কথা শুনুন বোঝার জন্য, শুধু পাল্টা জবাবের জন্য নয়

হে‌লেনা অাফ‌রোজ:

উইমেন চ্যাপ্টারে অ্যাঞ্জেল সা‌ঁকো’র একটি লেখা “অা‌মি ডি‌র্ভো‌সি, অা‌মি কি সমা‌জে অচ্ছুৎ” পড়লাম। লেখাটির নিচে অনেক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখেছি পাঠকদের। তারই পাঠ প্রতিক্রিয়া হিসাবে অামা‌দের কিছু মন্তব্য।

কী অাজব অামরা, এখা‌নে কথা হ‌চ্ছিল একটা সমস্যা নি‌য়ে, কিন্তু অামরা সেটার কোনো সমাধা‌নে না গি‌য়ে উ‌ল্টো লে‌খিকা হাউজ ওয়াইফদেরকে কী না‌মে ডাক‌লেন, সেটা নি‌য়ে পড়লাম! প্রথমত ডি‌ভোর্স একটা সমাধান, অাপ‌নি ধ‌র্মীয় বা সুস্থ-স্বাভা‌বিক ‌যে কোনো লেন্স দি‌য়েই য‌দি দে‌খেন সবখা‌নেই এটা‌কে একটা সমাধানই বলা হ‌য়ে‌ছে। যখন দুইজন মানু‌ষের ম‌ধ্যে সমস্যাটা চূড়ান্ত পর্যা‌য়ে চ‌লে যায়, তখন তা‌দের নি‌জে‌দের স্বার্থেই উ‌চিত সমাধানটাকে বে‌ছে নেয়া।

কিন্তুু এটা একান্তই অামা‌দের সমাজ বা অামা‌দের ভুল দৃ‌ষ্টিভ‌ঙ্গি যেখান থে‌কে অামরা ভাব‌তে শি‌খে‌ছি যে, এটা একটা নে‌গে‌টিভ বিষয়, এটা নি‌য়ে ভাবলেই অাপনা‌কে অার ভালো না‌মে ডাকা য‌াবে না, অাপ‌নি হ‌য়ে যা‌বেন খারাপ।
অার শুধু বিষয়টা‌কে নে‌গে‌টিভ ভে‌বেই অামরা শা‌ন্তি‌তে থাক‌তে পার‌ছি না, যে বা যারা খুব সাহস ক‌রে বাধ্য হ‌চ্ছে এই সমাধানটা‌কেকে‌ বেছে নি‌তে, তা‌দের দি‌কেই অাঙ্গুল তুল‌ছি বারবার, কী কর‌ছে, কোথায় যা‌চ্ছে, কার সা‌থে মিশ‌ছে, সমা‌লোচনার অার শেষ নেই। সবার অা‌গে নি‌জের সমা‌লোচনা কর‌তে শিখুন, অার য‌দি নিতান্তই কা‌রো সমা‌লোচনা কর‌তে চান, তাহ‌লে দয়া ক‌রে সাহস ক‌রে এক‌দিন তার জু‌তোটা পা‌য়ে দি‌য়ে হাঁটুন, তারপর তাকে নি‌য়ে মন্তব্য করুন।

এবার অা‌সি হাউজ ওয়াইফ নামধা‌রি এ‌কেকজন ‘শি‌ক্ষিত বুয়া’ প্রস‌ঙ্গে। অামাদের বা‌ড়ি‌তে সবসময় রান্না ক‌র‌তে হয় অামার মাকে, কারণ বুয়ার হা‌তের রান্না কেউ পছন্দ ক‌র‌বে না, অাবার অামার খালা বা‌ড়ি প‌রিষ্কার করা, ধোয়া-মোছা সব নি‌জেই ক‌রেন, এজন্য না যে তার বেতন দি‌য়ে বুয়া রাখার সামর্থ্য নেই, কিন্তু অন্য কা‌রেও কাজ তার পছন্দ না সেজন্য। অার এই সেইম কাজগুলোই বে‌শিরভাগ বা‌ড়ি‌তে গৃহকর্মিরা ক‌রে।
অার এখন য‌দি অা‌মি ব‌লি অামার মা এবং খালা এরা দুইজনই দুই বাসার ‘বুয়া’, তো সমস্যাটা কোথায়? অা‌মি নি‌শ্চিত এই কাজগু‌লো বা‌ড়ি‌তে অামরা সবাই কম‌বে‌শি ক‌রি বা কর‌তে হয়, অামা‌দের মা-খালাদেরকে য‌দি বুয়া বলা যায়, সেখা‌নে অামরা তো শি‌ক্ষিত বুয়াই হলাম। ‌যে‌হেতু মা খালা‌দের চাই‌তে অামরা একটু বে‌শি শিক্ষিত। অামা‌দের তো এখা‌নে খু‌শি হবার কথা যে, অামরা শুধু না‌মেই হাউজ ওয়াইফ না, অামরা জা‌নি কীভা‌বে একটা বাসা সামলা‌তে হয়, বা মা‌ঝে মা‌ঝে বাসার কা‌জের বুয়া‌কে ছু‌টি দি‌য়ে রান্না করা, ঘর-প‌রিষ্কার করার ম‌ধ্যে যে অানন্দ অা‌ছে, সেটাও অামরা নি‌তে জা‌নি!

অার বুয়া পদ‌বিটা নি‌য়ে যা‌দের উঁচু নাকটা নিচু হ‌য়ে যা‌চ্ছে, তা‌দেরকে বলছি, অাপনার অামার যেমন একটা সুন্দর সংসার অা‌ছে, বুয়ারও অা‌ছে তেমনই একটা সংসার, অাপনার প‌রিবা‌রের সদস্যরা অাপনা‌কে ঠিক যতোখা‌নি ভালবা‌সে, বুয়া‌কেও ঠিক ততোটা ভালবা‌সে তার প‌রিবা‌রের লো‌কেরা, অাপ‌নি অাপনার সন্তা‌নের জন্য যতোটা ভালবাসা বু‌কে নি‌য়ে থা‌কেন, অা‌মি নি‌শ্চিত বুয়াও তার সন্তান‌কে ততোটাই ভালবা‌সে। এবার অাপ‌নিই বলুন, বুয়া’র সা‌থে অাপনার পার্থক্যটা কি খুব বে‌শি? শুধুমাত্র টাকার অংকটা ছাড়া? বুয়ার টাকাটাই শুধু অাপনার চাই‌তে কম, তাছাড়া বুয়াও অাপনার অার অামার মতোই একজন।

অাবার কা‌রও কা‌রও ম‌নে হ‌চ্ছে লে‌খিকা ভীষণ হিংসাবোধ থে‌কে এসব কথা বল‌ছেন। কিন্তু অামার তো ম‌নে হ‌চ্ছে, এসব কথা য‌দি সত্যিই হিংসাত্মক মনোভা‌বের ব‌হিঃপ্রকাশ হয়, সেটাও কি একটু স্বাভা‌বিক না? অাপ‌নি যখন বার বার অাপনার সু‌খের খাতাটা সবার সাম‌নে খু‌লে খু‌লে দেখা‌চ্ছেন, অার সেটা দে‌খে যে কোনো সাধারণ মানু‌ষের তো একটু হিংসাবোধ জাগ‌তেই পা‌রে, যে‌হেতু হিংসা মানু‌ষের একটা স্বভাব। অার অাপ‌নি য‌দি অসাধারণ শ্রেণীর কেউ হোন, সেটা অন্য ব্যাপার।

‌যেমন অাপ‌নি বল‌ছেন, অাপনার স্বা‌মী তার সব টাকা অাপনার না‌মে ব্যাং‌কে রে‌খে দি‌য়ে‌ছে, অাবার বল‌ছেন যে অাপ‌নি না‌কি বার বার নি‌ষেধও ক‌রে‌ছি‌লেন, সুতরাং সবাই বুঝ‌তে পার‌ছে যে অাপ‌নি অাসলে কতখা‌নি ভালবাসার ম‌ধ্যে অা‌ছেন। এখা‌নে দু‌টো ব্যাপার অা‌ছে, প্রথমত এখা‌নে ট‌পিকটা স্বা‌মীরা তা‌দের বউদের কতটা ভালবা‌সে অার সেটা কী কী ভা‌বে প্রমাণ দেয়, সেটা নি‌য়ে ছিল না, অার দ্বিতীয়ত সব স্বামীদেরকে শুধু বউ নি‌য়ে চিন্তা কর‌লেই চ‌লে না, তাদের ‌নি‌জে‌দেরও একটা দু‌নিয়া থা‌কে যেখা‌নে বাবা-মাসহ প‌রিব‌া‌রের অা‌রও সদস্যরা অা‌ছে, সুতরাং যে স্বামীকে সব টাকা ব্যাং‌কে অাপনার না‌মে রে‌খে দেয়ার জন্য অাপ‌নি খু‌শি‌তে গদগদ হ‌য়ে ভালো স্বামীর খেতাবটা দি‌চ্ছেন, সেটা কি অাস‌লে ঠিক হ‌চ্ছে?
অার এখন তো অামার অাপনা‌কে একটু হিংসাও কর‌তে ইচ্ছা কর‌ছে, যে‌হেতু অাপ‌নি এতো সুন্দর ক‌রে বল‌লেন যে, অাপনার বার বার নি‌ষেধ সত্ত্বেও অাপনার স্বামী তার সব টাকা অাপনার না‌মে জমা রে‌খে‌ছে, এটা তো একটু হিংসা করার ম‌তোই।

য‌দিও এখা‌নে স্বামীর ভালবাসা নি‌য়ে কথা বলাটা পুরাই অফট‌পিক, কিন্তু তারপরও বল‌ছি, কে কার না‌মে ব্যাং‌কে কত টাকা জমা রাখ‌লো বা কা‌কে ন‌মি‌নি বানা‌লো, এটা তো ভালবাসার উদাহরণ না, বরং চিন্তা করুন অাপনার সঙ্গী অাপনা‌কে
কতখা‌নি বুঝ‌তে পা‌রে, অাপনা‌কে কতোটা সম্মান ক‌রে, অাপনা‌কে কতোটা বিশ্বাস ক‌রে, অাপনা‌কে কতোটা ভরসা ক‌রে, তখন বুঝ‌তে পার‌বেন ভালবাসা কতখা‌নি।

‌লে‌খককে বল‌ছি, অাপ‌নি ব‌লে‌ছেন ‌যে অামরা ক‌বে সমা‌জের এই বিকৃত রু‌চির মানুষগু‌লো থে‌কে রেহাই পা‌বো, অামার ম‌নে হয় এর সবটাই অাপনার হা‌তে, অাপ‌নি য‌বে থে‌কে এই মানুষগু‌লো‌কে অার পাওা দি‌বেন না, এরা নি‌জেরাই চুপ হ‌য়ে। অার যারা কোনভা‌বেই চুপ হ‌ব্নো তা‌দেরকে বল‌তে দিন তা‌দের মতো।

অাপ‌নি নি‌জে‌কে নি‌য়ে সুন্দর ক‌রে ভাবুন, অ‌নেক অসুন্দ‌রের মা‌ঝেও যে কিছু অসম্ভব সুন্দর মুহুর্তগু‌লো থা‌কে, সেগু‌লো নি‌য়ে বে‌ঁচে থাকুন।

অার দিন শে‌ষে দেখ‌বেন কে, কী বল‌লো বা ভাবলো সেটা অাস‌লে কোনো কা‌জেই অাস‌ছে না, অাপ‌নি জানেন অাপ‌নি ‌ঠিক কী পর‌স্থি‌তির মোকা‌বেলা ক‌রে এ‌সে‌ছেন, অাপ‌নিই ভা‌লো জা‌নেন অাপনার জীব‌নের সা‌থে কী কর‌লে ভা‌লো হ‌বে, অার এটাই সব‌চে‌য়ে বড়, লো‌কে কী বল‌লো সেটা নি‌য়ে ভাবার সময় কই অাপনার!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.