“নি‌জে‌কে ভালবাসুন, ম‌নের শ‌ক্তি‌কে কা‌জে লাগান”

হেলেনা আফরোজ:

অ‌নেকদিন থে‌কেই ভাব‌ছিলাম যে লিখবো, কিন্তুু এখা‌নে সব‌কিছুর জন্য এতো মাপা মাপা সময় যে, একটু নি‌জের মতো ক‌রে কিছু কর‌বো, ‌সেই সময়টাই ‌ঠিক হ‌য়ে ও‌ঠে না।

য‌দিও এরকম একটা জীবনই অামার পছন্দ ছিল, বা ঠিক পছন্দ কিনা জা‌নি না কিন্তুু চাইতাম, ঠিকই এরকম স‌ত্যিকা‌রের একলা থাক‌তে, কারণ জীব‌নের বে‌শিরভাগ সময়ই অা‌মি কা‌টি‌য়ে‌ছি সবার ম‌ধ্যে থে‌কেও একরকম একলা একলা, এক একটা সময় এক এক জ‌নের জন্য অ‌পেক্ষা, এক এক জ‌নের জন্য কষ্ট পাওয়া।

প্রচণ্ড অ‌ভিমান নি‌য়ে ওই সময়গু‌লো‌তে ভাবতাম অা‌মি স‌বার ম‌ধ্যে থে‌কে না বরং স‌ত্যি স‌ত্যি ই একলা থাক‌তে চাই যেখা‌নে কেউ থাক‌বে না।

এখন অামার সংসা‌রে অা‌মিই একমাত্র সদস্য, ঘর থে‌কে বের হবার সময় পেছন থে‌কে দরজা লাগা‌নোর জন্য যেমন কেউ থা‌কে না, তেম‌নি স্কুল, ল্যাব সব শেষ ক‌রে বাসায় ফির‌তে প্রায় প্র‌তি‌দিনই খা‌নিকটা রাত হয়, অার তখনও নি‌জেই দরজাটা খু‌লে বাসায় ঢুক‌তে হয়, এটাই স্বাভা‌বিক এখা‌নে।

য‌দিও অামার ম‌নে হয় এরকম একলা কিছু সময় নি‌জের মতো ক‌রে নি‌জের সা‌থে কাটা‌নে‌া, নি‌জের সা‌থে কথা বলা, স‌ত্যিই খুব জরুরি, তা নাহ‌লে এক‌দিন হঠাৎ ক‌রে দেখ‌বেন জীব‌নের বে‌শিরভাগ সময়ই অাপ‌নি কা‌টি‌য়ে দি‌য়েছেন শুধু অন্যরা অাপনা‌কে নি‌য়ে কী ভাব‌লো সেটা নি‌য়ে, অন্য‌দের চো‌খে অাপ‌নি কেমন সেটা ‌নি‌য়ে, অাপ‌নি হয়‌তো খুব ভা‌লো ক‌রে কখনও নি‌জের দি‌কে তা‌কি‌য়েই দে‌খেননি যে অাপনার চো‌খে অাপ‌নি কতটা সুন্দর, কখনও হয়তো উপল‌দ্ধি ক‌রেন‌নি কতটা সাহ‌সী অাপ‌নি!

য‌দিও মানুষ নি‌জে কোন ক‌ঠিন প‌রি‌স্থি‌তির মোক‌া‌বেলা করার অাগ পর্যন্ত স‌ত্যিই বুঝ‌তে পা‌রে না, যে সে অাস‌লে কতটা সাহসী অার শ‌ক্তিশালী!

অামার যখন প্রথম ক্যান্সার ধরা পড়‌লো সেটা ছিল ২০১৩ সালের প্রথম দি‌কে, অা‌মি হস‌পিটা‌লে ভ‌র্তি হলাম অামার থাইর‌য়েড অপা‌রেশ‌নের জন্য, মজার ব্যাপার হ‌লো অপা‌রেশ‌নের অা‌গে ওরা নিয়ম অনুযা‌য়ি ম্যা‌লিগন্যা‌ন্সি (ক্যান্সার) টেস্ট করা‌লো এবং ওই সময় রেজাল্ট অাস‌লো নে‌গে‌টিভ। কিন্তুু অপা‌রেশ‌নের পর যখন অাবা‌রো বা‌য়োপ‌সি করা হ‌লো তখন রেজাল্ট হ‌য়ে গে‌লো প‌জি‌টিভ, অা‌রো ক‌য়েক জায়গা থে‌কে প‌রীক্ষা করা হ‌লো নি‌শ্চিত হবার জন্য, এবার সবখা‌নেই রেজাল্ট প‌জি‌টিভ।

ডাক্তার অামা‌কে, অামার মাকে, অার অামার হাজ‌বেন্ডকে একসা‌থে ডে‌কে যখন খবরটা দিল, অামার স্পষ্ট ম‌নে অা‌ছে অামার যেন গা‌য়েই লা‌গে‌নি খবরটা, শুধু ম‌নে ম‌নে বোধ হয় বললাম, সি‌রিয়াসলি? বরং অামার তো কষ্ট হ‌চ্ছিল অামার মায়ের মুখটা দে‌খে।

অপা‌রেশ‌নের পর হাজা‌রো জ‌টিলতা শেষ ক‌রে যখন হস‌পিটাল ছাড়লাম, তখন শুরু হলো অাবার অ‌পেক্ষা থেরা‌পি নেবার জন্য, য‌দিও এই পর্যন্ত কিছুই তেমন ম‌নে হয়‌নি অামার, সবসময়ই ‌নি‌জে‌কে বোঝা‌চ্ছিলাম ইটস ও‌কে, ইটস রি‌য়েলি ও‌কে, ডোন্ট ওয়া‌রি।

ত‌ারপর থেরা‌পির জন্য অাবা‌রো হস‌পিটা‌লে ভ‌র্তি হলাম, অামার থেরা‌পিটা ছিল রে‌ডিও থেরা‌পি, কিন্তুু সম্পূর্ণ নতুন অার ভয়াবহ অ‌ভিজ্ঞতা, অামা‌কে সাত‌দিন হস‌পিটা‌লের একটা কে‌বি‌নে রাখা হ‌য়ে‌ছিল, যেখা‌নে কা‌রো ঢোকার অনুম‌তি ছিল না কারণ অামার শরী‌রের রে‌ডি‌য়েশ‌নে অন্য‌দের খ্খতি হ‌বে তাই এই বি‌শেষ ব্যবস্থা।

তারপর যখন বাসায় ফিরলাম নিয়ম অনুযা‌য়ি সব অাত্মী স্বজন শেষবা‌রের মতো দেখ‌তে অাসা শুরু করলো, অামার দাদাবা‌ড়ি‌তে এরকম নিয়ম অা‌ছে যে, যখন কোনো মানুষ খুব বয়স্ক হ‌য়ে বা কোনো ক‌ঠিন অসু‌খে প্রায় মারা যা‌চ্ছে, তখন সবাই তার বা‌ড়ি‌তে খাবার রান্না ক‌রে তা‌কে খাওয়াই‌তে নি‌য়ে যা‌বে, সুতরাং সেইম সি‌স্টেম শুরু হই‌লো অামার জন্যও, পু‌রো সময়গু‌লো অা‌মি খুব অদ্ভুতভা‌বে কাটাচ্ছিলাম, ঠিক এই সময়টা‌তে কিছু লোক অাবার ব্যস্ত ছিল নানারকম মন্তব্য নি‌য়ে, প‌জি‌টিভ নে‌গে‌টিভ সব ধর‌নের মন্তব্য, তারপর অা‌স্তে অা‌স্তে সময় যে‌তে থাক‌লো, অার অা‌মিও অ‌নেকটা সুস্থ হ‌তে থাকলাম, একইসা‌থে অাত্মীয় স্বজন যারা খাবার দাবার নি‌য়ে শেষবা‌রের মতো দেখা কর‌তে অাস‌তে‌ছিল, সেটাও অা‌স্তে অা‌স্তে ক‌মে গেল, সব‌কিছুই কেমন যেন খুব স্বাভা‌বিক হ‌য়ে গেল।

অা‌মি বাইরে পড়‌তে অাসার চেষ্টা কিছু‌দিন থে‌কেই কর‌ছিলাম, এ‌তো বিশাল একটা গ্যাপ অার এই এতো কিছু ঘ‌টে যাওয়ার পর কেন জানি চেষ্টাটা অা‌রো বে‌ড়ে গেল, অা‌মি সব‌কিছু শুরু করলাম অাবার নতুনভা‌বে, ঠিক বড়সড় একটা ঝ‌ড়ের পর বৃ‌ষ্টি হ‌লে সব‌কিছু যেমন শীতল শান্ত হ‌য়ে যায় এরকম একটা মন নি‌য়ে অাবা‌রো শুরু করলাম, যেন কিছুই হয়‌নি, সব ঠিক অা‌ছে, অার ওই যে বললাম অসুখটা তো শরী‌রে, ম‌নের শ‌ক্তির কা‌ছে যেটা কিছুই না।

এখন অা‌মি বাইরে প্রায় এক বছর হ‌তে যা‌চ্ছে, এর ম‌ধ্যে অামার নিয়‌মিত চি‌কিৎসা তো চল‌ছেই, যেটা চল‌বে অামৃত্যু। কিছু‌দিন ধ‌রে অা‌মি হঠাৎ ক‌রে অাবা‌রো অসুস্থ হ‌য়ে পড়লাম, এতোটাই ভয় পে‌য়ে গে‌ছিলাম যে দে‌শে যাবার সিদ্ধান্ত প্রায় নি‌য়ে নি‌য়ে‌ছিলাম। কিন্তু না, সেই সিদ্ধান্ত বাদ দি‌য়ে এখা‌নেই ‌চি‌কিৎসা নি‌চ্ছি। গত মা‌সে একটা অপা‌রেশন কর‌তে হ‌য়ে‌ছে যেটার জ‌টিলতাই এখনও শেষ হয়‌নি, এর ম‌ধ্যে ডাক্তার অাবার ব‌লে‌ছে, অাবারেও থেরা‌পি নি‌তে হ‌বে। কিন্তুু অা‌মি এখনও সিদ্ধান্তই নি‌তে পার‌ছি না যে, সব‌কিছু ঠিক ক‌রে কখন কিভা‌বে অাবারো হস‌পিটা‌লে ভ‌র্তি হবো, য‌দিও অা‌মি জা‌নি একটা উপায় ঠিকই ক‌রে ফেলবো, ইটস ‌স্টিল ও‌কে!

এই‌তো যা‌চ্ছে জীবন, বেশ ভা‌লো!

জীবনটা স‌ত্যিই সুন্দর, মা‌ঝে মা‌ঝে একটু ক‌ঠিন বা কখ‌নো খুব জ‌টিল যখন অাপনার কা‌ছে কোন প্র‌শ্নেরই ‌কোনো জবাব নেই, তারপরও এটা সুন্দর, অার জীবনকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব একান্তই অাপনার, কোনো কিছুই অাস‌লে জীব‌নের শেষ না, যতক্ষণ না অাপ‌নি নি‌জে এটা ভাব‌ছেন!

অারো একটু গভীরভা‌বে য‌দি ভা‌বেন একজন নারীর শ‌ক্তি অাস‌লে কতখা‌নি, যে কাজটা কোন পুরুষ কর‌তে পা‌রে না, এমন‌কি যে কাজটা সৃ‌ষ্টিকর্তা নি‌জেও ক‌রেন না, সবচাই‌তে ক‌ঠিন সেই কাজটা একজন নারীই কর‌তে পা‌রে, কারণ তার অা‌ছে সেই ক্ষমতা, সেই পা‌রে অারেকটা জীবন‌কে তার ম‌ধ্যে ধারণ কর‌তে, তা‌কে জন্ম দি‌তে, যেটার জন্য শুধুমাত্র শরী‌রের না ম‌নের শ‌ক্তি ও সমানভা‌বে দরকার।

এটা ঠিক অাপ‌নি অাপনার মনের শ‌ক্তি দেখ‌তে পা‌চ্ছেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না অাপ‌নি এটা‌কে কা‌জে লাগা‌চ্ছেন। কিন্তু তার মা‌নে এই না যে, অাপনার ম‌নের শ‌ক্তি নেই। অাপ‌নি জা‌নেন না কীভা‌বে সমস্যার মোকা‌বেলা কর‌তে হয়, অাপ‌নি জা‌নেন না কিভা‌বে অাবার নতুন ক‌রে শুরু কর‌তে হয়, অাপনার হা‌তের শত শত ব্যাক‌টে‌রিয়া অাপ‌নি দেখ‌তে পা‌চ্ছেন না, এই মহা‌বিশ্ব গ্যালা‌ক্সি এসব‌কিছুই অাপ‌নি দেখ‌তে পা‌চ্ছেন না, কিন্তু তার মা‌নে এই না যে এগু‌লোর কোন অ‌স্তিত্ব নেই।

‌নি‌জের অাশির্বাদগু‌লো‌কে হি‌সেব করুন, বে‌শি বে‌শি ক‌রে ধন্যবাদ জানান সব‌কিছুর জন্য, প্রাণভ‌রে নিশ্বাস নিন, সুন্দর ক‌রে বাচুন!!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.