মহসিনা আফরোজ ইলা:
“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে”। বাণী চিরন্তন এবং অতি জনপ্রিয় বাণী। এই বাণীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে কত গান, কবিতা, চলচ্চিত্র। এমনকি এর আবেদন আজও কমেনি। এখনো মুখে মুখে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। তবে আজকাল এই বাণী উচ্চারিত হবার সময় আক্ষেপই ঝরে পড়ে বেশি। কারণ আধুনিক কর্মজীবী নারীর সংসারে মন নেই। তাই যদি থাকতো, তাহলে পরিবারগুলোতে এতো ভাঙ্গন কেন? কই আগের প্রজন্মে তো এতো অসহিষ্ণুতা ছিল না?
খুব যথার্থ যুক্তি। কয়েক দশক আগেও পরিবার ভাঙ্গার হার এত বেশি ছিল না। এখন বেশি হচ্ছে, কারণ টা কী? নারীরা যে সব সমস্যার কথা বলে, এগুলো তো আগেও ছিল। আগেও সংসারে মেয়েদের দাম ছিল না, তারা অত্যাচারিত হত, কলুর বলদের মত খাটতো, দিনের পর দিন স্বামীর মার খেত, শ্বশুর বাড়িতে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের শিকার হত, সন্তানের অধিকার পেত না। আরও অনেক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হত, যেটা এখনকার মেয়েরা চিন্তাও করতে পারবে না। তাই বলে কি ডিভোর্স ডিভোর্স করে চ্যাঁচ্যাঁতো?
হ্যাঁ, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি যে করতো না, তা নয়। একটা গরুকে অন্যায্য ভাবে পিটালেও তো সে শিং নিয়ে তেড়ে আসে। মেয়ে মানুষ তো মানুষেরই একটা ভার্সন, তাই না? তারও ব্যাথা লাগে। আবার মানুষের শ্রেণীতে পড়ে বলে মন বলেও একটা বস্তু আছে, যেখানে কষ্ট হয়। তাকে আঘাত করলে তো সে চীৎকার করবেই, সময় সময় পালটা আঘাতও করতে চাইবে। কিন্তু তাই বলে, সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার স্পর্ধা তো কখনো করেনি!
এমন শিশুসুলভ প্রশ্ন যখন মানুষ মাথায় নিয়ে ঘোরে, তখন বলতে হয়, ভাই থামেন! আগের যুগের মেয়েরা যে সংসার ছেড়ে যাবে, তা যাবে টা কোথায়? তাদের কি শিক্ষা, দিক্ষা ছিল? বাপের বাড়িতে ঠাই ছিল? খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্যও তো একটা আশ্রয় লাগে, নাকি? কিল, গুতোর সঙ্গে যেখানে দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটে, সেখানেই তো ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকতেই হবে। এ ছাড়া উপায় কী? এই ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকাটা যদি রমণীর গুণ মনে হয়, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আপনারা কি আসলেই বোকা? নাকি ইচ্ছে করে বোকা?
দরজা, জানালা আটকে রেখেও কিন্তু যুগের বদল এড়ানো যায় না। পুরো পৃথিবী বদলে গেলে আপনাকেও বদলাতে হবে। পাশের বাড়ির মেয়ে যখন অনার্স, মাস্টার্স পাশ করে সমাজে বিশিষ্ট ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে, তখন আপনার মেয়েকেও আপনি পড়াবেন। ছেলেদের মতো সেও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে, সমাজে নিজের স্থান করে নেবে, স্বাবলম্বী হবে। সেই মেয়েকে যদি বিয়ের পর একই পরিস্থতির মুখে ঠেলে দিয়ে আপনি আশা করতে থাকেন সব মুখ বুজে সয়ে যাবে, কোন রা কাড়বে না, যে যেমন খুশি ব্যবহার করবে, কিচ্ছু বলবে না। আদৌ কি তা সম্ভব হবে? তার কি ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকার কোনো কারণ আছে?
সত্যি কথা হচ্ছে, এখনো পড়ে থাকে। বেশির ভাগই থাকে। কারণ হচ্ছে, হাজার বছরের মানসিকতা। সব থেকেও নিজের উপর ভরসার অভাব। আর আছে নিরাপত্তার অভাব। এই অভাবগুলো কিন্তু গৌণ। খাওয়া, পরার মতো মুখ্য নয়। তাই যত দিন যাচ্ছে, সহ্য না করার সংখ্যাটা বাড়ছে। তাহলে কি পরিবারপ্রথা থাকবে না? নারীর ক্ষমতায়ন মানে কি তবে সংসারে ভাঙ্গন?
আবার থামেন ভাই!
এই যে, সংসার একা রমণীর গুণেই সুখী হবে এই ধারণা নিয়ে আপনারা বগল বাজাচ্ছেন, এখান থেকে একটু সরে আসেন না! সহযোগিতার হাত আপনারাও বাড়ান। সংসার বাঁচাতে নারী যদি তার একতরফা দায় থেকে পিছু হটতে থাকে, আপনারা এক পা, দুই পা করে এগিয়ে আসেন। আয় রোজগারের দায়িত্ব যখন দুজনই নিয়েছেন, সংসার পরিচালনার দায়িত্বও দুজন মিলে নেন। তাহলেই তো দ্বিগুণ বোঝার চাপে জেরবার কর্মজীবী নারী একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর আপনার প্রিয় সংসারটাও বাঁচে।