সমাজের কোন জায়গায় নারীরা নিরাপদ?

আসমা খুশবু:

জীবন – ১

বাংলোর বড়বাবুর জন্য রান্নার লোক দরকার। সংবাদটি শোনার পরে ভুবন দৌড়ে বাড়ি আসলো। আগেভাগে বউটাকে নিয়ে গেলে কাজটা হতে পারে। আর বড় বাবু অনেক হোমরা চোমরা মানুষ, তার বউয়ের রান্নার হাত যে ভালো, তাতে খুশি হয়ে মাঝে মাঝে কিছু বকশিশ দিলে বেতনের সাথে মিলে টাকার অংকটা নেহায়েত মন্দ হবে না।

কিন্তু কথাটা বউকে বলতেই বউ বেঁকে বসলো। সে শুনেছে, বড়বাবুর বাংলোয় মালি, ড্রাইভার, আর বাড়তি কাজের জন্য তিনজন পুরুষ আছে, ওখানে সে একলা মেয়ে যেতে সাহস পায় না। স্বামীর দেওয়া সাহস, আর সংসার চালাবার কিছু অতিরিক্ত টাকার জন্য শেষ পর্যন্ত কণিকা রাজি হয়। খুশি মনেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল সে, বেতন পেয়ে ছেলেটার স্কুলের একটা নতুন পোশাক বানিয়ে দেবে, মনে মনে ভেবে নিয়েছে সে।

মাসের মাঝামাঝি একদিন বড়বাবুর বাংলো থেকে সন্ধ্যে বেলা ডাক পরে, বড়বাবুর হঠাৎ আসা কয়েকজন অতিথির রান্নার জন্য। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফেরত আসবে ছেলেটাকে বলে কণিকা যায় মালির সাথে। সে রাতে কণিকার আসতে বেশ দেরি হয়। বড়বাবু রান্নার নাম করে ডাকিয়ে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করে, বাইরে পাহারায় থাকে মালি আর ড্রাইভার। বাড়ি ফেরার পথে সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা তার মনে পরে। চা পাতা তুলতে যাওয়ার পথে তাদের পাড়ার ধীনু পেছন থেকে মুখ চেপে ধরে একটু ঘন গাছের দিকে তাকে টেনে নিয়ে গেছিল। গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে তাকে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। অনেকক্ষণ পরে তার হুঁশ ফিরলে নিজেকে নিজে দাঁড় করিয়ে সে কাজে ফিরে যায়। ওই বয়সেই সে বুঝে গিয়েছিল সে যদি ধীনুর এই অন্যায় সম্পর্কে বলে তাতে ধীনুর কিচ্ছু হবে না, উল্টো তার কাজ বন্ধ হবে, দু’বেলা খাবারের নিশ্চয়তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে মা’কে বলেছিল। মা বলেছিল কাউকে না বলতে, তাহলে আর বিয়ে হবে না।

পরে জেনেছিল তার মতো আরও অনেক মেয়ের সাথে ধীনু একই কাজ করেছিল। কিন্তু ধীনুর কোনো বিচার কোনদিন হয়নি, বউ বাচ্চা নিয়ে বেশ কায়দার জীবন যাপন করে সে। আজকের ঘটনাও নিজের স্বামীকে বলতে পারে না কণিকা। কাজে ফিরে যায় পরেরদিন, তা না হলে মাস শেষে বেতনটা পাবে না। দু’দিন যেতে না যেতেই রান্নাঘরের মেঝেতেই মালি আক্রমণ করে তাকে। একে একে মালি, ড্রাইভার, ঘরের অন্য কাজের লোকটি পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করে। মানুষ নামক হিংস্র পশুর দ্বারা রক্তাক্ত কণিকা বাড়ি ফিরে স্নান করে শরীর পবিত্র করার চেষ্টা করে, আর ভাবে সে কেন অপবিত্র হবে, সে তো কোনো অন্যায় করেনি! গভীর রাতে উঁচু আড়ার সাথে শাড়ি পেঁচিয়ে আত্নহত্যা করে কণিকা।

এমন কতো কণিকার মৃত্যু হয় কতো ঘরের আড়ায়, সে খবর কে রাখে! ফি বছর পাহাড়ে উৎসব হয়। উৎসবের রাতে চলে চোলাই মদের আরেক মহোৎসব। এক বোতল চোলাইয়ের জন্য কতো ঘরের মেয়েদের সর্বনাশ হয়, সে গল্প আড়ালেই থাকে। মায়েরা, ঠাম্মারা আগুন জ্বালিয়ে উঠতি বয়সের মেয়েদের পাশে বসিয়ে রাতভর পাহারা দেয়, তার মধ্যে থেকেও কে কখন শিকারে পরিণত হয়, তা রক্ষা করার ক্ষমতা তাদের থাকে না, শুধু কেটে যায় একটি নির্ঘুম রাত।
ওদিকে উৎসবের মুখরতায় বিভোর থাকে পুরো পাহাড়।

জীবন-২

লাইলী বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া ছোট্ট জমিটা বিক্রি করে দেয় স্বামীর প্ররোচনায়। এই টাকা দিয়ে সে সৌদি আরব যাবে, অনেক টাকা রোজগার করবে, সংসারে সুখ উপচে পরবে। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলা স্বামীর এই সোহাগ তার কাছে নতুন। টাকা হলে মানুষটা তাকে এইভাবেই ভালোবাসবে, ভেবে রাজি হয় সে। একমাত্র সন্তানকে শাশুড়ির জিম্মায় রেখে বিমানে ওঠে সে।

কিন্তু সৌদি পৌঁছাবার পর তার সমস্ত আশা এক ধাক্কায় উড়ে যায়। তাকে থাকতে দেয়া হয় স্টোর রুমের অন্ধকার মেঝেতে। সকাল হলেই কাজ শুরু, গাড়ি পরিষ্কার থেকে শুরু করে থালাবাসন, কাপড় কোনটাই বাদ যায় না। একটু দেরি হলেই অত্যাচার। দু’বেলা কোন রকম খাবার দেয়। দু’দিন যেতে না যেতেই রাতের অন্ধকারে বাড়ির বড় ছেলে তার উপর হামলে পড়ে। পরের দিন বাড়ির কর্তা স্বয়ং। একদম রুটিন মতো, একদিন ছেলে একদিন বাবা! কথা না শুনলেই অত্যাচার। এভাবে এক বছর চললো। লাইলী বাড়ি ফিরে আসে। নির্বাক লাইলীকে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তারা জিজ্ঞেস করে বাড়ি কই, কই যাবেন? কোনো উত্তর নেই তার মুখে। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিরিবিলি জিজ্ঞেস করেন, ‘বুজি, বাড়ি যাবা না’? নির্বাক লাইলী এগিয়ে দেয় এক টুকরো কাগজ আর একটি আইডি কার্ড! কাগজটিতে একটি ফোন নম্বর আর আইডি কার্ডে এক উচ্ছল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখের তরুণীর একবছর আগের ছবি, যার সাথে এই নির্বাক ন্যাড়া মাথা, কালশিটে মুখের লাইলীর কোনো মিল নেই।
বিমান বন্দরের কর্মকর্তা ভাবেন, এই লাইলীকে কি তার স্বামী গ্রহণ করবে? এমন কতো লাইলী প্রতি বছর এই সহিংসতার শিকার হচ্ছে, তার হিসাব কোন মন্ত্রণালয়ের কাছে আছে!

জীবন-৩

প্লেইন ফ্রকটার বুকের কাছে নিজের হাতে কুচি লাগিয়ে দেন ময়ূরের মা। কর্পোরেট শাখার বেশ বড়সড় পোস্টে চাকরি করেন উনি। তার ফ্যাশন আর চেহারার জৌলুসে সবাই তটস্থ। আধুনিক নারী উঁচু হিলের ঠকঠক আওয়াজ তুলে যখন অফিস কম্পাউন্ড পার হোন, তখন সকলে সমীহ করে তাকান। আট বছরের মেয়ের ফ্রকের বুকে কুচি লাগাতে লাগাতে তার মনে পরে আগের দিনের মিটিংয়ে বসের হাতের ঘিনঘিনে স্পর্শ। মেয়ের ফ্রক ঠিক করতে করতে মা ভাবে, এই পৃথিবীর কুৎসিত হাত থেকে এভাবেই রক্ষা করতে হবে মেয়েকে।
যেন কুচি দেওয়া ফ্রক পরলেই আর কোন শকুনের দৃষ্টি মেয়ের দু’খানা মাংসপিণ্ডের দিকে তাকাবে না!

জীবন – ৪

আপু কেমন আছেন? আপনার লেখালেখি খুব ভালো লাগে।
আপু ভালো আছেন?
হ্যালো।
আপনি আছেন অনলাইনে দেখতে পাচ্ছি।
কথা বলেন না কেন?
সেক্স চ্যাট করবি?
ওই তোর রেট কত?
ওই, তোর বুকের মাপ কত?
তুই কোন ধর্মের?
বেশ্যা কোথাকার।
নারীবাদ ফলাস?
পুরুষদের খারাপ বলিস, সাহস কত!
তোরে একবার পাইলে হইতো মাগী….
প্রতিদিন এমন ম্যাসেজে কত শিক্ষিত, আত্ননির্ভর মেয়ের ইনবক্স ভেসে যায় তার ইয়ত্তা নেই! কোনো দক্ষতা কিংবা ক্ষমতাই পারে না ভার্চুয়াল এই ধর্ষণ থেকে তাদেরকে বাঁচাতে।

জীবন – ৫

আমার ঘরভর্তি মেয়ের খুব শখ ছিল। প্রথম সন্তান হবার আগে একটা ছবি চোখের সামনে খুব ঘুরপাক খেত। মেয়ে তার বাবার ঘাড়ে চড়ে বাজার যাচ্ছে, ফটফট করে মায়ের সাথে ঝগড়া করছে, দু’বেণী ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, মায়ের লিপিস্টিকে ভাগ বসাচ্ছে, প্রজ্ঞায় – মননে সবার থেকে এগিয়ে চলছে!

দ্বিতীয় সন্তানটি যখন কন্যা হলো তখন অলরেডি দেশ জুড়ে পাণ্ডবদের ভয়াবহ তাণ্ডবে সংবাদপত্রের পাতা ভারী হচ্ছে দিনদিন। আমার এতো আকাঙ্খার কন্যা সন্তানেরা এখন বিভীষিকাময় ভবিষ্যতের দিন যাপন করে। এখন মনে হয়, একটা ছেলে সন্তান হলে বেশ হতো, তাকে পুরুষ না বানিয়ে মানুষ বানাবার চেষ্টা করে দেখতাম।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.