সুমু হক:
একটি জাতিকে পঙ্গু করে দেওয়া খুব সোজা।
মেরুদণ্ডটা ভেঙে দিতে পারলেই হলো, কোনদিন আর যেন সেই জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায় তাতে করে।
একটি দেশ কিংবা জাতির মেরুদণ্ড তার ইতিহাস, তার সংস্কৃতি, তার বুদ্ধিজীবী শ্রেণিটিকে পঙ্গু করে দিলেই হয়, বাকিটুকু এমনিতেই হয়।
ডোমিনোর মত একটা একটা করে ধসে যায় তার আত্মপরিচয়, নিজস্বতা।
তারপর যেটুকু বাকি থাকে, ধর্মের আফিম আর স্বেচ্ছাচারী শাসন ক্ষমতার বদৌলতে সেটুকুকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে খুব বেশি সময় লাগে না।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের অনুপ্রবেশের সময় থেকে নিয়ে আধুনিক সময়ে রক্ষণশীল ওয়াহাবি ইসলামের স্বেচ্ছাচারি আগ্রাসন পর্যন্ত এই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস একের পর এক সেই পতনের সাক্ষী হয়ে থেকেছে।
কিন্তু বারবার হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও সাধারণ মানুষের মাটির যে সংস্কৃতি, যে শেকড় তাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই মাটির সাথে বেঁধে রেখেছে, সেই সংস্কৃতি একসময় প্রতিরোধ ভেঙে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্তত গত শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত এমনটাই দেখেছি।
তারপর এলো আধুনিক, রাষ্ট্রীয় যূথবদ্ধতার কাল।
খনিজ সম্পদ, নিত্যনতুন আধুনিক অস্ত্র, আর সাম্রাজ্যবাদী জোটের দেখানো পথ দিয়ে এলো অন্য এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদ।
এই আধিপত্যে কাগজে কলমে রাষ্ট্রের দখল কি মালিকানা হাত বদল হয় না, এক চুলও নড়ে চড়ে না আধুনিক গণতান্ত্রিকতার মুখোশ।
রাতের আঁধারে কিংবা বন্ধ দরজার পেছনের লেনদেনের কারসাজিতে শুধু বিক্রি হয়ে যায় একেকটা দেশ, তাদের মানুষ, মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ।
এমনটা আমরা ঘটতে দেখেছি আফগানিস্তানে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে।
কিন্তু কখনো চরমতম দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি, আমাদের বাংলাদেশেও এমনটি ঘটবে, মুক্তচিন্তার ধ্বজাধারী তথাকথিত সেক্যুলার শক্তিটিই আমাদের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে রাতের অন্ধকারে পেট্রো ডলার আর ক্ষমতার লোভে আমাদেরকে বিক্রি করে দেবে ইসলামের অন্ধকারতম শক্তি ওয়াহাবিদের হাতে।
আমাদের স্বাধীনতার মুক্তচিন্তার চেতনা বিক্রি করে কিনে আনবে মদিনা সনদ বাস্তবায়নের স্বপ্ন।
কবে, কী করে ঘটলো এই পট -পরিবর্তন?
রাতারাতি নিশ্চয়ই ঘটেনি।
মনে আছে, সেই ২০০১ এ যখন বাংলাদেশ ছেড়ে আসি, তখনও বাংলাদেশ আমার কাছে একটা রূপকথার দেশ।
হাজার বছরের ইতিহাস, সাহিত্য সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বহুবর্ণিল ছটায় রঙিন থাকতো সেই রূপকথার প্রতি অধ্যায়।
এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেকোনো সংগঠনে, কাজের জায়গায় সেই ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে অদ্ভুত তৃপ্তি পেতাম।
আর আমার কাছ থেকে আমাদের বারো মাসে তেরো পার্বন আর সেক্যুলার সংস্কৃতির কথা শুনে মুগধ হয়ে যেতেন এখানকার মানুষেরা।
এমনকি সদ্য দেখা টুইন টাওয়ারের ধসে পড়ার সাথে সাথে সমস্ত পৃথিবীতে মুসলমানদেরকে বিচার করবার যেই প্রথাগত ধারণা তৈরি হলো, তখনো বাংলাদেশিদের সেই চোখে দেখার কথা সহসা ভাবতো না কেউ!
কিন্তু তারপর!
হঠাৎ একদিন চোখ মেলে দেখলাম, আমার চেনা পৃথিবীটা কবেই যেন দু’টুকরো হয়ে গেছে। আমি টেরও পাইনি।
চেনা পৃথিবীর বর্ণিল মানুষগুলো উধাও হয়ে গিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে বেঁচে আছে দুই ধরনের মানুষ।
আমরা আর ওরা!
হঠাৎ যেন এই আধুনিক দ্বিজাতি-তত্ত্বের তোড়ে মানুষগুলো হারিয়ে গিয়ে মুখোশের মতো কিছু ধর্মই বেঁচে রইলো। মনুষ্যত্ব বলে আলাদা করে কিছু আর রইলো না।
হয় তুমি আমাদের মতো করে, আমাদের বেঁধে দেয়া পথে অন্ধ হয়ে চলে বিশ্বাসীদের দলে নাম লেখাও, আর নইলে আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাও।
নিজের বিবেকবুদ্ধি চিন্তাশক্তি জীবনধারণ করাটাই যাদের ধর্ম, সেই মানুষগুলো হঠাৎ করে কেমন অপ্রয়োজনীয়ই নয়, রীতিমতো বোঝা হয়ে দাঁড়ালো। হয় ওদেরকে মেরে, ধরে, ছলে-বলে কৌশলে আমাদের পথে নিয়ে এসো, আর নয়তো নিশ্চিহ্ন করে দাও।
সৌদি সাম্রাজ্যের কাঁচা টাকার তোড়ে আর ক্ষমতার লোভে কবেই বিক্রি হয়ে গেলো বাঙালির চেতনা আর মুক্তচিন্তার ধারাবাহিকতা।
খুব খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারবেন, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো পরিকল্পনাহীন, আকস্মিক কিংবা কাকতালীয় পরিবর্তন নয়।
হলোকস্টের সময় নাৎসিরা যেমন অত্যন্ত সুকৌশলে সমাজের মুক্তচিন্তা আর আধুনিকতার ধারাটিকে প্রতিহত করতে নিয়ম করে আক্রমণ চালিয়েছিল ইহুদি সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কৃতি মানুষগুলোর ওপর। যেমন করে তারা তালিকা নির্ধারণ করে একে একে ধ্বংস করেছিল ইউরোপীয় সভ্যতার উৎকৃষ্টতম শিল্পকর্মগুলো, পুড়িয়ে দিয়েছিলো বই, লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি, ঠিক একইভাবে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মাটি থেকে মুক্তচিন্তা এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারাটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার একটা প্রয়াস চলে আসছে গত প্রায় দেড় দশক ধরে।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে ঘটে চলা ভাষাগত, সংস্কৃতিগত এবং রাজনৈতিক শোষণের কথা মনে করলে এখনও আমাদের চেতনার ধ্বজাধারীদের রক্ত গরম হয়ে যায়।
তখন খুব জানতে ইচ্ছে করে, গত দেড় দশক ধরে ঘটে চলা রক্ষণশীল ইসলামী সংস্কৃতি এবং বড়োজোর ভারতীয় হিন্দি সিরিয়ালের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখোমুখি এইসব চেতনার সেনানীরা নীরব কেন?
যদি একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা অপরাধ হয়, তাহলে হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায় পর্যন্ত একের পর এক চিন্তাশীল প্রতিভাবান মানুষের হত্যাকাণ্ডেও আপনাদের এতটুকুও গ্লানিবোধ আসে না কেন?
একের পর এক সাংবাদিক, ব্লগারদের আক্রমণ, হত্যার ঘটনায় কেন এতটুকু অপরাধবোধ আসে না আপনাদের?
কেন প্রতিবাদে উত্তাল হয় না রাজপথ?
সে কি কেবল এই ঘটনাগুলো রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় নিয়েই ঘটে চলেছে বলে?
একের পর এক আমাদের মূলধারার সাংস্কতিক ঐতিহ্যগুলো খুব পরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
অভিজিৎ রায় তাঁর প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, আমাদের শিক্ষা এবং সংস্কৃতি জগতের কেন্দ্রে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যা একসময় ছিল আমাদের কাছে সবচাইতে নিরাপদ তীর্থের মতোন, সেই তীর্থটিও আর আমাদের নেই। বইমেলার সংস্কৃতিগত এবং চরিত্রগত অধঃপতন নিয়ে না হয় আর বিস্তারিত নাই বা বললাম। আমাদের মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক টেক্সটগুলো থেকে সমস্ত বাংলা ক্লাসিক্যাল লেখকদের লেখা কেবলমাত্র তারা অ-মুসলিম, এই কারণে বের করে নেয়া হয়েছে। সমস্ত দেশে স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রতিনিয়তই প্রমাণ করে দিচ্ছে, দেশটা এখন মুসলমানদের দেশ, মানুষের দেশ নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এখন সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ থাকুক না থাকুক, সূর্য অস্ত গেলেই ঘরের মেয়েরা যেন লক্ষী মেয়ের মতো ঘরে ফেরে, নিয়ম করে সে ব্যবস্থা ঠিক নিশ্চিত করা হয়েছে।
দেশের এই ঢালাও ইসলামিকরণের হাত থেকে এমনকি আমার প্রাণপ্রিয় হলিক্রস স্কুলটিও রক্ষা পায়নি। বছর দুয়েক আগে মেয়েদের ওপর ঘটা যৌন সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে তাদের পোষাককে দায়ী করে তৈরি করা একটি প্রশ্নপত্র সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিলো। রক্ষা এটুকুই যে এখনো সেখানে ক্লাসরুমের ভেতরে ইউনিফর্মের ওপর হিজাব পরার অনুমতি দেয়া হয় না সেখানে। সবাইকে ক্লাসরুমের ভেতর একই পোশাকে ঢুকতে হয়। কবে সেই নিয়মটিও অন্তর্হিত হয়ে যায়, কে জানে। মদিনা সনদের দেশে হলিক্রস সিস্টারদের তৈরি স্কুলটিকে এখনো চলতে দেয়া হচ্ছে, এই বেশি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে যদি স্কুলটিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়!
সংখ্যালঘু মানুষ কিংবা আদিবাসীদের কথা তো এখনো শুরুই করিনি, যেকথা বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর ওপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার চলছে, সে অত্যাচার যদি যেকোনো দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর ঘটতো, তাহলে এতোদিনে প্রধানমন্ত্রীর অশ্রুর নদী বয়ে যেত নিশ্চিত। আর কিছু না হোক, নিদেনপক্ষে তিনি জাতিসংঘে একটা বক্তব্য তো নিশ্চয়ই দিয়ে বসতেন। প্রতি জেলায় জেলায় মাদ্রাসার জন্যে পাওয়া কোটি কোটি ডলারের সামনে কোথায় লাগে কয়েকটি অমুসলিমের চোখের জল! ওদেরকে এখনো জিজিয়া দিতে হচ্ছে না, এই বেশি। একটু আধটু বাড়িঘর পোড়ানো, মেয়ে-বউদের ওপর অত্যাচার এসব চলতেই পারে। অমুসলিম নারী তো গণিমতের মাল ছাড়া আর কিছু নয়!
আর সেকি শুধু অমুসলিম নারীরা!
নারীমাত্রেই যেন মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে, সে ব্যবস্থাও শুরু হয়ে গেছে।
নারীর পোশাকে পাপ, লেখাপড়ায় পাপ, সেলফোন ব্যবহারে পাপ (তনু হিজাব পড়তেন, কিন্তু তারপরও যেহেতু তার কাছে একাধিক সিম কার্ড ছিল, অতএব, মেয়েটা নির্ঘাত চরিত্রহীন, ওকে ধর্ষণ করেছে, ভালোই করেছে, ধর্ষকের বিচার হবার প্রশ্নই ওঠে না।) এমনকি পাবলিক বাসে চলাফেরায়ও পাপ. এতদিন মাথায় ঘোমটা/হিজাব না দিলে রাস্তায় গালাগালি করা, কপালে টিপ্ পরলে মুখে থুতু দেয়া, শাড়ি পরলে অশ্লীল মন্তব্য, এসব তো এতোকাল ছিলই, ইদানিং শুনছি ধর্মের রক্ষকরা ছুরি আর ব্লেড নিয়ে বসে বসে বহাল থাকেন সুযোগ পেলেই মেয়েদের কাপড়ের পেছনের অংশটি কেটে নিয়ে তাদেরকে অপদস্থ করবেন বলে, এসব করেও যদি বেহায়া মেয়েমানুষগুলোকে ঘরে বসিয়ে রাখা যায়!
টিভির চ্যানেলে ইসলামী টকশোতে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে চলতে থাকা মাইকের ওয়াজে সুললিত কণ্ঠে বিধর্মীদের গালিগালাজ আর মেয়েদের নিয়ে বলা অশ্লীলতম বর্ণনায় ইসলামের জয়জয়কার। এ জয়যাত্রাকে রুখে, সেই সাধ্য কার!
আপনার ভালো লাগছে না এসব, অন্যায় মনে হচ্ছে? প্রতিবাদ করবেন? সে আশায় গুড়ে বালি।
সরকার কিংবা তার বিশেষ ভালোবাসার মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কিছু বলেছেন কি লিখেছেন?
ব্যস! আপনার অস্তিত্বই মিটিয়ে দেয়া হবে মাটিতে।
সেদিন একজন বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিলো, তিনি মনে করিয়ে দিলেন, এমনকি বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বৈরাচারী সরকারগুলোর শাসনামলেও এমনভাবে কথায় কথায় বিরোধী মতবাদের মানুষদের খুন কিংবা নিখোঁজ হয়ে যেতে হয়নি।
এর সাথে বোধহয় একমাত্র ল্যাটিন আমেরিকার সামরিক জান্তাদের অন্ধকার যুগেরই তুলনা করা চলে।
আহা ! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকারের ক্ষমতায় থাকা নিয়ে প্রশ্ন। তারজন্যে একটুআধটু গুম, খুন কিংবা আরো ছোটখাট অন্যায় মেনে নেয়াই যেতে পারে, কি বলেন!
লক্ষ্য তো একটাই। দেশটাকে মদিনা সনদের দেশে পরিণত করতে হবে। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে একটা সামান্য প্রশ্ন ছিল আমার, যতদূর জানি, ইসলাম নারীর নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দেয় না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আজ বাদে কাল যখন আপনার তৈরি করা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন কাঁধে চেপে বসে, শুধুমাত্র নারী হয়ে জন্মাবার অপরাধে আপনার মনুষত্ব, আপনার নেতৃত্বকে অস্বীকার করবে, আপনাকেও ঠেলে পাঠিয়ে দেবে অন্দরমহলের অন্ধকার কোণে, তখন আপনি কী করবেন একবার ভেবে রেখেছেন তো?
এখনো সময় আছে, একবার ভেবে দেখুন। আপনার পরলোকগত পিতার আত্মা হয়তো খানিকটা হলেও শান্তি পাবে।