নারীর স্বাধীন রূপ বা বেশ্যা রূপ

লুৎফর রহমান শিশির:

রাস্তার ধারে একটি মেয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকা এতদঞ্চলে এখনও চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ব্যাপার। লোকে ধরেই নেবে, মেয়েটি বেশ্যা। খদ্দের ধরতে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন তার দিকে আড়চোখে তাকাবে। তার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে। আবার মনে মনে ঘৃণাও করবে সবাই। নারী এখানে থাকতে পারে কারও মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা বা হয়তো প্রেমিকা রূপে। আর এগুলোর কোনোটা না হলে বেশ্যা রূপে। একা, স্বাধীন মেয়ের রূপমাত্রই যেন বেশ্যারূপ।

নারীকে যেন কোনো না কোনো পুরুষের সাথে গাঁটছড়া হয়ে থাকতেই হবে। নারী একা চলতে ফিরতে পারে। ভালোভাবেই পারে। বাঘ-ভালুক-শেয়াল-কুকুর তাকে বিরক্ত করে না। পুরুষই তাকে বিরক্ত করে। কোনমতেই একজন নারীকে একা চলতে ফিরতে দেওয়া যায় না। তাকে একা একা থাকতেও দেওয়া যায় না। তাকে কারও না কারও সাথে থাকতে হবে। এবং সমাজ নির্ধারিত কোনো না কোনো রোল প্লে করতে হবে।

কোনো মেয়ে শহরের কোনও ফ্ল্যাটে বা গ্রামের কোনো ঘরে একা থাকছে কিনা সেই খোঁজখবর রাখা পুরুষদের একটি মহান দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাদের আরও দায়িত্ব হলো সেই নারীর একাকিত্ব দ্রুত ঘুচানোর ব্যবস্থা করা। যদি ব্যবস্থা না করা যায়, তবে সেই মেয়েকে বলা হয় নষ্ট মেয়ে, বেশ্যা।

একটি মেয়ের একা থাকা-চলাটা এখানে বিশ্রীভাবে অস্বাভাবিক দেখায় সমাজের চোখে। যেন মেয়েটি মালিকানাহীন হয়ে পড়েছে। কোনো মেয়ের মুখ দেখা গেলেই পুরুষের প্রথম প্রশ্ন, মেয়েটা কার মেয়ে বা কার স্ত্রী। মেয়েটি একা কেন? এর মালিক কোথায়? দ্রুত একে বন্দী করো। এর বিহিত করো, বিচার করো।

রাত বারোটায় একটি ছেলে রাস্তায় বেরুতেই পারে। তার হয়তো মনটা উদাস হয়েছে। মাথায় চাঁদটাকে রেখে সে হয়তো একটু মেইন রোড ধরে হাঁটতে চায়। সে হয়তো একটু বিড়ি ফুঁকবে। কিন্তু একটা মেয়ের এসব করা এখানে অধরা স্বপ্ন বৈ কিছু নয়। কেননা রাতে বেশ্যারাই কেবল বেরুতে পারে। এছাড়া আছে ধর্ষিত হওয়ার আশংকা। পুরুষ তাকে ধর্ষণ করতে পারে। আবার পুরুষই তাকে পরামর্শ দেয় অথবা বাধ্য করে বাইরে না বেরুনোর।

পুরুষ এমন একটা ভান ধরে যেন তাকে নারীর নিরাপত্তা, দেখভালের সুমহান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একটা সমাজে পুরুষ নারীকে নিরাপত্তা দেয় – এতে যেন সেই সমাজ, সমাজের পুরুষগুলো মহৎ হয়ে পড়ে। নারীকে তথাকথিত নিরাপত্তা দেওয়ার অজুহাতে তার উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখে, তাকে দুর্বল, নির্ভরশীল করে রাখে পুরুষ। অথচ নারীরা নির্বিঘ্নে চলতে পারে, যদি শুধুমাত্র তাদেরকে বিরক্ত না করে পুরুষের দল।

বলছি না যে মেয়েকে একা থাকতেই হবে। বলছি যে একটি মেয়ে একা থাকবে কী দোকা থাকবে বা কীভাবে থাকবে, সেটা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। সমাজ বা কেউ তাতে নাক গলাবার কোন অধিকারই রাখে না। বলছি যে নারী-পুরুষ প্রতিযোগী নয়, কেউ কারও অভিভাবক-মালিক হিসেবে নয়, সহযোগী হিসেবে চলতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতাটা আবশ্যক।

‘নারীর মর্যাদা’ বলে কিছু থাকার কথা নয়, থাকা উচিতও নয়। মানব-মর্যাদার ধারণাই যথেষ্ট। নারীর মর্যাদা আবার কী? নারীর অতিরিক্ত মর্যাদা সবসময়ই সন্দেহজনক। পুরুষশাসিত সমাজের নির্ধারণ করা পদ্ধতির আওতায় নারী যতোক্ষণ থাকবে, নারী ততোক্ষণ মর্যাদাবান, আর তা না থাকতে চাইলেই খারাপ, বেশ্যা। মর্যাদার নামে, দেখভাল করার দায়িত্বের নামে নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, কুক্ষিগত করে রাখার কাজটি বহুকাল ধরে করে আসছে পুরুষ। পুরুষ এবারে তার সুমহান দায়িত্বগুলো থেকে অবসর নিক।

[email protected]

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.