শাফিনেওয়াজ শিপু:
বিলেতে যাওয়ার আগে ধারণা ছিলো এইখানকার বাঙালীরা হয়তো চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারনার দিক দিয়ে আমাদের থেকে অনেক উন্নত। কিন্তু এইদেশে আসার পর কিছুটা হলেও এর ব্যতিক্রম দেখতে পেলাম। ঐ যে, কথায় বলে না, কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না- আসলে আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন নিজেদেরকে সভ্য করার সেটা আসলে জন্ম থেকেই পরিবর্তন করতে হবে, দেশ ত্যাগ করলেও কী, আর না করলে কী!
সেদিন এক রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো দীর্ঘ ১৩ বছর পর। যেহেতু অনেক বছর পর দেখা সেহেতু কথা প্রসঙ্গে অনেক কথা উঠে আসলো। শুরু হলো দীর্ঘ ১৩ বছরে জমে থাকা আমাদের কথোপকথন। যখনই দেশের প্রসঙ্গ উঠলো কথা বলতে বলতে ঠিক ঐ মুহূর্তে রোবেটের বিষয়টিও চলে আসলো।
দ্যাখো শিপু, একটা রোবটকে ওড়না পরানো নিয়ে কতো কথা। পরালে সমস্যা কি? তাছাড়া মেয়ে রোবট বলে কথা! পুরুষ রোবট হলে নিশ্চয় ওড়না পরতে বলতাম না!!! তখন তার প্রশ্নের উত্তরে বললাম, কী এমন দেখলে এই রোবটটির মধ্যে, যার কারণে তাকেও ওড়না পরাতে হবে? আরে ভাই এটা দেখলেও যদি তোমাদের পুরুষজাতিদের মধ্যে যৌন উত্তেজনা হয়, তাহলে আর কিছুই বলার নাই। তাহলে তো বলা উচিত দুনিয়ার সমস্ত কিছুতে, যেমন, জন্তু-জানোয়ার যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য আরো যা আছে সব কিছুতেই ওড়না পরানো উচিত। এরপর সে আবার বললো, আরে আমাদের দেশ মুসলিম দেশ, সুতরাং সবাইকে ঢেকে ঢুকে চললে সমস্যা কি? এর ফলে তো ধর্ষণের সংখ্যাও কমে যেত।
এরপর আমি বললাম, তুমি তো এই দেশে অনেক বছর ধরে আছো। এইখানে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে ওড়না ছাড়া অনেক নারীদেরকে দেখতে পাও। তখন তোমাদের এই ওড়না থিউরি কোথায় যায় বা এইসব নারীদেরকে দেখে যৌন উত্তেজনা জাগ্রত হয় না? এরপর সে বললো, না তখন আমাদেরকে কন্ট্রোল করতে হয়। আর আমরা কিন্তু সবসময় সব নারীদের দিকে তাকাই না।
আরে বন্ধু, তোমার উত্তর শুনে না হেসে পারলাম না, নিজের কথায় নিজেই ফাঁদে পড়ো। এইখানে যদি কন্ট্রোল করতে পারো, কিংবা নিজেকে সংযত করে রাখতে পারো, তাহলে বাংলাদেশে কেন সম্ভব নয়? আসল কথা হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনমানসিকতার পরিবর্তন এবং কুসংস্কার ও গোড়াঁমি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেই সাথে তুমি নিজেও প্রমাণ করলে আমরা বাঙালীরা – জাতে মাতাল তালে ঠিক।
এইদেশে তো তোমরা নারীদের উপর বললেই তো রুল জারি করতে পারবে না, এজন্য যতো রুল তোমরা বাংলাদেশের নারীদের ওপর করো। কারণ তোমরা খুব ভালো করে জানো যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যা রুল বা নিয়ম করবে, নারীরা সেটা পালন করতে বাধ্য। বন্ধু তুমি এতো শিক্ষিত হয়েও এই ধরনের কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে বের হয়ে আসতে পারলে না! আফসোস!
যাই হোক এতো প্রসঙ্গ উঠানোর পরেও আমার বন্ধুটি সেই একই জায়গায় রয়ে গেলো। তখন বুঝলাম বয়ান দিয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না। কারণ আমাদের রক্তের সাথেই মিশে আছে এই ধরনের কুসংস্কার ও নোংরা ধারণাগুলো।
আমার ধারণা ছিলো, যেহেতু উন্নত দেশে বসবাস করছে, সেহেতু কিছুটা হলেও বাঙালীদের মনমানসিকতার পরিবর্তন হবে, তা না হয়ে বরং দেখছি সব ধরনের কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আবৃত তারা।