বিপ্লবে নারী নেতৃত্বের স্বীকৃতি নেই কেন?

তাসলিমা আখতার:

অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষে আমার চোখ খুঁজছিলো আলেক্সান্দ্রা কোলনতাইকে, ইয়েলেনা দিমিত্রিয়েভনা স্তাসোভা, নাজেশদা ক্রুপস্কায়া, ক্লাউদিয়া নিকোলায়েভাসহ রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবে ভূমিকা রাখা অনেক লড়াকু বীর নারীদের ছবি। একইসাথে চোখ খুঁজেছিলো রোজা লুক্সেমবার্গ, ক্লারা জেটকিন, বেগম রোকেয়া, ইলা মিত্র, সিমন দ্যা বোভোয়াসহ আরো অনেক অনেক নারীর ছবি, যারা নিজ দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাজের মধ্যে এবং মানুষের চিন্তার জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে নেতৃত্বদানকারী হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমি এঁদের সবার ছবি খুঁজছিলাম মাসব্যাপী অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদযাপন এর শেষ কর্মসূচিতে। শহীদ মিনারের লাল পতাকা সমাবেশ ও মিছিলে। কিন্তু ঐ নারীরা ছিলেন না সমাবেশের ছবিগুলোর মাঝে।

যুগ্ম আহবায়ক অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ভাষা সংগ্রামী আহমেদ রফিক, সমন্বয়ক হায়দার আকবার খান রনোর আহবানে বেশকিছু প্রগতিশীল বামপন্থী সংগঠনের সমন্বয়ে মিছিল সমাবেশ আর লাল পতাকায় ভরে গিয়েছিলো শহীদ মিনার। লাল পতাকা মিছিলে হাজারে হাজারে মানুষের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়েছে শহীদ মিনার, ঢাকা শহর। ভীষণ উদ্দীপনা আর সাহস জোগানো কর্মসূচি। লক্ষ কোটি মানুষের এই মেগা সিটিতে থেকেও প্রায়ই আমরা ভীষণ একাকিত্বে ভূগি। কিন্তু হাজারে হাজারে মানুষের এই সমাবেশকে অনেক বিশাল মনে হচ্ছিলো। এ সমাবেশ-মিছিলে নিজেকে একেবারও একা আর দুর্বল মনে হয়নি। উল্টো নিজের আর সবার ভেতর সাহস-শক্তি যেন বাড়িয়ে দিয়েছিলো ঐ সমাবেশ। আরো বেশি বেশি সাহসী হয়ে উঠতে মন চাইছিলো। সাহস করে, ঝুঁকি নিয়ে, পাছে লোকে কিছু বলের পরোয়া না করে, জীবন দিয়ে হলেও — জীবন ও সমাজকে বদলে দেবার জন্য প্রস্তুত হতে আরো বেশি মরীয়া হবারও সাধ হচ্ছিলো।

সমাবেশ ৩টা সাড়ে ৩ টা নাগাদ শুরু হয়। আর সবার মাঝে আমরাও গণসংহতি আন্দোলনের মিছিল পতাকা প্ল্যাকার্ডসহ জমায়েত নিয়ে উপস্থিত হই সমাবেশে।

একনজরে শহীদ মিনারের হাজার হাজারে নারী-মানুষ, মঞ্চ আর সাজসজ্জা এর দিকে তাকাই। মধ্যবিত্তের তুলনায় শ্রমজীবী মেহনতি রাই জমোয়েতের বড় অংশ। চোখ কাড়ে অক্টোবর বিপ্লবের বিরাট মঞ্চ। দুই পাশে অক্টোবর বিপ্লবের নেতা লেনিনের বিরাট ছবি। আরেকপাশে মাও, স্তালিন, লেনিন, এঙ্গেলস ও মার্কসের ছবি। শহীদ মিনারের দূরে কোনায় কোনায় কোনায়ও লেনিনের ছবি।

মঞ্চে বসে আছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমেদ রফিকসহ অন্যান্য বাম প্রগতিগতিশীল গণতান্ত্রিক দল সমূহের নেতারা। আছেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিন, খালেকুজ্জামান ভু্ইয়া, মবিনুল হায়দার, সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকি, টিপু বিশ্বাস, হামিদুল হক, শামসুজ্জামান মিলন, শওকত হোসেন এবং তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরও কয়েকজন। সৌভাগ্য সেখানে অন্তত একজন নারী স্থান করে নিতে পেরেছেন। তিনি মোশরেফা মিশু।

পুরো সমাবেশে জুড়ে লাল পতাকা, প্লাকার্ড নানা সাজসজ্জায় যেন একটা উৎসাহ উদ্দীপনার জমায়েত হয়েছে। জমায়েত হয়েছে হাজারে হাজারে নারী-পুরুষের জনস্রোতে। যে জমায়েতের মধ্যে নারীর উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। কেউ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতীক নিয়ে হাজির, কেউ বা হাজির দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে। এছাড়া পুরো সমাবেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনগণের হাতে নানা দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, আর দুনিয়া জুড়ে পরিচিত বিপ্লবী নেতৃত্বের ছবি। কেউ এনেছেন মার্কসের ছবি, কেউ এঙ্গলসের, লেনিনের ছবি তো বটেই, আছে স্তালিনের ছবি, আছে মাও এরও ছবি। কিন্তু কোনো নারীর ছবি নেই যারা সোভিয়েত বিপ্লবেই শুধু নয়, সারা দুনিয়ার বিপ্লবী পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
যখন মিছিল শ্লোগানে শহীদ মিনার থেকে পল্টন পার হচ্ছিলো খেয়াল করলাম বিভিন্ন প্রগতিশীল বামপন্থী দল শতবর্ষ স্মরণে তোড়ন তৈরি করেছে কার্যালয়ের সামনে। দেখি সেখানেও একই অবস্থা সেখানেও লেনিনসহ আর সব পুরুষ নেতৃত্বের-ই ছবি।

অদ্ভুত লাগতে থাকলো ব্যাপারটা। নানা প্রশ্ন জাগলো। বিপ্লবে অথরিটি কে, কীসের মাপকাঠি দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনের অথরিটি হিসাবে নেতৃত্ব পরিচিত হয়? কোনটা কাজ আর কোনটা কাজ না? কোন কাজ করলে নেতৃত্বের আসনে আসীন হওয়া যায়? কতোটা তাত্ত্বিক আর কতোটা সভা সমাবেশ সংগঠিত করতে পারলে পরে ‘নেতৃত্ব’ হওয়া যায়? অক্টোবর বিপ্লবই কেবল নয়, সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী লড়াইয়ে সারা দুনিয়ার কোনায় কোনায় নারী নেতৃত্ব, সংগঠক, তাত্ত্বিকদের অবস্থানকে কি আমরা এখনও স্বীকৃতি দিতে শিখিনি? এটা কি কেবল শেখার ব্যাপার, নাকি আমাদের ব্যর্থতাও?

বুর্জোয়া দলগুলোর কথা বাদ দেই। বিশেষভাবে আমাদের দেশে প্রগতিশীল বামপন্থী আন্দোলনে নারীর অবস্থা দেখলে বোধ করি এ বিষয়ে প্রশ্নগুলোর কিছু উত্তর মিলবে। আমাদের দেশে এখনো বাম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রধান নেতৃত্বের জায়গায় নারীর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অনুপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। এছাড়া সাংগঠনিক এবং তাত্ত্বিক কাজে নারীদের সংখ্যাও নিতান্তই কম। আর তাই বোধহয় আমরা নারীরাও ভুলে যাই সেই নারীদের স্মরণ করতে, যারা বিপ্লবী কাজে সংগঠন ও তত্ত্ব নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভুলে যাই সংগঠনের ভেতরে বাইরে এই বিষয়ে প্রশ্ন তর্ক তুলতে! লাল পতাকা মিছিলে সেই নারীদের ছবিসহ উপস্থিত হতে!

যতদিন বাংলাদেশে প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি না পাচ্ছে (কেবল কোটা অর্থে নয় সত্যিকার অর্থে) যতদিন না এই দলগুলোর সমাবেশে প্রথম সারিতে নারী-পুরুষ সমানে সমানে দাঁড়াবার যোগ্যতা অর্জন না করছেন, যতদিন নারীরা জাতীয় ইস্যুতে বিশ্লেষণী এবং উদ্দীপনা-উৎসাহ জোগানো বক্তৃতা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন, ততদিন বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব হিসাবে নারীকে সামনে আনার কথা আমরা ভুলে যাবো এভাবে, এটাই সত্যি। যতদিন না নেতৃত্ব হিসাবে, ইতহাসবিদ হিসাবে, বিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক, তাত্ত্বিক ইত্যাদি হিসাবে আরো আরো নারী সমাজে তার কর্তা সত্তা নিয়ে হাজির না হচ্ছেন, ততদিন এইরকমই চলবে। আর এই কাজ, এই পরিবর্তন কোনো বাম দল বাম দলের পুরুষ নেতৃত্বের দেয়া সুযোগের অপেক্ষায় থেকে হবে না। নিজের যোগ্যতা দিয়ে, দক্ষতা দিয়েই নারীকেই ব্যক্তি হিসাবে তার সত্তা বিকাশে ভূমিকা রাখতে হবে।

নারীর লড়াই নিজেকে কর্তা সত্তা হিসাবে নিজেকে জানান দেবার লড়াই। সে লড়াই অনেক কঠিন, অনেক বন্ধুর। নারীর লড়াই-সংগ্রাম পুরুষের তুলনায় কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক বেশী, কোথায় কয়েকগুণ বেশি। পুরুষকে আরো আরো সৃজনশীল হতে, নেতা হতে, ঔপন্যাসিক হতে, ইতিহাসবিদ হতে, কথা সাহিত্যিক হতে… নিজের অজান্তে নারী নিজেকে বলি দেয় প্রতিদিন। এই বলি হওয়া নারীকে রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষ থেকে– মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না, স্বীকৃতি দেয়া হয় না তাঁর কাজকেও। এই বলিদানে কোনো কৃতিত্বও নেই। অক্টোবর শত বর্ষের এমনি নানা লাল পতাকার মিছিল সমাবেশে মুছে যাওয়া নারীর ছবি ফিরিয়ে আনার এবং আরো আরো নারীকে যুক্ত করবার লড়াইটা প্রথমত নারীর, কিন্তু এই লড়াই পুরুষেরও। এই লড়াই ঘরে-বাইরে; নিজের সাথে, দলে-বাম দলে; সমাজের আনাচে কানাচে সর্বত্র সকলকে করতে হবে। সমাজের অর্ধেক অংশ নারীকে বাদ দিয়ে কিংবা অর্ধেক অংশ নিজেকে নিষ্ক্রিয় রেখে সমাজকে বদল করা সম্ভব না।

এটা তো জানা কথা সমাজে বঞ্চিতরা, সুযোগহীনরাই একসময় লড়াইয়ের মূল প্রাণ ভোমরায় পরিণত হয়। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই। লড়াইয়ের সেই প্রাণ কেন্দ্রে নারীদের উপস্থিতিকে জোরালো শক্তিশালী করা,পর্দার আড়াল থেকে নারীর বাইরে আসার লড়াই আমাদের সবার। সেই লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেবার আহবান রইলো অচেনা অজানা লড়াকু নারী বন্ধুদের প্রতি। যাদের নাম আমরা জেনেও জানি না। যারা আমাদের আষেপাশে প্রতিদিন লড়াই করছেন, রক্তক্ষরণের মতো যন্ত্রণা নিয়ে নিজের সাথে নিজে লড়ছেন নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে। প্রচলিত সমাজ সম্পর্ক ক্ষমতার কাঠামোকে ভাঙতে নিজেদের ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছেন। শুধু সেই নারীদেরই নয়, আহবান জানাই এই সমাজের নারী ও পুরুষ সকলকে যারা সমাজ বদলের, সম্পর্কের ধরন বদলের, ক্ষমতা কাঠামোর বদলের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের সকলকে।

লেখক পরিচিতি: তাসলিমা আখতার (Taslima Akhter)
কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য,
গণসংহতি আন্দোলন ।
সভাপ্রধান , গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি । সহ সভাপতি নারী সংহতি।
আলোকচিত্রী, শিক্ষক পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট

শেয়ার করুন: