যোদ্ধা নারীর গল্প

মাশরুফ হোসেন:

দুবছর আগে পহেলা বৈশাখে রমনার বটমূলে দলবেঁধে মেয়েদের গায়ে হাত দিয়ে যৌন নির্যাতন করা হয়, এ নিয়ে সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আমার বোনটা তখনো আমেরিকা যায়নি, আমি জাপানে। গা শিউরে উঠেছিল ওকে এরকম পরিস্থিতির শিকার কল্পনা করে, তাই ফেসবুককে বেছে নিয়েছিলাম প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে, ক্ষুদ্র সামর্থ্যে যতটুকু কুলায় ততটুকু।

গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম, মেয়েদেরকে এভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে যৌন নির্যাতন করার সাহস যে কারণে বীর বঙ্গপুরুষেরা পায় তার অন্যতম হচ্ছে হাজার বছর ধরে পালন করা দাসত্বের মাইন্ডসেট। আমাদের দেশে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বড় বোনকে রাস্তা পার হতে বাবা মা পাঠায় ক্লাস ফাইভে পড়া পিচ্চি ভাইটাকে। এই মাইন্ড সেট পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু লেখা লিখলাম, কেউ কেউ এতে উপকৃতও হলেন। খালি হাতে আত্মরক্ষার কিছু সহজ টেকনিক, যেগুলো বাসায় বসে নিজেই শেখা যায়- এমন কিছু লেখা লিখবার পর দেখলাম ইনবক্সে সাড়া আসতে লাগলো। বেশ কয়েকজন নারী জানালেন যে তাঁরা প্রতিবাদ করা শুরু করেছেন, পাল্টা মার দিয়েছেন।

এভাবেই চলছিল, তবে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এত সহজে মেয়েদের পাল্টা মার দেয়া মেনে নেবে এটা ভাবাটাই বোকামি। কুৎসিৎ সব কথাবার্তা বলা হতে লাগল আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছিল “খেদা হাতির” দল। খেদা হাতি হচ্ছে বন বিভাগের সেই সব পোষা হাতি যারা বুনো হাতিকে মানুষের দাস বানাতে সাহায্য করে। মানব সমাজেও এমন খেদা হাতি আছে, এনারা উঠে পড়ে লাগলেন আমার বিরুদ্ধে। আমার ব্যক্তিগত জীবন, পেশা, পরিবার, ভাইবোন বন্ধুবান্ধব কেউই বাদ যায়নি এনাদের নোংরা আক্রমণ থেকে। বিরক্ত হয়ে একসময় লেখাই বন্ধ করে দিলাম। জীবনে সেল্ফ ডিফেন্সের দন্ত স-ও চোখে না দেখা মানুষজনও এক্সপার্ট অপিনিয়ন দিতে লাগলেন কেন মেয়েদের সেল্ফ ডিফেন্স শেখা খারাপ এই নিয়ে। অতিষ্ট হয়ে ভাবলাম, স্ক্রু দিস শিট, আই হ্যাড এনাফ!

দেশে আসার পর পাহাড়ে বদলী হলাম, দারুণ কাটছিল দিনগুলো। হঠাৎ শুরু হলো নতুন ট্রেন্ড, চলন্ত বাসে মেয়েদের ধর্ষণ ও হত্যা। এবার ঠিক করলাম, আর লেখালেখি না, অফলাইনে, বাস্তবে কিছু করব। মাটির প্রদীপ রাতের অন্ধকার হয়ত দূর করতে পারেনা সূর্যের মত, কিন্তু তার আশেপাশের ছোট্ট জায়গাটুকু তো আলো করতে পারে! যত সামান্যই হোক, এটুকু তো করা যায়!

আশার আলো হিসেবে হাত বাড়ালেন সেনসেই আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ হোসেন, কিউকুশিন কারাতের থার্ড ডান ব্লাকবেল্ট, পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ট্রেনিং এর মান ঠিক রাখতে যেটুকু খরচ না নিলেই না, এরকম একটা খরচ উনি ঠিক করলেন, আমি সম্মতি দিলাম। ঠিক করলাম, বিশটা মেয়েকে ট্রেনিং দেব, দশজনের খরচ নিজেরা বহন করবো, আর বাকিরা নিজ খরচে করবে, যারা পারবে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসাধারণ কিছু মানুষ, তাঁরা স্পন্সর করলেন কয়েকজন অচেনা মেয়েকে।

প্রায় একশ এ্যাপ্লিকেশন থেকে বিশ জন বাছাই করলাম দুজন মিলে। এরা বিভিন্ন পেশার, সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি। এদের অনেকেই ছেলেবেলায় নির্যাতিত হয়েছে, সবাই কোনো না কোনো সময়ে সেক্সুয়াল এ্যাবিউজের মুখোমুখি হয়েছে। তবে সমাজের শিখিয়ে দেয়া “চুপচাপ মেনে নাও” বুলি না মেনে নিয়ে এরা পাল্টা আঘাত করতে যায়, এবং সেটার প্রস্তুতি নিতে এরা ঘাম ঝরাতে প্রস্তুত।

শুরু হলো ট্রেনিং। প্রায় বিশ বছরের সেনা ও পুলিশ ট্রেনিং এর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইট ওয়াজ ব্রুটাল। মেয়ে বলে এক বিন্দু ছাড় দেয়া হয়নি কাউকে, এমনকি মেন্সট্রুয়াল সাইকেল নিয়েও এরা ট্রেনিং করেছে। কঠোর পরিশ্রম করতে করতে এরা বমি করেছে, কেঁদেছে, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে, তাও হাল ছাড়েনি।

না, আমাদের বলতে হয়নি-নিজেরাই করেছে। ওদের যুক্তি ছিল, বদমায়েশরা তো আমাদের দয়া দেখাবে না, তাহলে ট্রেনিং এর সময় দয়া নিয়ে অনুশীলন করবো কেন?

ষোলটা মূল এবং একটা অতিরিক্ত ক্লাস এবং আইন কানুনের ক্লাসসহ মোট সতেরটি ক্লাস শেষ হল গতকাল। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম, কি বিপুল আত্মবিশ্বাস নিয়ে ইয়া মোটা কাঠের প্লেট আমার মেয়েরা এক আঘাতে দুটুকরো করে ফেলল! যারা পারেনি, তাদের ভেতরেও কী দৃঢ় প্রত্যয়!!! কাঠ ভাঙাটা মূল কথা নয়, ওদের ভেতরে ওয়ারিয়র মাইন্ডসেট যেভাবে প্রবেশ করেছে, এটা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছি বার বার। কেউ দেখেনি, গর্বে নিজের অজান্তেই চোখ মুছেছি লুকিয়ে!

মাত্র বিশজন দিয়ে শুরু, ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে দ্বিতীয় ব্যাচ আরম্ভ হবে, এবার চল্লিশ জনকে ট্রেইন করার ইচ্ছে। তবে এবার স্পন্সরশিপ যা আসবে তা দিয়ে কাউকে ফ্রি না করিয়ে সবাইকে সমানভাবে বন্টন করে দেয়া হবে।
এই মেয়েগুলো আমার আর আব্দুল্লাহ সেনসেইয়ের সব বিফলতা আর ব্যর্থতার জবাব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খেদা হাতিদের মুখের উপর মূর্তিমান চপেটাঘাত ওরা।

এরা একদিন সারাদেশে ছড়িয়ে যাবে।
আমি হয়ত সেদিন থাকবনা, কিন্তু এই স্বপ্ন সফল হবে দেখে নিয়েন।
ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী মঙ্গল পান্ডের বাণী দিয়ে শেষ করছি-
ফাঁসি তো লাগতি হ্যায় সির্ফ তন কো
কৌন স্বাপনো কো ফাঁসি চাড়ায়?
ফাঁসি তো লাগে স্রেফ শরীরের, স্বপ্নকে ফাঁসি চড়ায় কে?

এই যে শত শত বছর ধরে ইচ্ছেমত মেয়েদেরকে এ্যাবিউজ করেছে এই সমাজ, এর মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছে।
আমি শুনতে পাচ্ছি একেকটা মেয়ের পদাঘাত আর হাতের কারাটে চপে মোটা কাঠ দুটুকরো হবার কড় কড় শব্দের মাধ্যমে।
আপনারা শুনতে পাচ্ছেন কি?

#যোদ্ধানারী_বাংলাদেশ

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.