রাব্বী আহমেদ:
প্রতিটি সম্পর্কেরই রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। প্রতিটি সম্পর্কই নিজস্ব অনুভূতিতে অনন্য। কিন্তু স্টেরিওটাইপ সমাজ সব সম্পর্ককে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা দেয় না। ফলে কিছু সম্পর্ক আপাত সামাজিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে চর্চিত হয় গোপনে। সমাজ সিদ্ধ নয় বরং সমাজ নিষিদ্ধ এসব সম্পর্কেরও রয়েছে আলাদা মাত্রা। যে সব কিনশিপ টার্ম দিয়ে আমাদের সম্পর্কগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তার বাইরেও অসংজ্ঞায়িত অনেক সম্পর্ক রয়ে যায় যা সামাজিক ধারণার বাইরে।
সম্পর্কের এইসব বৈচিত্র্য, প্রচলিত নারী-পুরুষের সম্পর্কের টাইপড কাঠামোর বাইরে ভিন্নমাত্রার সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন, সীমিত সীমারেখা থেকে সম্পর্ককে বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বের করে নিয়ে আসা, মানুষের মনের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা, মানবিক লেন্সের আলোকে সম্পর্ককে নির্মাণসহ মানবমনের বিচিত্র অনুভূতির আলোকে গড়ে ওঠা সম্পর্কের চালচিত্র ফুটে উঠেছে মেমোরিজ ইন মার্চ চলচ্চিত্রে।
সঞ্জয় নাগের পরিচালনায় ছবিটি মুক্তি পায় ০১ এপ্রিল, ২০১১ সালে। ভিন্ন ধারার এই চলচ্চিত্রে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে সমকামী একটি সম্পর্কের বিচিত্র রূপ এবং কিছু সম্পর্কের সংকট চিত্রায়িত করা হয়েছে। মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক, দু’জন পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক, দুর্ঘটনায় মৃত ছেলের জন্য শোক সন্তপ্ত এক মায়ের সাথে ছেলের প্রেমিকের সম্পর্ক, ডিভোর্স হয়ে যাওয়া একজন নারীর সাথে তাঁর প্রাক্তন স্বামীর সম্পর্কগুলোকে বিভিন্ন আঙ্গিকে নির্মাণ করা হয়েছে এখানে। ছবিটিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপ্তি নাভাল, ঋতুপর্ণ ঘোষ, রাইমা সেন প্রমুখ।
নারী-পুরুষ, সমকামিতা, অসমকামিতার বাইরেও যে জীবন থাকে, জগত থাকে, এবং সম্পর্কের জন্য যৌনতাই যে মূখ্য নয়, কিংবা জেন্ডার কোন বিষয় নয় তা ছবিতে দেখতে পাই। ছবির কাহিনীতে আমরা দেখি কলকাতায় বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করা সিদ্ধার্থ গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেলে তার মা আরতি দিল্লী থেকে কলকাতায় ছুটে আসেন তাঁর ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য।
প্রায় বছর দশেক আগে স্বামী সুরেশের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া আরতি মূলত দীর্ঘদিন ধরে একাই থাকেন। এয়ারপোর্টে আরতিকে অভ্যর্থনা জানাতে আসে সিদ্ধার্থের সহকর্মী, বিজ্ঞাপন সংস্থার শিল্পনির্দেশক শাহানা চৌধুরী। শাহানা আরতিকে সিদ্ধার্থের আবাসস্থলে নিয়ে যায় যা ওই সংস্থার গেস্ট হাউস। বিভিন্ন আলাপচারিতায় সে দুর্ঘটনার বর্ণনা দেয়। দুর্ঘটনার রাতে অফিসে পার্টি থাকে এবং সিদ্ধার্থ মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে। আরতি চায় সিদ্ধার্থের নিত্যব্যবহৃত তৈজসপত্রগুলো নিয়ে যেতে, কিন্তু সেখানে অফিস বাধা প্রদান করে। ঘটনাক্রমে আরতি জানতে পারে সিদ্ধার্থের আরেকটি গোপন জীবন ছিলো। চিঠিতে মাকে সবকিছু জানালেও এই গোপন জীবনের কথা সিদ্ধার্থ মাকে জানায় না।
আরতি জানতে পারে, সিদ্ধার্থের সাথে তার সহকর্মী এবং প্রায় বছর দশেক বড় অর্ণবের ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো। এই ঘটনা আরতিকে বিপর্যস্ত করে দেয়। এবং আরতি অনুভব করে এই ঘটনা জানার পর তার ডিভোর্সের চেয়েও খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। কারণ, সে ভাবতেই পারে না তার ছেলে একজন সমকামী এবং গোপনে এমন কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারে। আরতি অর্ণবকে দোষারোপ করে এবং অর্ণবই সিদ্ধার্থকে এমন সম্পর্কে জড়াতে প্ররোচিত করেছে বলে জানায়। এরপর আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় আরতির সাথে অর্ণবের সম্পর্ক ভালো হয় এবং শেষে আরতি চলে যায়।
সকল সম্পর্কই মূলত অনুভূতি নির্ভর। অন্য সবকিছু ছাপিয়ে যেকোন সম্পর্কে তাই অনূভুতিই মূখ্য হয়ে ওঠে। আর তাই বিকৃত-অবিকৃত সম্পর্ক বলে কিছু নেই। কিন্তু সামাজিকভাবে সমলিঙ্গের সম্পর্কগুলোকে আমাদের সমাজে বিকৃত কিংবা অস্বাভাবিক ভাবে দেখা হয়। যেখানে সম্পর্কের মানবিক বিষয়টি উপেক্ষিত হয়। এই চলচ্চিত্রে আমরা দেখি পৃথিবীর সকল ভালোবাসার সম্পর্কগুলো আসলে একই রকম।
আর তাই, ছেলে হারানোর কষ্টে কাতর আরতি যতোখানি বেদনা অনুভব করে, ঠিক ততোখানি বেদনা অনুভব করে সিদ্ধার্থের প্রেমিক অর্ণব। দুটো সম্পর্কের মাত্রা আলাদা হলেও যে যার জায়গা থেকে একই রকম কষ্ট অনুভব করে। এই কষ্ট প্রিয়জন হারানোর কষ্ট। সকল কষ্টের অনুভূতি আসলে একই রকম। তখন সম্পর্কের চিরায়ত ধারণা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
প্রতিটি সম্পর্কেরই আলাদা আঙ্গিক রয়েছে। মূলত সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক ভালো লাগা, যত্ন, বোঝাপড়া এবং হৃদয়ঘটিত অনুভূতির মাধ্যমে। একজন নারীর প্রতি পুরুষের ভালোবাসার সম্পর্ক যেমন অনুভূতি নির্ভর, তেমনই একজন পুরুষের প্রতি পুরুষের ভালোবাসাও অনুভূতিনির্ভর। এর সাথে লিঙ্গের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে চলচ্চিত্রে আমরা দেখি শাহানা যখন আরতিকে বলে সিদ্ধার্থের স্পেশাল সম্পর্ক রয়েছে তখন আরতি বলে, কান্ট বি মোর স্পেশাল দ্যান আ মাদার এন্ড এ চাইল্ড। অর্থাৎ, মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের চেয়ে স্পেশাল কোনো সম্পর্ক হতে পারে না। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই আরতি তার সন্তানের মৃত্যুতে যেমন মর্মাহত, বেদনা ভারাক্রান্ত, ঠিক তেমনি অর্ণবও তার প্রেমিকের মৃত্যুতে মর্মাহত, বিষাদ্গ্রস্ত। এবং সে সম্পর্ক মা-ছেলের সম্পর্কের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
অর্ণব এবং সিদ্ধার্থ পরস্পরকে ভালোবাসে। আরতি যেমন তার সন্তানকে ভালোবাসে সন্তান হিসেবে, মাতৃত্বের টানে ঠিক তেমনই অর্ণবও সিদ্ধার্থকে ভালোবাসে। কিন্তু সমাজের চোখে প্রথম সম্পর্কটি যতোটা স্বাভাবিক দ্বিতীয় সম্পর্কটি অতোটা স্বাভাবিক নয়। কারণ, মায়ের সাথে সন্তানের ভালোবাসার সম্পর্ক সামাজিকভাবে বৈধ এবং নির্মিত হলেও একজন পুরুষের সাথে পুরুষের সম্পর্ক সমাজে বৈধ নয়।
এছাড়া, নারী-পুরুষের সম্পর্কের সাথে যৌনতার সূত্রিতা যেমন সমাজ অনুসন্ধান করে তেমনি ছেলে-ছেলে কিংবা মেয়ে-মেয়ে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও যৌনতার সূত্রিতা মানুষ অনুসন্ধান করে। সমাজ ভেবেই নেয় এসব সম্পর্কের মূল প্ল্যাটফর্ম যৌনতা। আর তাই যখন সিদ্ধার্থের আবাসস্থলে তাঁর মা কনডম পায়, তখন তাঁর মনে আশার সঞ্চার হয় যে, আর যাই হোক তাঁর ছেলে সমকামী নয়। সমকামী হলে বাসায় কনডম থাকতো না।
আদতে যৌনতাই সম্পর্কের মূল বিবেচ্য বিষয় নয়। একটা সম্পর্কে যৌনতা ছাড়াও আরো অনেক বিষয় থাকে। চলচ্চিত্রে আমরা দেখি, সিদ্ধার্থ তাঁর মাকে জানাচ্ছে সে যাকে ভালোবাসে সে লাভিং, কেয়ারিং, রূচিশীল একজন মানুষ। সে তাকে খুশি রাখে, আনন্দ দেয়। যেভাবে আরতি সিদ্ধার্থকে খুশি করে, আনন্দিত করে।
দুটি সম্পর্কের প্রেক্ষাপট আলাদা হলেও অনুভূতির দিক থেকে দুটি সম্পর্কই একই সূত্রে গাঁথা। কিন্তু আরতি কোনভাবেই এই সম্পর্ককে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে ইচ্ছুক নয়। পোশাক এবং বাহ্যিক সাজসজ্জায় আরতি আধুনিকা হলেও চিন্তা চেতনায় সে চিরায়ত সমাজের উর্ধ্বে যেতে পারে না। তার কাছে তার ছেলের এই সম্পর্ক তাই এবনরমাল। তাঁর নিজের অবহেলার কারণে এমন হয়েছে কি না সে অর্ণবের কাছে জানতে চায়। তার কৌতূহলী মন জানতে চায়, ঠিক কি কারণে সিদ্ধার্থ এমন একটি সম্পর্কে জড়ালো।
কারণ, সিদ্ধার্থের প্রতি অনেক মেয়েরই দুর্বলতা ছিলো। আরতি অবাক হয় শাহানার মতো সুশ্রী, স্মার্ট একজন নারী সহকর্মী থাকতে সিদ্ধার্থ কেনো অর্ণবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। চাইলেই সিদ্ধার্থ শাহানার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো এবং সমাজের চোখে সে সম্পর্ক স্বাভাবিক সম্পর্ক হতো।
এখানে আমরা দেখতে পাই, সম্পর্ককে দেখার সেই এক রৈখিক দৃষ্টি যা থেকে আরতি বের হয়ে আসতে পারে না। কথাবার্তা, চালচলনে আধুনিক হলেও চিন্তা চেতনায় সে চিরায়ত সামাজিক ঘেরাটোপে বন্দী। ফলে আরতি বলে, সে স্বপ্নেও ভাবেনি সিদ্ধার্থ এমন কোনো সম্পর্কে জড়াবে। সিদ্ধার্থ তাঁর মাকে সবই জানাতো। কিন্তু এই সম্পর্কের কথাই সে কখনও জানায়নি। কারণ, সিদ্ধার্থ নিজেও ভীত সন্ত্রস্ত্র ছিলো। সে জানতো, সামাজিক সংকীর্ণতা পেরিয়ে এই সম্পর্ক কোনদিন সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে না। যে সমাজে আমাদের বসবাস সে সমাজে সম্পর্ককে মানবিক দৃষ্টিতে দেখা হয় না বরং সামাজিক কাঠামোর আলোকে দেখা হয়। ফলে, মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি এখানে অগ্রাহ্য হয়। প্রথাগত সম্পর্কের বাইরের সম্পর্ক গুলোতে নেমে আসে সংকট।
সন্তান সমকামী জানার পরে আরতির মন চুরমার হয়ে যায়। কোনোভাবেই সে মেনে নিতে পারে না তাঁর সন্তান একজন সমকামী। অর্ণব আরতিকে জিজ্ঞেস করে,
What is more acceptable to you? The fact that he is no more or the fact that he is a gay.
আরতি তখন উত্তর দেয়,
You know, the fact that he is no more is something I can never, ever, ever come to terms with and the fact that he is gay is I think no matter I tried pretend, I understand or I actually truly trying understand but still deep inside me honestly speaking as a mother I don’t think, I will except the fact that my son is a gay.
এই আলাপচারিতায় স্পষ্টই ফুটে ওঠে আমাদের টিপিক্যাল সমাজের চালচিত্র। অর্থাৎ যেকোনো আঙ্গিকেই ব্যাখা করা হোক না কেন সমাজ কখনোই সমকামী একটা সম্পর্ককে মেনে নিতে পারবে না। ক্রমশ আরতি অনুভব করে একজন মা হিসেবে সে সিদ্ধার্থকে যেমন ভালোবাসে এবং সিদ্ধার্থের মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছে তেমনই অর্ণবও সিদ্ধার্থকে ভালোবাসে, এবং সিদ্ধার্থের মৃত্যুতে কষ্ট পাচ্ছে। আরতি দেখতে পায়, সিদ্ধার্থ এবং অর্ণবের একই কলারটিউন। শুধু তাই নয়, অর্ণবের ফেসবুক পাসোয়ার্ডের মতো ব্যাক্তিগত বিষয়ও অর্ণব জানে। ক্রমান্বয়ে আরতির সাথে অর্ণবের সম্পর্ক ভালো হয়। আরতি অর্ণবের জন্মদিন উদযাপন করে। এবং বিদায় বেলা অর্ণবকে তাঁর ব্যাবহৃত সানগ্লাস উপহার দিয়ে যায়। একই দুঃখে দুঃখী দু’জন মানুষের সম্পর্ক কতো দ্রুত গড়ে উঠতে পারে তাও এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে।
সম্পর্ক থেকে মানুষ মূলত অনুভূতি চায়। আর অনুভূতির কোন জেন্ডার হয় না। অনূভুতিশীল যেকোনো সম্পর্কই তাই সুন্দর, মানবিক। কিন্তু সামাজিক নির্মাণের বাইরে যে সম্পর্কগুলো থাকে, তা বিবিধ সংকট পেরিয়ে হয়তো মুমূর্ষু অবস্থায় টিকে থাকে। তবুও সেসব সম্পর্ক চর্চিত হয় গোপনে। দু’জন দু’জনের নিজস্ব পৃথিবীর যে ধরন, তা সমাজ অনুভব করতে ব্যার্থ হয়। সম্পর্ক চলমান সময়ের স্মৃতি, মেমোরিজ ইন মার্চ। যে স্মৃতির পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে অনন্য অনুভূতি। সেই অনুভূতির প্রতি যেন সমাজ শ্রদ্ধাশীল হয়, মেমোরিজ ইন মার্চ তেমনই এক ইঙ্গিত রেখে যায়।