শেখ তাসলিমা মুন:
পেশাগত জীবনে আজকের মেয়েরা তাদের কর্মক্ষেত্র নিজেদের দখলে নিয়ে আসতে পেরেছে অনেকটাই। তবুও সব পেশায় নয়। এখনও মেয়েদের পেশা এবং কর্মক্ষেত্র এক বিভীষিকা। তাকে মোকাবেলা করেই নারীকে পেশা জীবনে টিকে থাকতে হচ্ছে। এ যুদ্ধ নারীর একার। এ বিজয়ও নারীর একার।
একজন নারীকে কীভাবে প্রফেশনে টিকে থাকতে হয়, সেটা আমি আমার অ্যাডভোকেট বন্ধুদের দিয়ে দেখেছি। বেশিরভাগ অ্যাডভোকেটদের শুরুতে একজন সিনিয়রের আন্ডারে কাজ করতে হয়। এই সিনিয়ররা তাদেরকে ব্যবহারের চূড়ান্ত করেই ক্ষান্ত থাকে না। ‘জুনিয়র’ যদি মেয়ে হয়, সে ‘স্টোরি’ হয় এক মহাভারত। বেশিরভাগ চেম্বারগুলো রাতে হয়। আইন পেশার সাথে যারা জড়িত তাঁরা এটি ভালো বুঝবেন। সারাদিন কোর্টে থাকতে হয় বলে তাঁদের নিজস্ব অফিস রাত দশটা পর্যন্ত চলা স্বাভাবিক। এমনকি তার থেকেও বেশি রাত পর্যন্ত। আমার এক বন্ধু যখন সিনিয়রের চেম্বারে যায়, তাঁর হাজব্যান্ড তার সাথে চেম্বারে যায় এবং সেখানে বসে থাকে। কী মর্মান্তিক দৃশ্য!
বলছি কিছুদিন আগের কথা। এখন কী হয় আমি ভালো জানি না। আমি অবাক হয়ে বন্ধুকে বললাম, অফিস করবি তুই, আর তোর স্বামী থাকবে বসে তোর অফিসে? কী বলিস?
হ্যাঁ, তাঁর স্বামী বসে থাকে সে অফিসের কেউ না হয়েও। এবং একজন বহিরাগত হিসেবে সে সেই অফিসে বসে থাকায়ও কোনো সমস্যা হয় না। তিনি তাঁর স্ত্রীকে পাহারা দেন। এটা তাঁর কর্তব্য। আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর আত্মসম্মানে লাগে না? তুই অফিস করছিস, আর তোর স্বামী সমস্ত সময়টা পাহারা দেবে?
আমার বন্ধু বললো, উপায় কী? কাজ করতে পারছি সেটাই তো অনেক। সে বসে থাকে বলেই এ অফিসের অনেকে আমার সাথে ‘কুব্যবহার’ করার সাহস পায় না। বরং ‘দুলাভাই’ চা খাবেন বলে সমীহ করে। কিছুক্ষণ পর আমার অ্যাডভোকেট বন্ধু বললো, জানিস আমাদের দেশের মেয়েদের চাকরি করা কী যে ডিফিকাল্ট!
আমার স্বামী বলে, আমি একজন পুরুষ মানুষ এবং সেজন্যই আমি জানি কর্মক্ষেত্রে পুরুষের মানসিকতা কী! এবং জানি বলেই আমি আমার স্ত্রীকে একা সেখানে ছেড়ে দিতে পারবো না। চাকরি করতে হলে এই শর্তেই করতে হবে। ফলে আমিও মেনে নিয়েছি, যেহেতু কাজ করা আমার জন্য দরকারি। আমি ঝামেলা চাই না।
আমার বন্ধু একটু থেমে বললো, জানিস আমার স্বামী একেবারে ভুল নয়। এর আগে কয়েকটি চেম্বারে এবং এই চেম্বারেই আমি আমার সিনিয়র দ্বারা যেভাবে ট্রিটেড হয়েছি! আমার স্বামী এসে মক্কেলের সোফায় বসে আছে জেনে বিরক্ত হলেও আমাকে কারণে-অকারণে রুমে ডেকে পাঠানো কমিয়েছে।
আমার এক নিকট আত্মীয় ভাবী পুলিশে কাজ করতেন। সে সময় কোনো মেয়ে পুলিশে কাজ করছে মানে তাঁর পরিবারের মান-সম্মান চলে গেল। বাড়ির বউ পুলিশ? ভাই একবার বাজার থেকে এসে মুখ ভার করে বেড়াতে লাগলো। কী বিষয়? বাজারে তাকে মানুষজন ডেকে বলেছে, মিয়াঁ, তোমার বউ পুলিশ, তোমার বাপ-চাচা-দাদার সম্মান এভাবে ধুলায় লুটিয়ে দিলে? চাকরি কি আর নাই? মেয়ে মানুষ তাও ঘরের বউ হবে পুলিশ? পুলিশ যেন যৌনকর্মির চাকরি! যাই হোক, ভাই ভাবীকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। ভাবী এক প্রকার চাকরি ছেড়েই দিলেন বলা যায়। বহু কষ্টে প্রতি মাসে একটি করে মেডিকেল সার্টিফিকেট জমা দিয়ে তিনি এক বছর কাটালেন। এক বছর পর ভাইয়ের অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিলে ভাবী চাকরিতে জয়েন করেন। সে ভাবী পরে এসপি হিসেবে রিটায়ার্ড করেন।
এই আমাদের মেয়েদের চাকুরি, তাঁদের স্বামী এবং কর্মক্ষেত্র। আচ্ছা, কর্মক্ষেত্রের কথা না হয় বাদ দিলাম। বলবো আমার ছাত্র জীবনের কথা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলএম এর ছাত্রী। বিদেশে এক পা, বাংলাদেশে আরেক পা। মাঝখান থেকে এলএলএম ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়ে দেখা গেল এটেনডেন্সে ঘাটতি কিছুটা। আমার ফর্ম আটকে গেছে। স্যারদের কাছে ছুটোছুটি। পরীক্ষা দিতে না পারার বেদনা মেনে নিতে পারছি না। খুব সামান্য পরিমাণ অনুপস্থিতি। পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ডিপার্টমেন্টে আসেন না।
পর পর কয়েকদিন ফিরে গিয়ে স্যারের বাসায় গেলাম। বসার ঘরে বসে আছি। ফ্যামিলিম্যান। বাচ্চা আছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর স্যার আসলেন। আমার কথা শুনে কথা বলা শুরু করলেন চিবিয়ে চিবিয়ে। বিদেশ গিয়ে আমার গায়ের রঙ ফর্সা হয়ে গেছে জানালেন। ওখানকার খাওয়া-দাওয়া ভালো। টাটকা জুশ। চেহারা তো ভালো হবেই। এরপর শুরু হলো তার স্ত্রী তার থেকে বয়সে কতো ছোট সে গল্প। আমি কিছুক্ষণ পর পর বলছি, স্যার আমার ফর্মটা। উনি বললেন, দাঁড়াও হে! হবে সে হবে! বলে উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। আমি সোজা দাঁড়িয়ে পড়লাম।। ডীন স্যারকে এসে সব খুলে বললাম। বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। স্যার বললেন, তুমি যাও, হলে গিয়ে রেস্ট নাও, দেখি কী করতে পারি!
সেবার একটি অন্ধ ছেলেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রশাসনিক বড় কর্মকর্তার অফিসে গেলাম। কাজটি হলো ছেলেটি এমএ পড়তে চায়। হলে থাকার পারমিশন দিতে হবে। ছেলেটি অন্ধ। আমাদের এলাকার ছেলে। আমি উনার অফিসে গেলে উনি আমার সাথে যে ব্যবহার করেছিলেন সেটি লিখতে গেলে এই ‘সম্মানীয়’ মানুষের নাম চলে আসবে। এতোদিন পর আমি সেটি এড়িয়ে যেতে চাই। কী লাভ পরিবারের মানুষদের কষ্ট দিয়ে? জানিয়ে কী লাভ তাঁদের বাপ এরকম?
শুনেছি ওই অন্ধ ছেলেটির গার্লফ্রেন্ড ওই ভদ্রলোকের বাসায় অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিল এবং তাকেও ওই ‘ভদ্রলোক’ একইভাবে অশ্লীল ব্যবহারের মাধ্যমে ‘কুপ্রস্তাব’ দিয়েছিল। ছেলেটির ভর্তি হওয়া হয়নি। মূল কথা আমি যে একটি কাজ নিয়ে গেছি এবং কোনো কাজই বিনা মূল্যে হয় না, সেটাই হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিতে তারা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে সেটি ভাবতে গেলে শিহরিত হতে হয়। তবুও অনেকবার ভেবেছি, আমার কাজগুলো এমন ছিল যে, সেগুলোর জন্য আমার জীবন থেমে যাবে না। তাতেই যদি তারা এগুলো করতে পারে, আর যাদের জীবন মরণ সমস্যা নিয়ে এসব মানুষদের কাছে যেতে হয়, তখন তারা কত নিচে নামতে পারে সেটি ভাবতে শিহরিত হতে হয়। কতোটা ক্ষমতা তারা প্রদর্শন করতে পারে?
বাংলাদেশের প্রতিটি মেয়ে এক একটি হিরো। তাঁরা যে পরিবেশ এবং বৈরিতা মোকাবেলা করে কাজ করে যায় তাতে বিস্মিত হতে হয়। যৌন হয়রানি ঘাড়ের কাছে নিয়ে তাঁরা পাহাড় সরায়। পাহাড় কেটে তাঁরা পথ করে।
আমি বলবো, তারপরও যে মেয়ে স্বপ্নকে ধরে রেখেছে, তাকে রুখবে কে? কষ্ট অশ্রু বেদনার ইতিহাস ভারি কিন্তু তাঁদের থামানোর সাধ্যও আর কারও নেই। তার সমস্ত যুদ্ধটাই এক হার না মানার যুদ্ধ।