দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিলেই সুখী আপনি

মনিজা রহমান:

সুখী হতে কিছু লাগে না। কিছুই না। শুধু দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে নিলেই হয়।
প্রশ্ন করতে পারেন, ‘বললেই হলো? এতো সহজ! আমার মতো অবস্থাতে থাকলে আপনি বুঝতেন কষ্ট কাকে বলে!’

ধরুন, যদি বলা হয়, ওই কষ্টকর অবস্থাকে মেনে নিয়ে তার মধ্যে ইতিবাচক কিছু খুঁজতে বলা হলো আপনাকে, তাহলে কেমন লাগবে? একেই বলে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

সাড়ে সাত বছর বয়সী আমার একটি অটিস্টিক সন্তান আছে। স্বাভাবিকভাবে আমি নিজেকে প্রচণ্ড অসুখী মা ভাবতে পারি। কিন্তু যদি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে নিয়ে ওই সন্তানকেই ভাবি ঈশ্বরের আশির্বাদ, তবেই তো আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মা।

আমেরিকায় অটিস্টিক সন্তানকে বলা হয় ‘স্পেশাল বেবি’। আর সৃষ্টিকর্তা তো স্পেশাল বেবিকে সেই বাবা-মাকেই দেন, যাদের তিনি বেশি ভালোবাসেন। এই বিশ্বাসটা আপনাকে আমূল পাল্টে দিতে পারে। দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তন আপনাকে করতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।

এই যেমন, আমি ঘরে বসে অটিস্টিক শিশুর বদৌলতে সারা পৃথিবীর নানান দেশের, নানা জাতি-ধর্মের মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারি। এটা কি এমনিতে পারতাম? একজন লেখকের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ আমাদের বাঙ্গালীদের মতো নয়। তারা কিছুটা অন্তর্মুখী স্বভাবের। হাই-হ্যালোর বাইরে সেভাবে কথা বলে না। এমনিতে তারা খুব বিনয়ী, উষ্ণ হৃদয়ের অধিকারী। কিন্তু তাদের কাছাকাছি যেতে হয় কোনো একটা কাজের মাধ্যমে।

আমার ছেলে স্পেশাল হওয়ায় নিউইয়র্ক সিটি থেকে অনেক হোম সার্ভিস পায়। সেই সার্ভিস দিতে আসে নিউইয়র্কে বসবাসরত বহু দেশের বহু সংস্কৃতির মানুষ। আমি তাদের সাথে কথা বলি। আমার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার জন্য পর্বতমালা দেখতে যাবার, কিংবা ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দেবার দরকার হয় না। ঘরে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করি। আর কল্পনার চোখে দেখে নেই ওদের জীবন যাপন।

যে মেয়েটা আমার ছেলের হোম এ্যাটেন্ডেন্ট, ওর বাড়ি গায়ানায়। সমুদ্রের পাড়ে বাড়ি ওর্। স্বামী আর শিশু দুই সন্তানকে দেশে রেখে নিউইয়র্কে চলে এসেছে মা-বোনদের সঙ্গে। ও যখন চলে আসে তখন বড় ছেলের বয়স দুই বছর আর ছোট ছেলের মাত্র তিন মাস। কী হৃদয় বিদারক এই চলে আসা! মেয়েটি মাঝেমধ্যে খুব বিষন্ন হয়ে যায়। মোবাইল খুলে বার বার শিশু সন্তানদের ছবি দেখে। ওরা কোনো পার্টি বা অনুষ্ঠানে গেলে সেই ছবি দেখে খুটিয়ে খুটিয়ে। কখনও সন্তানদের অসুস্থতার খবর এলে চোখ ভেসে যায় জলে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওর সজল চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তাপ পাই একজন চিরন্তন মায়ের।

মেয়েটির নাম ফিউনা, ওর লড়াইটা যখন দেখি, তখন মা হিসেবে আমার নিজেকে অনেক সুখী মনে হয়। শিকড় উপড়ে একটা নতুন দেশে আসা খুব সহজ নয়। আবার সেটা যদি হয় শিশু সন্তানদের রেখে আসার মতো ঘটনা, তবে তার চেয়ে কষ্টের কী আছে! মেয়েটি দৈনিক ষোল ঘন্টা কাজ করে। আর কাজের জায়গায় আসা-যাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শপিং করে। আগামী ক্রিসমাসে গায়ানায় যাবে ও, স্বামী আর সন্তানদের কাছে। সেই আনন্দের ভাবনা নিয়ে কষ্টকর দিনের শেষে হাসিমুখে ঘুমাতে যায়।

ফিওনার মা লিসাও হোম এটেন্ডেন্টের কাজ করে। উইকএন্ডেও মাঝে মাঝে আসে। আট চল্লিশ বছর বয়সী লিসাকেও দৈনিক ১৬ ঘন্টা কাজ করতে হয়। তবুও মনে করে এটাই নাকি সুখের জীবন! গায়ানায় ওর পেশা ছিল সাগরে মাছ ধরা। রোদে, বৃষ্টিতে, ঝড়ের মধ্যে সাগরে নৌকার মধ্যে মাছ ধরতে হতো। রোদে পুড়ে ওর চেহারা ছিল কর্কশ, চামড়া ছিল পোড়া, পোষাক ছিল জীর্ণ-শীর্ণ। ওর সেই সময়ের ছবি দেখিয়েছিল একদিন আমাকে। চেনাই যায় না। খেটে খাওয়া সেই মানুষটি এই শহরে এসেও খেটে যাচ্ছে দিনরাত, তবু তার মধ্যে কোথায় যেন বিরাট পার্থক্য আছে!

এই শহরে বহু মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য নিজের শখের কাজকে বিসর্জন দিতে হয়। আপনারা এখানে যাদের লেখক-কবি হিসেবে দেখেন, জানেন, সম্মান করেন, তাদের অনেককে টিকে থাকার জন্য অড জব করতে হয়। কেউ ট্যাক্সি চালায়। কেউ হোটেল-রেস্তোরায় ওয়েটারের কাজ করে। কেউ পথের ধারে দোকানদারি করে। কারণ শখের কাজে আর্থিক প্রাপ্তি ঘটে না।

যেমন আমার ছেলের অকুপেশনাল থেরাপিস্ট পেশায় একজন মিউজিশিয়ান। অর্কেষ্টায় নানান বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন নিজ দেশ লাতভিয়ায়। এই দেশে আসার পরে হয়ে গেলেন থেরাপিস্ট। লাইব্রেরিতে বসে অন লাইনে কোর্স করলেন। তাঁর দেশের শিক্ষাগত যোগ্যতার এখানে কোনো গুরুত্ব নেই। এখন তিনি গাড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা বয়সী মানুষকে থেরাপি দিয়ে বেড়ান। আর স্বপ্ন দেখেন, হয়তো ব্রডওয়ের কোনো বড় মঞ্চে আবারও দলবল নিয়ে অর্কেষ্টায় মাতাবেন দর্শকদের।

নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষ যে শুধু আমার ছেলেকে থেরাপি দেবার জন্য লোক পাঠায় তাতো নয়, ছেলের মাকেও ট্রেনিং দেয়া হয়। আমাকে প্রথম ট্রেনিং দিতে এসেছিল ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। ওর কাছেই প্রথম দেখেছিলাম ছবিটা। ছবিটা দেখে একবার মনে হয়েছিল কোন বুড়ির মুখ। আরেকবার মনে হলো, কোনো তরুণী মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। প্যারেন্ট ট্রেনার বললো, এটা তোমার দেখার ওপর নির্ভর করছে। তুমি যেভাবে বিষয়টা দেখতে চাও। আমাকে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কথা বললো। কিন্তু আমি হেসে প্যারেন্ট ট্রেনারকে জানালাম, তুমি শেখানোর আগেই আমি এটা শিখেছি। যে কারণে আমি অনেক সুখী।

ছেলেকে কিভাবে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ করতে হবে, তাকে কিভাবে পরিচালনা করতে হবে, তার নানা ধরনের হাইপার এ্যাকটিভিটিজে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, সেটাই ছিল প্যারেন্ট ট্রেনারের শেখানোর বিষয়। প্রতি সপ্তাহে দুই ঘন্টার জন্য আসতো মেয়েটি। ওর বাবা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আর মা শ্বেতাঙ্গ। সন্তানকে শিক্ষাদানের অনেক পদ্ধতি আমি শিখেছি ওর কাছে। যে শিক্ষাটা শুধু আমার স্পেশাল সন্তানের জন্য নয়, আমার টিপিক্যাল সন্তানের জন্যেও কাজে লেগেছে।

প্যারেন্ট ট্রেনারের চার মাসের কোর্স শেষ হবার পরে আমার বাসায় আসা শুরু করেছে টয়লেট ট্রেনার। আমার ছোট ছেলে সাড়ে সাত বছর বয়স হবার পরেও কমোডে বসতে চায় না এই জন্য টয়লেট ট্রেনারের আগমন। সত্যি কথা বলতে কী, আইরিশ ওই ভদ্রমহিলা ফোন করার আগে আমার কল্পনাতেও ছিল না, অটিস্টিক শিশুদের জন্য টয়লেট ট্রেনার দেয়া হয়। ভদ্রমহিলার অধ্যবসায় অসাধারণ। এতো নানা উপায়ে সে আমাকে সাহায্য করে, পরামর্শ দেয়, আমার ছেলের এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য, বলার নয়!

আমার ছেলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রতি সপ্তাহে একজন নার্স আর হোমওয়ার্কে সাহায্য করার জন্য প্রতি সপ্তাহে একজন টিচার আসেন। দুজনেই বয়সে তরুণ। নার্স যে ছেলেটি, ওর বয়স ২৩ বছর, উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে আগত এক ইহুদি পরিবারের সন্তান। এখানে ধর্মের কথা উল্লেখ করলাম, কারণ ছেলেটি মাথায় কালো ছোট টুপি পরে আসে। সে খুবই ধর্মপরায়ণ। বাইরের কোনো খাবার খায় না। ধর্মীয় সব আচার অনুষ্ঠান নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। তার ২০ বছর বয়সী স্ত্রী, রক্ষণশীল মুসলমান নারীদের মতোই মাথার চুল ঢেকে রাখে।

যে টিচারটি আসে প্রতি রবিবার, তাঁর বয়স নার্সের চেয়েও কম, মাত্র ১৯ বছর। সে কৃষ্ণাঙ্গ। চার ভাইবোনের পরিবারে বড় সন্তান। অত্যন্ত দায়িত্বশীল। কালো বলতে যেমন রগচটা, খ্যাপাটে লোকজনকে আশে পাশে দেখা যায়, তেমন নয়। প্রতি শনিবার সে নিয়ম করে গির্জায় যায়। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। নার্সের মতোই প্রচণ্ড ধর্মাপরায়ণ সে।

আসলে প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা গল্প আছে। ঘনিষ্ঠভাবে মিশলে সেই জীবনের গল্পটি শোনা যায়। আর শ্বেতাঙ্গ হোক, কৃষ্ণাঙ্গ হোক আর এশিয়ান হোক, প্রত্যেকে তার পরিবারকে খুব ভালোবাসে। পরিবারের গল্প করতে গিয়ে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে যায় চোখমুখ।

অটিস্টিক সন্তানও একটি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলা যেতে পারে। কারণ সে স্পেশাল, তার অগ্রাধিকার বেশি। যে কারণে সবার আগে তার চাওয়া-পাওয়ার মূল্য দিতে হবে। তার ইচ্ছাকে, তার সুযোগ সুবিধাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন সাজাতে হবে বাবা-মাকে। যে পরিবারে একটি অটিস্টিক সন্তান থাকে, আর সেই পরিবারের সদস্যরা যদি তাকে গুরুত্ব দেয়, তাকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসে সেই পরিবারে সৃষ্টিকর্তার বিশেষ আশির্বাদ থাকে। এটা আমার বিশ্বাস শুধু নয়, নিজের জীবনে এর প্রমাণও আমি পেয়েছি।

লেখালেখি করার জন্য ভাবি কোথায় বেড়াতে যাবার কথা, অনেক মানুষের সঙ্গে মেশার কথা, কিন্তু দেখুন এখন পুরো বিশ্বের মানুষরাই যেন আমার বাড়িতে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে পেরেছিলাম বলেই, বিশাল ক্যারিয়ারের স্বপ্ন ত্যাগ করতে পেরেছিলাম বলেই, আর ছোটখাটো সুযোগকে জীবনে লুফে নিয়েছিলাম বলেই আমি সুখী। কারণ জানতাম, সুযোগ দরজায় খুব আস্তে করে টোকা মারে। এজন্য কান পেতে থাকতে হয়!

শেয়ার করুন: