ফারজানা আকসা জহুরা:
ঘটনা (১)
রুমি (ছদ্ম নাম)। এমএ পাশ রুমিদের বাড়ি একটি উপজেলা শহরে। এক ভাই, এক বোনের মধ্যে রুমি সবার বড়। তার বাবা ঢাকায় চাকরি করেন। উচ্চ শিক্ষিত রুমির জন্য তার পরিবার পাত্র খুঁজছিল। রুমি নিজেও চাকরির চিন্তা না করে বিয়ের চিন্তা শুরু করে। অন্যদিকে ফেসবুকের মাধ্যমে রুমির পরিচয় হয় এক ইউরোপ প্রবাসীর ছেলের সাথে। খুব দ্রুত তাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ছেলেটি রিফিউজি, তাই বাংলাদেশ যেতে পারবে না। কিন্তু তারা অন্যদেশে গিয়ে বিয়ে করতে পারবে! এতো ভালো ছেলে, যদি হাত ছাড়া হয়ে যায়! তাই ছেলের এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। তারা ছেলের পরিবারের সাথেও কোনো যোগাযোগ করেন না। ভাবেন, যদি ছেলের পরিবার তাদের মেয়েকে পচ্ছন্দ না করে। তাই তারা ছেলের পরিবারকে না জানিয়ে অন্য একটি দেশে গিয়ে প্রবাসী ঐ ছেলেটির সাথে রুমির বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের খরচ এমনকি থাকা খাওয়া খরচও রুমির পরিবার বহন করে।
গত দেড় বছর ধরে ছেলেটি রুমিকে আনবে বলছিল। কিন্তু রুমির কোনো কাগজ সে জমা দিচ্ছিল না। কিছুদিন আগে রুমি ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারে যে, ছেলেটি এখন আরেকটি মেয়ের সাথে প্রেম করছে। এখন ছেলেটি অন্য আরেকটি মেয়েকে নিয়ে সে মালোয়শিয়া গিয়েছে। শুধু তাই না, ছেলেটি তার ফেসবুকে তাদের দুইজনের অন্তরঙ্গ ছবি আর লাইভ ভিডিও প্রচার করেছে। যেখানে ঐ ছেলেটি নতুন মেয়েটিকে তার স্ত্রী বলে উল্লেখ করেছে।
রুমি উপায় না দেখে পুরো বিষয়টি বাংলাদেশে অবস্থিত ঐ দেশের দূতাবাস কেন্দ্রে জানায়। কিন্তু সমস্যা একটাই, তাদের বিয়েটা ধর্মমতে সঠিক হলেও তার আইনত কোন বৈধতা নেই। রুমি ও তার পরিবার জানতো না যে অন্যদেশে বিয়ে করতে গেলে একজন রিফিউজির অনুমতি লাগে, আবার যে দেশে বিয়ে করবেন সেই দেশের আইনি বৈধতা লাগে। ফলে রুমি এখন জানে না তার কী হবে! অন্যদিকে ছেলেটিও বলে দিয়েছে যে, সে রুমিকে আর বিদেশে আনবে না। আবার রুমিকে সে তালাকও দিবে না!
ঘটনা (২)
বেলি (ছদ্ম নাম)। বেলি প্রত্যন্ত গ্রামের হাইস্কুলে পড়ুয়া একটি মেয়ে। সচ্ছল পরিবারের মেয়ে বেলি নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করতো। কলেজে উঠতেই যখন বেলির জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল, ঠিক তখন বেলি তার ফেসবুকে স্বল্প পরিচিত এক ইউরোপ প্রবাসী বন্ধুকে বেছে নেয়।
কিন্তু সমস্যা একটাই, ছেলেটি তখনো বৈধতা পায়নি, তাই সে বাংলাদেশে যেতে পারবে না। তবে ছেলেটি বেলিকে অবৈধভাবে ইউরোপে আনতে পারবে। প্রবাসী পাত্র! যদি হাতছাড়া হয়ে যায়! সেই ভয়ে বেলির পরিবার দালাল ধরে বিদেশে আসার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। বিদেশে আনার জন্য ছেলেটি দালালও ঠিক করে দেয়। প্রায় দুই-তিন বছর বেলিকে ঐ দালালের সাথে এইদেশ-ওইদেশ করে বিভিন্ন দেশ ঘুরতে হয়েছে। তখনও ছেলের পরিবার এই বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানতো ন। অবশেষে বেলি যখন ইউরোপের ভিসা পায় ঠিক তখন তাদের দুই পরিবারের কথা হয় এবং তাদের ফোনে বিয়ে হয়!
ঘটনা (৩)
শাওন (ছদ্মনাম)। শাওন সুন্দরী এবং স্নাতক করছিল। ডাউন টাউনের মেয়ে শাওনও ফেসবুকের মাধ্যমে আরেক প্রবাসীর প্রেমে পড়ে। কিন্তু তারা তাদের পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এখানেও সমস্যা একটাই, ছেলে দেশে আসতে পারলেও বৈধ উপায়ে বৌ এখন আনতে পারবে না। কারণ বৈধ উপায়ে বৌ আনার জন্য যে শর্তগুলি পূরণ করতে হয়, তা ছেলেটির নেই।
শাওনের বাবা-মা ভাবেন, ভালো পাত্র! যদি হাত ছাড়া হয়ে যায়! আর দেশে আসলে তো পাত্রীর অভাব হবে না। তাই শাওনের বাবা-মা নিজ খরচে দালাল ধরে মেয়েকে ঐ প্রবাসী ছেলের কাছে পাঠিয়ে দেন। আসার আগে তাদেরও ঐ স্কাইপে বিয়ে হয়।
অবাক করার বিষয় হলো, যেই দেশে মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই, দূরে গিয়ে পড়াশোনা করার অনুমতি নেই, চাকরি করে রাতে বাড়ি ফিরলে খারাপ মেয়ের তকমা লেগে যায়, যেই দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীদের স্বামী অধীন রাখা হয়, সমাজ ও ধর্মের হাজার নিয়মে নারীদের বেঁধে রাখা হয়, সেই দেশেই শুধু বিয়ের জন্য অপরিচিত দালালের হাতে মেয়েদের ছেড়ে দেয়া হয়! কখনো কখনো বছরের পর বছর দালালের সাথে দেশ-বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়! পুরুষেরা নিজের প্রয়োজনে দালালের কাছে বৌকে বর্গা দিয়ে বিদেশে আনেন! আর সমাজও তখন এই রুপ ইন্টারনেট ভিত্তিক বিবাহকে জায়েজ ঘোষণা দিয়ে দেয়। কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা এটাই।
শুধু রুমি, বেলি, আর শাওন না, ফেসবুক আর টুইটারের এই যুগে ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক ছেলে- মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব কিংবা প্রেম হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে বসবাস, আর সুখ স্বচ্ছতার মধ্যে থাকার ইচ্ছায় তারা স্বল্প পরিচিত কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটিকে বিশ্বাস করে বিয়েও করে ফেলছে। ঘটনাটি খুব রোমাঞ্চকর মনে হলেও বাস্তবে এটা একটি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পর্ক। যা হয়তো ছেলে কিংবা মেয়েটি বিপদে পড়ার আগে কখনো বুঝতে পারে না।
কারণ উন্নত বিশ্বে অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও আছে অনেক আইনি জটিলতা। বিদেশে, বিশেষত ইউরোপে বেশিরভাগ লোকের বৈধতা পেতে কিংবা স্থায়ী হতে একটু সময় লাগে। আবার অনেকে “আইনি জটিলতা ও বাধ্যবাধকতা” এড়ানোর জন্য অবৈধভাবে বৌ- বাচ্চাদের বিদেশে নিয়ে আসেন। যারা তাদের বৌ/বাচ্চাদের অবৈধভাবে বিদেশে আনেন, তাদের বেশি ভাগের বিয়ে বা সম্পর্কের কোনো আইনগত স্বীকৃতি থাকে না।
এর ফলে যা হয়, ছেলেটি খারাপ হলে মেয়েটির কপাল পোড়ে! মেয়েটির আর প্রবাসীর সাথে সংসার করা হয় না। না ছেলেটির বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। অথচ সবাই জানে যে মেয়েটি বিবাহিত। আর এই বিবাহিতা টাইটেলের কারণে মেয়েটির সামনে এগিয়ে যাওয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে যদি মেয়েটি বিদেশে এসে দেখে যে ভদ্রলোকের আগের বৌ আছে কিংবা তাদের বিয়েটা আসলে বিয়ে না, তাদের সম্পর্কে কোনো আইনত ভিত্তি নেই, তখন মেয়েটিরও যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না। বাধ্য হয় এইরুপ অন্যায় মেনে নিতে।
আবার এর উল্টোটাও ঘটে। অনেক সময় প্রবাসে এসে মেয়েদের আর ফেসবুকের সেই প্রেমিককে ভালো লাগে না। তাই তারা সুযোগ পেলে অন্য লোকের সাথে পালিয়ে যায়। বেচারা ভদ্রলোক তথাকথিত বৌয়ের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারেন না। অন্যদিকে তার মোটা অঙ্কের টাকাও লস হয়। কারণ মেয়েটিকে আনার জন্য ছেলেটি যে পরিমাণ অর্থ দালালকে দেয় তা হয়তো কয়েক বছরের উপার্জন!
আসলে বিয়ে এবং বিবাহিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের দুইজনকেই কিছু ছাড় দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রী দুইজনের বোঝাপড়া, কিছু ত্যাগ স্বীকার আর সম্পর্কের সততাই পারে বিবাহিত জীবনকে সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী করতে। কিন্তু এক তরফা ছাড় সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে। কখনো কখনো ছাড় দিতে দিতেই সম্পর্কগুলি বিপদজনক বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সম্পর্কের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায় যখন নারী কিংবা পুরুষ জীবনসঙ্গী হিসাবে একজন স্বল্প পরিচিত কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে বেছে নেয়। যেহেতু মানুষের জীবনে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, সেহেতু ফেসবুক আর টুইটারের মতো কাল্পনিক জগতে পাত্র-পাত্রী বেছে নেওয়ার আগে আমাদের একটু ভেবে দেখা উচিত।