হাবিবা রিমা:
আজকাল খুব সহজে আমি সব ভুলে যাই। স্মৃতিশক্তি দুর্বল হচ্ছে কিনা জানি না, তবে ডায়েরির পাতা না উল্টালে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই মনে থাকে না। প্রায় সবকিছুই ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতে হয়। এরকম করতে করতে আমার ডায়েরির পাতাও প্রায় শেষ। এখন নতুন একটা ডায়েরি কেনার কথা ভাবছি।
আমি এখন পুরোপুরি ডায়েরি নির্ভর একজন মানুষ। ব্যাপারটা অনেকদিন ধরে চলছে দেখে আজ কারণটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করছি।
ছোটবেলায় আমি খুব ভালো একজন পর্যবেক্ষক ছিলাম। জীবনের যতোটা সময় ভালো পর্যবেক্ষক হয়ে কাটিয়েছি সে সময়ের প্রায় সবকিছুই আমার মনে আছে, মনে থাকেও। বিশেষ করে ভালো এবং ইতিবাচক সবকিছু। কোনো এক অজানা আর রহস্যময় কারণে নেতিবাচক কিছুই আমার স্মৃতিতে থাকে না।
নিজেকে খুব সাহসী মনে করলেও ভিতরে ভিতরে আমি হয়তো প্রচণ্ড ভীরু একজন মানুষ। প্রকৃতি সাহসী মানুষদের ভালো-মন্দ দুটোই বহন করার এবং স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা দেন। যেমন আমার আব্বু, মা আর মেজ বোন। তারা তিনজনই আমার দেখা অত্যন্ত সাহসী মানুষ। এজন্যই তারা ভালো-খারাপ সবকিছুই মনে রাখতে পারেন।
যাই হোক, বেশ কিছুদিন যাবত আমি বুঝছি যে, আমি আমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা হারিয়েছি। অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভাবেই। সমস্যা, ঝুট-ঝামেলা, অন্যায় থেকে চোখ এড়িয়ে, পাশ কাটিয়ে পালিয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেছি। এসব করতে করতে আমি দেখার ক্ষমতা হারানোর পাশাপাশি মনে রাখার ক্ষমতাও হারিয়েছি।
আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও মনে না থাকার পিছনে এটা একটা কারণ হতে পারে বলে ভাবছি।
আমি টিভি দেখি না, খবর পড়ি না। দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ধর্ষণ, হত্যা সব কিছুর ভয়ে আমি সবকিছু থেকে পাশ কাটিয়ে চলি। হাঁটছি, চলছি নিজের মতো করে, কোনকিছু খেয়াল না করেই। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো চলছি। আমি অজান্তেই আমার চারপাশে দেয়াল তৈরি করে নিজের জন্য একটা নির্ভেজাল দুনিয়া বানিয়েছি।
আমি আমার কল্পনার জগতে শুভ্র নামে একটা কাল্পনিক চরিত্র বানিয়েছি। শুভ্রকে আমি ওর নামের মতোই সাদা, পবিত্র মানুষের রূপ দিয়েছি। আমার এই শুভ্র একজন অসাম্প্রদায়িক, প্রেমিক মানুষ। প্রতিদিন আমার একান্ত কয়েক ঘন্টা এই সত্যিকারের নির্ভেজাল মানুষটির সাথে কাটে।
আমি এখন প্রায়শই ঠাকুরমার ঝুলি দেখি, গোপালভাঁড় দেখি। এসব করতে করতে কখন যেন খারাপ কিছু থেকে পালাতে পালাতে আমি জীবনের সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। দেখার ক্ষমতা হারিয়েছি, পাশাপাশি মনে রাখারও।
এতোক্ষণ যা বললাম তার মধ্যে কোন মশলা যোগ করিনি আমি। এসব আমার জীবনের, একজন নারীর জীবনের এক চরম সত্য অংশ। এই সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে কখনো কখনো মনে হয় আমি আমার কাজ, চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখতে পারবো তো বেশিদিন? কেননা আমার সত্যি সত্যি আজকাল সবকিছু লিখে লিখে মনে রাখতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে স্বাভাবিকতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব হবে বলে তো মনে হয় না।
এতোক্ষণ অনেক বকবক করলাম। কিছুটা হালকা হলাম কিনা জানি না। তবে যা বললাম সেটার জন্য কোনো সান্ত্বনা চাই না আমার। আমি শুধু চাই বসবাসযোগ্য পরিবেশ, বাসযোগ্য একটা সুন্দর পৃথিবী। যে পৃথিবীকে আমি নির্ভয়ে দুচোখ ভরে দেখবো, আমার চোখ সে সুন্দরের সংকেত পাঠাবে আমার মস্তিষ্কে। আমি অাগের মতো ভালো পর্যবেক্ষকের জীবন কাটাবো। যেখানে আমার সব ভুলে যাওয়ার দুঃখ থাকবে না।