা না মিললেও রিলেশনশিপ কনটিনিউ করতে হবে।

এবং রিলেশনশিপ ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও কতই না চালবাজি, কার জন্য রিলেশনশিপ ভাঙ্গলো, কে দায়ী এটাও একটা ইস্যু। যে করেই হোক আমি গুড গার্ল/আমি গুড বয়, আমি রিলেশনশিপ টিকাইতে চাইছিলাম, সে চায় নাই, ওর দোষ, ও খারাপ, সেক্স করেও রিলেশনশিপ রাখতে চায় নাই… ব্লা ব্লা ব্লা।

লেখার বিষয় বস্তু ছিল লাভ, সেক্স আর ধোঁকা নিয়ে। এই শিরোনাম একটা বলিউড ছবি থেকে ধার করেছি।
সেক্সের জন্য প্রেমের অভিনয় করা এবং পরে ধোঁকাবাজি, আমাদের সমাজে চলমান। শুধু সেক্স কে উছিলা করেই নারী পুরুষের বিছানায় চলে নানান রাজনীতি।

শুধু সেক্সকে উছিলা করেই জ্বলজ্যান্ত মানুষকে পোষা কুকুর করে রাখতে চাওয়ার প্রবণতা নারী পুরুষ উভয়েরই। কিন্তু যেহেতু সমাজ পুরুষতান্ত্রিক তাই নারীর নিগৃহীত হওয়ার চিত্র বেশি দেখা যায়, এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার জন্যই পুরুষের আর্তনাদও শোনা যায় না।

আর সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আইনের দেবীর চোখ অন্ধ। আইন আদালত হৃদয়ে কত ক্ষত হলো সেই হিসাব করে না। মোটেই করে না।

তাই বাবুজি ধীরে চালনা… প্যায়ার মে জারা সাম্ভালনা… হাঁ বারে ধোঁকে হ্যাঁয়… বারে ধোঁকে হ্যাঁয় ইস রাহ মে…

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.