সাবরিনা করিম মুর্শেদ: তেঁতুল তত্ত্বের প্রবক্তা আল্লামা শফীর বক্তব্যের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে আমার বন্ধুরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ভেসে যাচ্ছে প্রতিবাদে। তার বক্তৃতার ভিডিও ক্লিপিং দেখে আমি বাকরুদ্ধ। কেবলি মনে হচ্ছে পরিযায়ী জীবনে যেখানে দেশের সামান্যতম দুঃসংবাদ আমাদের আলোড়িত করে, সেখানে এই বিভীষিকাময় কথাগুলো শোনার পর আমার অনুভুতি কেমন হওয়া উচিত? ক্ষোভে ফেটে পড়া? ক্রোধান্বিত হয়ে তার কথার সমুচিত জবাব দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া? আমি অবাক হয়ে দেখি, এর কোনটিতেই আমার মন সায় দেয় না। বোধ করি সুক্ষ্ম বা স্থূল, সকল অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেছে। সব কিছুই তাই অসাড় মনে হয়। কিন্তু কে তেঁতুল, কে তেঁতুলপ্রেমী বা তেঁতুলসেবী, এ বিষয়ে ইচ্ছাকৃত মৌনতা অবলম্বন করলেও পরবর্তী অংশে যখন সাধারণ পোশাক শ্রমিকদের প্রতি জনাব শফী মূল্যবান মন্তব্য করলেন, তখন মনে হল দুটি কথা বলি। বিজ্ঞ শফী সাহেবের মতে গার্মেন্টসের মেয়েরা ” জেনা করে টাকা উপার্জন করে”। আমার ধারণা, ‘ জেনা’ শব্দটি তার এবং তার সমগোত্রীয়দের খুব প্রিয়। কি করলে জেনা হয় বা হয় না, এ ব্যাপারে তাদের চাইতে আমি ভালো জানি, একথা বলার মত ধৃষ্টতা আমার নেই। শুধু বলতে পারি, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর ছোট ভাই কিছুকাল শিবির কর্মীদের পাল্লায় পড়েছিলো। তাদের কাছে নসিহত পাবার পরে আমাদের এসে বলত, “আপুনি, টিভি দেখিস না, তোদের চোখের জেনা হবে”। কিন্তু জনাব শফী, গার্মেন্টসের ওই শুকনা তেঁতুলগুলোর তো চোখের জেনা করারও সময় নেই। উদয়াস্ত খেটে যাওয়া ওই তেঁতুলগুলো সর্বনিম্ন মজুরী আদায় করতে পার করে দেয় একেকটি দিন। আসন্ন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেই সেলাই মেশিন চালিয়ে যায়, যাতে পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে না পড়ে। বাড়ীতে বৃদ্ধ পিতার ওষুধ, সোমত্ত বোনের পরিধেয় অথবা পঙ্গু স্বামীর খাবারের যোগান দিতে দিতে কখন যে তারা বর্তমান থেকে অতীত হয়ে যায়, নিজেরাই জানেনা। কাকভোরে যখন আমার মত মধ্যবিত্তের সন্তান স্কুলে যায় তখন কন্ঠার হাড় বের করা এই তেঁতুলগুলোর মিছিল দেখে কার মুখে লালা পড়ে আমি জানিনা, তবে কারো কারো চোখে যে জল পড়ে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। যখন সাংবাদিকতায় ছিলাম সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে এই মেয়েগুলোর সাথে কিছু কাজ আমি করেছি। উন্নয়ন কর্মী হিসেবেও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। একটা সামান্য ঘটনা বলি। কাঁচাবাজারে সালেহা নামের একজন গারমেন্টস কর্মীকে খুশী খুশী মুখে দেখে প্রশ্ন করলাম কি ব্যাপার। জানলাম মুরগীর পা কিনতে পেরেছে আজকে, তাই এত খুশী। শুধু মরিচপোড়া বা আলু ভর্তা দিয়ে দিনের পর দিন ভাত খাওয়া সালেহারা আপনার-আমার মত মানুষদের ফেলে দেওয়া জিনিস কিনতে পেরেই নিজ ভাগ্যকে সাধুবাদ জানায়। আপনার কথা মত জেনা করে রোজগার করা টাকাগুলো এরা কি করে কে জানে! আসলে আপনি একা নন, অনেকেরই এই মানুষগুলোর খেটে খাওয়ার ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ না। এই আমাদের মত ছাপোষা গৃহিণী অথবা কর্মজীবী নারীদের কথাই ধরুন। গার্মেন্টস আমাদের দুচোখের বিষ কারণ, এই গার্মেন্টসের কল্যাণে গৃহপরিচারিকা বা মোদ্দা কথায় কাজের লোকের অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে। যেখানে মাথার উপর ছাদ পাচ্ছে, দুবেলা খেতে পাচ্ছে টেলিভিশন দেখতে পাচ্ছে, এত আরাম-আয়েশ ফেলে রেখে কেন তারা পোশাক শিল্পে নিয়োজিত হয়? জেনাকারীর খপ্পরে পড়তে, নাকি একদিন দেয়ালচাপা পড়ে বা আগুনে পুড়ে নিজেকে বিলীন করতে? পাশের বাড়ীর ভাবিরা যখন কটাক্ষ করে বলে যে আমাদের মত উন্নয়ন কর্মীদের জন্য নাকি গৃহকাজে নিপুণা পরিচারিকার অভাব ঘটেছে, আমি বা আমার মত অনেকেই যথার্থ উত্তর দিতে অপারগ হই। কখনও বলে উঠতে পারিনা যে তাদের একাংশের গাড়ী, বাড়ী বা বিদেশ ভ্রমণের খরচ কিন্তু আসে এই মেয়েগুলোর চুইয়ে পড়া স্বেদবিন্দু থেকেই। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূলেই এই বাসাবাড়ীর কাজ ছেড়ে দেওয়া পাজি মেয়েগুলো। আবার মালিকপক্ষের কাছে শুনি তাদের নাকি লাভই হয়না, তাই তারা বর্ধিত বেতন দিতে অপারগ। বেশ মজার ব্যাপার। প্রদীপের নিচটাই অন্ধকার। এত কষ্টের মাঝেও কিন্তু তারা কাজ করে যায়। হয়তো তার পেছনের কথা অনেক লম্বা। তবে পরের বাড়ীর কাজের মানুষ না হয়ে সসম্মানে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা যে সবচেয়ে বড় উদ্দীপক, তা নিশ্চিত। আর ওই তেঁতুলগুলোর সসম্মানে বেঁচে থাকা যে আপনার ও আপনার অনুসারীদের হুল বিদ্ধ করে এর কারণ আর কিছুই না; নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি আপনাদের আতঙ্কিত করে। আপানারা কখনও আল্লামা, কখনও স্বামী, শ্বশুরকূল, কখনও সহোদর বা সহকর্মী; নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হলে তাকে পদতলে পিষ্ট করার সুযোগ সীমিত বলে অনুভব করেন। তাই সামান্য পোশাক শ্রমিক মেয়েগুলোর শ্রমকে জেনার নাম দিতে আপনাদের কখনই দ্বিধান্বিত হতে হয় না।